নুরুজ্জামান শুভ : গত একবছর ধরে করোনা কারণে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো বন্ধ থাকলে ও হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়ার জন্য আন্দোলনমুখি হয়েছে শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে পার্শ্ববর্তী গেরুয়া গ্রামের সংঘর্ষের ঘটনার মাধ্যমে। এই ঘটনার কিছুদিন পূর্বে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর নারকীয় হামলা করেছিল স্থানীয় শ্রমিকেরা। দুটি ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

বিগত কয়েকমাস ধরেই শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় গুলো খুলে দিয়ে ক্লাস পরীক্ষা গ্রহণ করে দ্রুত সেশনজট নিরসন করা। ইতিমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ, কুমিল্লাসহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বশরীরে পরীক্ষা চলমান ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেশনের পরীক্ষা ইতিমধ্যে অনলাইনে শেষ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ মার্চ হল গুলো খুলে দিয়ে প্রয়োজনের ভিত্তিতে সিনিয়র ব্যাচগুলোর পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল।

গত ১৯ শে মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘাতের সূত্র ধরে ২০ শে মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা ও শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করার দাবিতে প্রশাসনকে হলগুলো খুলে দেওয়ার আল্টিমেটাম দেয় এবং প্রশাসন দাবি না মেনে নিলে শিক্ষার্থীরা হলের তালা ভেঙে হলে অবস্থান করা শুরু করে। এই আন্দোলনের উত্তাপ পর দিন ঢাকা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং হলগুলো খুলে দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার দাবি জোরদার হতে থাকে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাতে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ১৭ মে থেকে হল খোলা এবং ২৪ এ মে থেকে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা দেন এবং একই সাথে চলমান সকল পরীক্ষা স্থগিত করার নির্দেশ দেন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর এই নির্দেশনায় শিক্ষার্থীরা খুব বেশি খুশি হতে পারেন নি, বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের পরীক্ষা চলমান ছিল তারা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ফলে ঢাকার সাত কলেজের একটি অংশ মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনার পুনর্বিবেচনা করে চলমান পরীক্ষাগুলো নেওয়ার দাবিতে ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাতেই ঢাকার নীলক্ষেত সড়ক অবরোধ করে এবং পরদিন ২৪ শে ফেব্রুয়ারি নীলক্ষেত, সাইন্সল্যাব সব বেশ কয়েকটি সড়ক অবরোধ করে। একই সাথে সারাদেশের বিভিন্ন জায়গার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একই দাবিতে আন্দোলনরত ছিল।

আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী পুনরায় ঘোষণা করেন সাত কলেজের চলমান পরীক্ষা গুলো চলবে তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত অন্যান্য কলেজের পরীক্ষা পূর্বের নির্দেশনা অনুযায়ী স্থগিত থাকবে।অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রীর বিশ্ববিদ্যালয়ের খুলে দেওয়ার তারিখ ঘোষণাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিব্রত প্রকাশ করেছেন।ফলে দুটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে।

প্রশ্ন উঠেছে হঠাৎ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে এতো ক্ষোভের জন্ম নিলো কেন? কেন তারা আন্দোলনমুখি হলো?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যতীত দেশের পর্যটন কেন্দ্র, নির্বাচন,মিটিং, মিছিল, সিনেমা হল,হাট-বাজার সকল কিছুই চলমান রয়েছে।যেহেতু দেশের সকল কিছুই চালু রয়েছে, সেহেতু শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনেকদিন থেকেই শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার দাবি জানিয়ে আসতেছে।এদিকে অফলাইনে কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও অনলাইনে সীমিত পরিসরে ক্লাস,টিউটোরিয়াল, প্রেজেন্টেশন চালু রয়েছে।দেশের সকল স্থানে ইন্টারনেটের গতি সমান নয়।প্রান্তিক অঞ্চলে বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী ক্লাস করছে।সারাদেশ ভাল ইন্টারনেট গতি আছে এরকম সিম কোম্পানির সাথে সরকার চুক্তি করে স্বল্প টাকায় যদি শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা যেত তাহলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতো।আবার অনলাইনে ক্লাস করার জন্য অসংখ্য শিক্ষার্থীর ডিভাইস সংকট রয়েছে।ফলে দেখা যায় অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণের শতকারা হার স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম।
এদিকে করোনার কারণে মধ্যবিত্ত,নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের আর্থিক অবস্থাও সুবিধাজনক নয়।অসংখ্য শিক্ষার্থী টিউশনি করে নিজে চলতো,পরিবারকে চালাতো।প্রায় একবছর ধরে টিউশনিও নেই তাদের।যদিও কিছু শিক্ষার্থী নিজ নিজ ক্যাম্পাসের আশেপাশে থেকে টিউশনি করাচ্ছেন।তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে টিউশনির সংকটও রয়েছে।পনেরো দিনো কিংবা একমাস করে ছুটি বাড়ানোর কারণে নির্দিষ্ট ছুটির সময়সীমা না জানার কারণে খন্ডকালীনভাবে তারা কোন কাজের সাথেও যুক্ত হতে পারতেছে না।দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা মধ্যবিত্ত,নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসে এবং তারা দ্রুততম সময়ে স্টাডি শেষ করে পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য চাকরী অথবা কিছু একটা করার চাপ থাকে।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিলো তখন পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অসংখ্য শিক্ষার্থীরা মেস ভাড়া করে অবস্থান করতেছে। এমতাবস্থায় হঠাৎ করে পরীক্ষা বন্ধের ঘোষণাতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঠিক একই ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

একদিকে ব্যাপক সেশনজটের শঙ্কা অন্যদিকে করোনার কারণে একই বর্ষে দুই বছরের অধিক সময় ধরে থাকার কারণে এসকল শিক্ষার্থী মানসিকভাবে ও খারাপ অবস্থার মধ্যে দিন অতিবাহিত করতেছে। এদিকে করোনাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত, কিন্তু এই সময়ে তারা শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা গ্রহণ করছেন না, অথচ সরকার থেকে যখন গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে বলা হয়েছিল তখন এসকল প্রতিষ্ঠান স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে এই ইস্যুতে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। ফলে তাদের এই স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে!

শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যারা যুক্ত রয়েছেন তাদেরকে করোনার টিকা দেওয়ার একটি প্রশ্ন উঠেছে। এমতাবস্থায় যদি করোনার টিকা দেওয়া সম্ভব হয় তাহলে সেই ব্যবস্থা ও দ্রুততম সময়ে করা উচিত। কেননা করোনার টিকার যেহেতু একাধিক ডোজ নেয়া প্রয়োজন ফলে টিকার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে যথেষ্ট সময় লাগবে।

গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী স্কুল, কলেজ আগামী ৩০শে মার্চ থেকে খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণা স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে আরো ক্ষোভের জন্ম দিবে। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি, সকল সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।


লেখক : নুরুজ্জামান শুভ
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

(এনএস/পি/২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)