রণেশ মৈত্র


মিয়ানমারে ২০২০ সালেরর নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। অংসান সুডচও নেতৃত্বাধীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এন.এল.ডি) পূর্ববর্তী নির্বাচনের চাইতেও বেশী ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়। সেখানকার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে প্রয়োজন হয় ৩২২ টি আসন। কিন্তু ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এন.এল.ডি) পেয়েছিল ৩৪৬টি আসন অর্থাৎ ২৪ টি আসন বেশী পেয়েছিল প্রয়োজনের চাইতে। ফলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অংসান সুডচও দলকে, গণতন্ত্রের সাধারণ নিয়ম অনুসারেই আহ্বান জানানোর কথা মন্ত্রী সভা গঠনের জন্য পার্লামেন্টে বৃহত্তম দলের নেতাকে আহ্বান জানানো হলো না।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভিযোগ তুললো নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয় নি। এ দাবী বিস্ময়কর ও উদ্দেশ্যমূলক। স্বভাবতই শুধু মিয়ানমারের মানুষেরা নন, গোটা বিশ্বই এই দাবীকে অযৌক্তিক বলে মনে করেন এবং যে টুকু মিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের অস্তিত্ব সে দেশে আছে বা কিছ দিন (মাত্র বছর দশেক) আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তারও গলা টিপে ধরার ষড়যন্ত্র বলেই মনে করেছিল।

ব্যাপারটা ঠিক তাই ঘটলো ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ তারিখে। সেদিন অকস্মাত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সমূহ বিশেষ খবর হিসেবে মিয়ানমারে সামরিক অভূত্থান ঘটা, অংসাং সুচি সহ তাঁর দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রাসির অপরাপর শীর্ষ নেতাদের আটকে খবর প্রচারিত হলো। এর পর পরই বাংলাদেশের গণমাধ্যম সমূহেও খবরটি দফায় দফায় প্রচারিত হতে দেখা গেল। আজ ৪ ফেব্রুয়ারি পর্য্যন্ত দেশী বিদেশী সকল গণমাধ্যমেই মিয়ানমারের খবর বিশ্বের গুরুত্ব সহকারেই প্রচারিত হচ্ছে। সম্ভবত গুরুত্ব সহকারেই প্রচারিত হচ্ছে। সম্ভবত: তা আরও বেশ কিছুকাল চলবে।

সামরিক বাহিনী মিয়ানমারে অত্যন্ত বেপরোয়া। মিয়ানমারের ইতিহাস তেমনই বলে। একটু পেছন ফিরে তাকালেই মিয়ানমারে সেনাশাসনের চিত্র পরিস্কার হবে।

১৯৪৮ সালের বার্মা (বর্তমানে মিয়ানমার) নামে এশিয় দেশটি বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিলাভ করে অর্জনকরে স্বাধীনতা। এর মাত্র ১৪ বছর পরে অভ্যূত্থানের মাধ্যমে দেশটির ক্ষমতা দখল করেন সামরিক নেতা নে উইন। তিনি বেসামরিক রাজনৈতিক নেতাদেরকে রাজনৈতিক প্রশাসনিক অঙ্গন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সামরিক জান্তার মাধ্যমে বহু বছর ধরে দেশটি শাসন করেন।

১৯৮৮ সালে ঐ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়কের কন্যা অংসান সুচি বিদেশ থেকে দেশে ফিরে এসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবীতে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। এই আন্দোলন দমনের জন্য ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার গুলি চালিয়ে শতাধিক বিক্ষোভকারী নেতা-কর্মীকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সাহসী স্পষ্টভাষী সমালোচক বলে দেশে-বিদেশে পরিচিতি পাওয়া অংসাং সুচিকে গৃহবন্দী করে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার।

১৯৯০ সালের অক্টোবরের অগণতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে আন্দোলন পরিচালনা করায় সুচিকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের ভূষিত করা হয়। এর দ্বারা একদিকে ব্যক্তি ও জননেতা হিসাবে অংসান সুচিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৌরবান্বিত করা হয় একই সাথে আবার মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের প্রতিদ অনাস্থাও প্রকাশ করা হয়।

২০১০ সালের ৭ নভেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত মিয়ানমারের প্র্যতম গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচনে জান্তাপন্থী একটি দল জয়লাভ করে। তবে সে ভোটে ব্যাপক কারচুপি ও পক্ষ পাতিত্বমূলক বলে বিস্তর অভিযোগ উত্থাপিত হলে সুডচও দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্যাসি ঐ ভোট বর্জন করে ।

