অরিত্র কুণ্ডু, ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহের বারোবাজারে ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনার নেপথ্য কারণ বাস সিণ্ডিকেটের নিজেদের তৈরি তথাকথিত ‘সময় আইন’। সময় রক্ষার নামেই ওভারস্পিডে গাড়ি চালান চালকরা। আর তাতেই প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। যাতে বলি হচ্ছেন সাধারণ যাত্রীরা। চলতি বছরে এ আইনের ফাঁদে জীবন হারিয়েছেন অন্তত ২৫ জন। কেবল ‘সময় আইন’ নয়; অবৈধ যানবাহন, চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য ও সড়ক দখলের কারণেও ঘটছে দুর্ঘটনা। অবশ্য এ নিয়ে প্রশাসনের পক্ষে নেই তেমন কোন তৎপরতা।

বুধবার ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজারে সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ জন প্রাণ হারান। এসময় আহত হয় কমপক্ষে আরো ২০ জন। নিহতদের মধ্যে নয়জন পুরুষ, দুইজন নারী ও একজন শিশু ছিল। এছাড়া এদের মধ্যে ছয়জনই ছিল কলেজ শিক্ষার্থী। যারা যশোর থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে বাড়ির উদ্দেশে বাসে উঠেছিল। পথিমধ্যে বারোবাজার তেলপাম্পের কাছে পৌছালে চালক নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং বাসটি উল্টে রাস্তার উপর আড়াআড়ি হয়ে যায়। এসময় বিপরীত দিক থেকে আসা দ্রুতগামী ট্রাক রাস্তার উপর পড়ে থাকা বাসের মাঝামাঝি স্বজোরে আঘাত করে। এতে মর্মান্তিক হতাহতের ঘটনা ঘটে। ঝিনাইদহ ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক শামীমুল ইসলাম জানান, বাসটির বেপরোয়া গতির কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এর আগে ১৩ জানুয়ারি একই সড়কের ঝিনাইদহের শৈলকূপায় ট্রাক ও ইঞ্জিন চালিত নসিমনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৮ ইমারত শ্রমিক নিহত হয়। এসময় আহত হয় আরো চারজন। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে একই সড়কের উপজেলার মদনডাঙ্গা বাজারের শ্রীরামপুর বাসস্ট্যান্ডে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।

এছাড়া ২ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া সড়কের শৈলকূপার বড়দাহ এলাকায় দ্রুতগতির একটি বাসের চাপায় আরিফ শেখ নামে এক বৃদ্ধ নিহত হয়। গেল বছরের ৩০ ডিসেম্বর বারোবাজার এলাকায় দ্রুতগতির কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় ইকবাল হোসেন নামের এক মোটরসাইকেল যাত্রী নিহত হয়। এভাবে এই সড়কে ছোট বড় অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে হতাহত হচ্ছে নেহায়েত কম নয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর সাথে সারাদেশের যোগাযোগের প্রধান সড়ক খুলনা-যশোর-ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া সড়কটি। এ সড়কে প্রধান যাত্রীবাহী বাস হলো রুপসা ও গড়াই পরিবহন। প্রতিদিন কুষ্টিয়া থেকে ৩৬টি গড়াই পরিবহন খুলনা এবং খুলনা থেকে ৪৩টি রুপসা পরিবহনের বাস কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। রুপসা পরিবহন ৯ মিনিট এবং গড়াই পরিবহন ১০ মিনিট পরপর একটি করে গাড়ি ছাড়ে। এসব গাড়ির একটি স্টপেজ থেকে অপর একটি স্টপেজে পৌছানোর জন্য বাস সিণ্ডিকেট থেকে তৈরি করে দেয়া হয়েছে নির্ধারিত সময়। প্রতি স্টপেজে যাত্রী উঠানো নামানোর কাজ শেষ হলেই বাস ছেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু যাত্রী নামানোর পরও চালকদের দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ফলে নির্ধারিত সময় পরের স্টপেজে পৌছানো অনেক সময় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এজন্য চালকরা সময়মত পৌছাতে বেপোরোয়া গতিতে বাস চালিয়ে থাকেন। ফলে ব্যস্ত সড়কে প্রায়শ’ ঘটে দুর্ঘটনা।