২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর তারিখে দুই দশকেরও বেশী একটানা আটক থাকার পর এন.এল.ডি প্রধান অংসাং সুচিকে মুক্তি দেওয়া হয়।

২০১২ সালে সুচী একটি উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন এবং তাঁর জীবনে প্রথম বারের মত সংসদে আসন গ্রহণ করার সুযোগ পান।

২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে এন.এল.ডি দুর্দান্ত বিজয় অর্জন করে। কিন্তু সে দেশের সামরিক শাসকদের তত্বাবধানে অনুমোদিত সংবিধানের অধীনে সেনারা তাদের হাতে ক্ষমতা ধরে রাখতে সুচিকে প্রেসিডেন্ট হতে দেয় নি। তখন সরকারের নেতৃত্ব প্রদানের জন্য সুচির দাবী আংশিক মেনে নিয়ে তার জন্য ষ্টেট কাউন্সিলার নামে নতুন পদ তৈরী করা হয়।

২০১৭ সালের ২৫ আগষ্ট বিদ্রোহীরা পশ্চিামঞ্চলীয় রাখাইন রাঝ্যে সামরিক ফাঁড়িতে হামলা চালায়। এতে সামরিক বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত হয়। এর প্রতিক্রিয়া প্রতিহিংসাবশত: সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর বেপরোয়া ধ্বংস যজ্ঞ চালায়। এর পর প্রায় সাত থেকে দশ লাভ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আত্মরক্ষা করে।

২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর হেগের আন্তদর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারে গণহত্যা চালানো বরং লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেশত্যাগ বাধ্য করার প্রতিবাদে গাম্বিয়া কর্তৃক দায়েরকৃত মামলার শুনানীতে হাজির হয়ে সুচি তাঁর দেশে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেন। ফলে তিনি বিশ্বব্যাপী নিন্দার পাত্রে পরিণত হন। এক পর্য্যায়ে নোবেল কমিটি সূচিকে প্রদত্ত নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেন।

২০২০ সালের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে এন.এল.ডি. সংসদে পরিপূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে। কিন্তু ২৯ জানুয়ারি তারিখে সামরিক শাসকদের আনীত ভোটে কারচুপির অভিযোগের সপক্ষে কোন প্রমান খারিজ করে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয় সামরিক বাহিনী।

এই পটভূমিতে ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ তারিখে মাত্র তিন মাস আগে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সুচির নেতৃত্বাধীন এন.এল.ডি সরকার ভোট জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়া এবং করোনা ভাইরাস সংকটের কারণে ঐ নির্বাচন স্থগিত রাখতে অস্বীকৃতি জানানোর অভিযোগে সামরিক বাহিনী “এক বছরের জন্য” মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণ সামরিক বাহিনী নিয়ে নেয়। সুচিকে পর পরই গৃহবন্দী করা হয়, এন.এল.ডি’র বহু সংখ্যক প্রথম সারির নেতাকেও আটক করা হয়। দেশে জরুরী অবস্থাও জারী করা হয়।

দেশটির পিছু হটার বৃত্তান্ত

২০১৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংসাং সুচির বিজয়ের পর গণতান্ত্রিক মিয়ানমারকে সবাই নতুন মিয়ানমার বলে অনেকেই অভিহিত করতেন। এরপর রোহিঙ্গা নির্য্যাতন সহ নানা ইস্যুতে সারা বিশ্বের কাছে ব্যাপক সমালোচনার পাত্রে পরিণত হয় মিয়ানমার। তবুও নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র বিরাজ করছিল সে দেশে। কিন্তু সামরিক জান্তার পুনরায় হস্তক্ষেপের কারণে আবার দেশটির পুরাতন চেহারাই ভেসে উঠলো । নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে মিয়ানমারে কয়েক দিন ধরে চলছিল বেসামরিক সরকার ও প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর দ্বন্দ্ব এবং উত্তেজনার মধ্যেই ক্ষমতার এই রদবদলঘটলো। সে দেশ গত শতকের অর্ধৈকটাই সামরিক শাসনের অধীনে ছিল ১৫ বছর ধরে সুচি একটানা বন্দী ছিলেন। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধে এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে আটকাবস্থা থেকে এন.এল.পি প্রধান অংসান সুচি জনগণকে আন্দোলন গড়ে তুলতে রাপথে নামার আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রত্যুত্তরে সামরিক বাহিনীও কঠোরভাবে আন্দোলন প্রতিরোধ, সামরিকভাবে হলেও ইন্টারনেট ও গণমাধ্যম সমূহে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে।