এ সড়কের চলাচলকারী বাসের মালিক ও শ্রমিকরা জানান, খুলনা থেকে কুষ্টিয়া হয়ে আবার খুলনা ফিরে যেতে একটি পরিবহনকে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। এসব চাঁদা আদায় করে জেলা উপজেলায় গজিয়ে উঠা মালিক, শ্রমিকদের সংগঠন। এছাড়া প্রশাসনের নামেও চাঁদা আদায় করে নানা ব্যক্তি ও সংগঠন। এ চাঁদার টাকা পরিশোধ করতেই বাধ্য হয়ে তারা বাড়তি রোজগারের জন্য বিভিন্ন স্টপেজে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করেন। এরপর নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার গতিতে বাস চালাতে হয়।

এদিকে রুপসা পরিবহনের চালক রবিউল ইসলাম জানান, যশোর থেকে কালীগঞ্জ পৌছাতে ৩৫ মিনিট সময় বেধে দেওয়া। আর কালীগঞ্জ থেকে ঝিনাইদহে পৌঁছাতে ২৫ মিনিট। নির্ধারিত সময়ে না পৌছাতে পারলে রয়েছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। এদিকে যাত্রী নেওয়ার জন্য স্টপেজে কিছু সময় নষ্ট হলে রাস্তায় চলার সময় গতি বাড়িয়ে তা মেকআপ করতে হয় বলে যোগ করেন এই চালক।

তিনি আরো বলেন, এছাড়া রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় প্রায়ই দেখা যায় ইজিবাইক, মোটরচালিত রিক্সা-ভ্যান ও সাধারণ মানুষ অসচেতনভাবে রাস্তার উপর চলে আসে। আর তাদের জীবন রক্ষা করতে গিয়েই বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। তাছাড়া যানবাহনের পরিমাণ বাড়লেও সড়কগুলো সেই অনুসারে প্রশ্বস্ত হয়নি। পাশাপাশি সড়কের উপর বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী রাখা এবং গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়। এতেও দুর্ঘটনা ঘটে।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ মটর মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব ফরিদ উদ্দীন জানান, দুর্ঘটনারোধে সড়কে চলাচলকারী গাড়ির গতি স্থানীয় সড়কে ৪৫ এবং মহাসড়কে ৬০ কিলোমিটার করতে হবে। এটা বাস্তবায়ন করতে সরকারের গভর্ণর সিলের ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তায় অবৈধ গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে হবে। এছাড়া সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।

ঝিনাইদহ জেলা বাস মালিক সমিতির বর্তমানে কোন কমিটি নেই। তবে এ সমিতির সাবেক সভাপতি রোকনুজ্জামান রানু জানান, সড়কে যাত্রীবাহী বাসগুলো ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করে। অনেক সময় অবৈধ থ্রি হুইলার, ইজিবাইক, আলমসাধু ও নসিমনগুলো অসচেতনভাবে গাড়ির সামনে চলে আসে। যখন বাস চালকদের কিছুই করার থাকে না। ফলে প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন তিনি। দুর্ঘটনারোধে সরকারের উচিৎ মালিক শ্রমিকদের নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। এছাড়া সরু সড়ক প্রশস্তকরণের দাবি করেন তিনি। তবে সময় নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তিনি কোন কথা বলেননি।

ঝিনাইদহ ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর মোঃ সালাহউদ্দীন জানান, সড়কে চালকদের বেপরোয়া চলাচলই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। চালকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও সড়কে চলাচলকারী সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে ক্যাম্পেইন করা জরুরি।

তিনি আরো বলেন, ট্রাফিক বিভাগ দুর্ঘটনারোধে মহাসড়ক থেকে অবৈধ থ্রি-হুইলার, ইজিবাইক ও স্থানীয় তৈরি শ্যালোচালিত গাড়ি বন্ধ এবং এসব উৎপাদনের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ না পদক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে। তারপরও দুর্ঘটনা ঘটছে। আর সেটা একমাত্র বেপরোয়া গতির কারণেই।

(একে/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২১)