বাংলাদেশের মানুষ স্বাভাবিক কারণেই অংসান সুচির উপর ক্ষুব্ধ। দিনি যে গণহত্যা চালিয়েছেন এবং যেভাবে রোহিঙ্গাদের উপর সাম্প্রদায়িক নির্য্যাতন চালিয়ে লক্ষ লক্ষ অসহায় রোহিঙ্গাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছেন এবং আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছেন এবং আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নানা অজুহাতে টালবাহানা চালিয়ে যাচ্ছিলেন সে কারণেই বাংলাদেশের মানুষের এই ক্ষোভ।

অবশ্য একথাও সত্য, সরকার সে দেশে সুচির চালালেও তা ছিল সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এবং সামরিক বাহিনীর সম্মতি ব্যাতিরেকে রোহিঙ্গাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া কার্যত: অত্যন্ত দুরূহ।

মিয়ানমারের (সাবেক ব্রহ্মদেশ) স্বাধীনতার অগ্রনায়ক জেনারেল অংসানের মেয়ে সুচির বয়স যখন মাত্র দুই বছর তখন তাঁর বাবাকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে বৃটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র দুই বছর পর এই হত্যাকা- ঘটেছিল। ধীরে ধীরে সুচি গণতন্ত্রের লড়াই শুরু করলে বিশ্বব্যাপি তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন। তাঁকেএক সময় মানবাধিকারের বাতিঘর বলা হতো। তিনি একজন নীতিবান মানবাধিকার কর্মী হিসাবে দশকের পর দিশক ধরে মিয়ানমারের শাসন ক্ষমতা ধরে রাখা নির্দয়, নির্মমতার প্রতীক সামরিক জেনারেলদেরকে চ্যালেঞ্চ করতে নিজের স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। শান্তিতে অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কারটাও শেষতক তাঁর পক্ষে ধরে রাখতে সম্ভব হয় নি। রোহিঙ্গা এবং গণহত্যা ইস্যুতে তিনি নিন্দাবাদের পাত্রে পরিণত হন। যদিও মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দশকের পর দশক ধরে চালিয়ে তিনি বিশ্বব্যাপী শ্রদ্ধাও মর্য্যাদার দুর্লভ আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

বর্তমানের মিয়ানমার

সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে জরুরী অবস্থাজারী ও দেশব্যাপী রাজনৈতিন নেতা-কর্মীদেরকে গ্রেফতার করারপর থেকেই সে দেশে এক যমযমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

সমগ্র বিশ্বের গণতান্ত্রিক সরকার সমূহ, গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলি এবং মানবাধিকার সংগঠন সমূহ মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর অবৈধ হস্তক্ষেপের সমালোচনায় মুখর। জাতিসংঘে সকলে মিলে নিন্দা প্রস্তাব আলোচনাকালে চীন ভেটোপ্রয়োগ করে সামরিক বাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করায় চীনও নতুন করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে।

এ পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রয়োজন

বাংলাদেশের অন্যতম নিকটতম প্রতিবেশী মিয়ানমার। সেদেশে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করাউগ্রপন্থী বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা অধিকতর প্রাধাণ্যে এসেছে। এই উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী সে দেশের সর্বাধিক সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। এরা অস্তদ্র সজ্জিত বলেও জানা যায়। তাদের প্রাধান্য অর্জনের অর্থ দাঁড়াবে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান আরও অনেক বেশী দীর্ঘায়িত হওয়া।

তাই বাংলাদেশের স্বার্থেও এই দেশের গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন একান্ত কাম্য। নতুন করে ভারতে হবে সুচি এবং এন এল ডি কোও। সাম,রিক বাহিনীর সাথে আপোষ করে ক্ষমতা, সাম্প্রদায়িক নির্য্যাতন চালিয়ে ক্ষমতা, গণহত্যা চালিয়ে ক্ষমতা, একটি সম্প্রদায়ের মানবাধিকার, নাগরিকত্ব এবং জমির ও ব্যবসার ম ালিকানা অর্জনের অধিকার অস্বীকারের নয় বরং সেগুলি স্বীকার করে নিয়ে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এগুলি না মানার ফলেই মিয়ানমার এতকাল গণতন্ত্রের মুখ দেখে নি।


লেখক : সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক।