শিতাংশু গুহ


লেখক মুশতাক আহমদ জেলে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন। ঘটনাটি দুঃখজনক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জান খান কামাল বলেছেন, মুশতাক আহমদ অন্যদের ধর্মের বিরুদ্ধে লিখতেন, তার মৃত্যুর তদন্ত হবে। বিদেশমন্ত্রী ডঃ আবদুল মোমেন আমেরিকায় বসে বলেছেন, মানুষ যেকোন জায়গায় মরতে পারে, তবে সরকার বিষয়টি তদারকি করছে। মুশতাক আহমদ ডিজিটাল আইনে আটক ছিলেন, তাই এই আইন নিয়ে কথা হচ্ছে। কেউ কেউ আইনটি বাতিল চাচ্ছেন। অন্যরা এ আইনে আটক সকল বন্দীর মুক্তি চাচ্ছেন। জানা যায়, এ আইনে আটক কার্টুনিষ্ট আহমদ কবির কিশোরের অবস্থা ভালো নয়! 

ফেব্রুয়ারী (২০২১) মাসে এ আইনে গ্রেফতার হয়েছেন চুয়াডাঙ্গার যুবক মানিক খান, তিনি সামাজিক মাধ্যমে ষ্ট্যাটাস দেন যে, ‘যেখানে-সেখানে মসজিদ তৈরী না করে খেলাধুলার মাঠ বানালে শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ ঘটতো। এত মসজিদ দিয়েও সামাজিক বিপর্যয় রোধ করা যাচ্ছেনা’। যশোরের সুমন পাল একই আইনে গ্রেফতার হয়েছেন ফেব্রুয়ারী’র শেষ সপ্তাহে। তিনি কিছু লিখেননি, শুধু লাইক দিয়েছেন একটি গ্ৰুপে যেখানে লেখা ছিলো, ‘গর্বের সাথে বলুন আমি হিন্দু, আমি চারটি বিয়ে করিনা, অন্যদের গনিমতের মাল ভাবিনা, জোর করে ধর্মান্তরিত করিনা, ইত্যাদি।

গতবছর (২০২০) ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টে শতাধিক গ্রেফতার হয়েছে, এরমধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সংখ্যা দৃষ্টিকটুভাবে বেশি। ডিসেম্বরে ইসলাম নিয়ে কটুক্তি করায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ‘দিয়ার্ষি আরাগ’ পেজের এডমিন, দিপু কুমার ওরফে শাহারিয়ার দিপু। নভেম্বরে কুমিল্লার মুরাদনগরে হিন্দু পল্লীতে তৌহিদী জনতার আক্রমণের ঘটনা সবার জানা। সেখানে ৩জন হিন্দু ইসলাম অবমাননার দায়ে ডিজিটাল আইনে আটক হ’ন। ঘটনা ছিলো, ফ্রান্সে একজন ইসলামী সন্ত্রাসী এক ফরাসী রমণীর শিরচ্ছেদ করলে প্রবাসী বাংলাদেশী কিশোর দেবনাথ কিষান ষ্ট্যাটাস দেন যে, অসামাজিক চিন্তাভাবনাকে শায়েস্তা করার জন্যে ফরাসী প্রেসিডেন্ট যেসব উদ্যাগ নিয়েছেন তা প্রশংসনীয়। এর নীচে মুরাদনগরে স্কুল শিক্ষক শংকর দেবনাথ লিখেন, স্বাগতম প্রেসিডেন্টের উদ্যেগকে। এই তিনটি মাত্র শব্দের জন্যে হিন্দু পল্লী পুড়ে ছাই, মহিলারা লাঞ্চিতা, মারপিট, লুট, আরো কত কি! একই মাসে ইসলাম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে নোয়াখালীর হাতিয়ায় বিপ্লব চন্দ্র দাস (২৭) ও ফুলক চন্দ্র দাস (২৩) আটক হয়েছেন ওই আইনে।

অক্টবরে ৮জন হিন্দু ছাত্রছাত্রী ইসলাম অবমাননার দায়ে ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার হন, এরা হচ্ছেন, সাতক্ষীরার মিঠুন মন্ডল, জগন্নাথ ভার্সিটির তিথি সরকার, নোয়াখালী সাইন্স ও টেকনোলজির দুই ছাত্র পথিক মজুমদার ও দীপ্ত পাল; ফেনীর মিঠুন দে এবং ১৭ বছরের কলেজ ছাত্রী দীপ্তি রানী দাস, পুলিশ ঘটা করে বলেছে, পালিয়ে যাওয়ার সময় পার্বতীপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আগষ্ট মাসে টাঙ্গাইলে ভুঁইয়াপুর মসজিদের ইমামের ডাকে উন্মত্ত জনতা একজন শ্রাবন হালদারের বাড়ীতে হামলা চালায়, অপরাধ এই যুবক ইসলাম অবমাননা করেছেন, ডিজিটাল আইনে তিনি আটক হ’ন। একই মাসে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে রাধাকান্ত বিশ্বাস নামে এক যুবক কোরান অবমাননার দায়ে এই আইনে গ্রেফতার হ’ন। জুনে নাটোরে রতন নামে এক যুবককে পুলিশ নবী মুহম্মদকে অবমাননার দায়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে গ্রেফতার করে।

মে মাসে এই আইনে চাঁদপুরের মতলবে ইসলাম অবমাননার দায়ে সুমন দাস ২৬ ও অধীর চন্দ্র বিশ্বাসকে পুলিশ গ্রেফতার করে। একই অপরাধে, একই মাসে ভাল্লায় পুলিশ নারায়ণ দেবনাথ পিন্টুকে আটক করে। মানিকগঞ্জে মে মাসেই গ্রেফতার হন রনি মনোরিসি সত্যার্শী, ২২। এই মাসে জামালপুরে সুমন দাস কাবা অবমানার দায়ে আটক হন, তার বিরুদ্ধে মিছিল হয়, তাকে পেটানো হয়! মে মাসে ভোলার ঘটনাটি বেশ বড়! শুক্রবার নামাজের পর মুসুল্লীরা হিন্দুদের দোকানপাট জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। পুলিশ ফাঁকা গুলী ছোড়ে। এপ্রিলে কুড়িগ্রামে ইসলাম ও নবীকে অবমাননার দায়ে গ্রেফতার হন ইকোনমিক্স অনার্সের ছাত্র পরিতোষ কুমার সরকার। নান্দাইল ময়মনসিংহে গ্রাম্য ডাক্তার লক্ষণ চন্দ্র সিংহ এপ্রিল ২০২০-তে প্রথমে জনতার রোষের স্বীকার হন, তাঁর ঘরবাড়ি পুড়ে, তিনি প্রহৃত হন, পুলিশ তাঁকে ডিজিটাল আইনে আটক করে। একই অপরাধে সাতক্ষীরার আশাশুনিতে হিন্দু শিক্ষক ইন্দ্রজিৎ হাজারী এপ্রিলে গ্রেফতার হন।

মার্চ মাসে ইসলাম অবমাননার ভুয়া অভিযোগে গ্রেফতার হন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর স্কুল শিক্ষক শিবানন্দ দেব। একই মাসে বরিশালের খাঞ্জাপুরে মেদাকুল বিএমএস স্কুলের শিক্ষক উজ্জ্বল কুমার রায়কে ইসলাম অবমাননার অপরাধে জনতা মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করে, ডিজিটাল আইনের খড়গে তিনি গ্রেফতার হন। ফেব্রুয়ারীতে গ্রেফতার হন বাউল সঙ্গীত গায়িকা রিতা দেওয়ান, তিনি আল্লাহকে অবমাননা করেছেন! একই মাসে আল্লাহকে নিয়ে জোক করায় ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার হন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় যুবক অরুন গোস্বামী। ২০২০ শুরুতে পহেলা জানুয়ারী সিলেটে পলিটেকনিক ছাত্র অন্তর সরকার গ্রেফতার হন ইসলাম অবমাননার দায়ে ডিজিটাল আইনে। এক সপ্তাহ পরে দিনাজপুরের চিরির বন্দরে আটক হন কলেজ ছাত্র চিত্ত রঞ্জন রায়, গ্রেফতারের আগে তাঁকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে শহর ঘুরানো হয়! একই মাসে তৃতীয় ঘটনা ঘটে ঝিনাইদহে, পুলিশ হিন্দু শিক্ষক পিন্টু কুমার মজুমদারকে ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার করে।

২০১২’র রামু’র ঘটনা আমরা জানি। রংপুর ২০১৮ ঘটনা বাসি হয়ে গেছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে শুধু হিন্দু ও প্রগতিশীলরা আটক হচ্ছেন, ইসলামী মৌলবাদীরা বা ওয়াজে যে অহরহ অন্য ধর্মের অবমাননা হচ্ছে তা এ আইনের আওতায় পড়েনা? এতে সরকার ভিকটিম হিন্দু ও প্রগতিশীলদের রক্ষার বদলে ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার করছে। ২০২০-তে বড়ছোট কয়েক ডজন ঘটনা ঘটেছে, ডিজিটাল আইনে বিনা অপরাধে জেলে পঁচছে প্রায় শ’খানেক হিন্দু-বৌদ্ধ ও মুক্তমনা ছেলেমেয়ে। সামাজিক মাধ্যমে ইসলাম অবমাননা ঘটনায় ২০১২-তে রামু থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, কোনটি’র বিচার হয়নি, অপরাধীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নিরপরাধ হিন্দু ও মুক্তমনা মানুষ ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট নামে ব্ল্যাসফেমি আইনে বিনাবিচারে আটক রয়েছে। অথচ ইতিমধ্যে ইসলাম অবমাননার দায়ে ডিজিটাল এক্টে গতবছর ২জন হিন্দুর ৭বছর করে কারাদন্ড হয়েছে।

ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে বড় বাঁধা। দেশের সাংবাদিক মহল এই আইনের জোরালো প্রতিবাদ করেনি। আইনটি মুক্তমনাদের বিরুদ্ধে, এটি তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করছে এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে ‘ব্লাসফেমী আইন’ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধে কথা না বলার যুক্তি যত প্রবলই হোক না কেন, শফিকুল আলম কাজল কিন্তু সরকার বিরোধী ছিলোনা, সাগর-রুনি হত্যার বিচার হয়নি, কেজানে এই আইন কবে কার বিরুদ্ধে নেমে আসবে? কথা বলার সুযোগ না থাকলে আল-জাজিরার ‘অল দি প্রাইম মিনিস্টার্স মেন্’ এর মত রিপোর্টের পাল্টা রিপোর্ট করার ক্ষমতা বা সাহস থাকেনা। স্কুলে ভাবসম্প্রসারণ পড়েছিলাম যে, ‘অমঙ্গলকে হাসিয়া উড়াইয়া দেয়ার চেষ্টা করিলে মঙ্গল সমেত উড়িয়া যায়’। বাংলাদেশে জামাত-বিএনপিকে উড়াইয়া দিতে গিয়া আমরা নিজেরাই জামাত-বিএনপি হইয়া গিয়াছি, সুতরাং ডিজিটাল আইন থাকবে।#

Digital Security Act: (1) If any person or group intentionally or knowingly with the aim of hurting religious sentiments or values or with the intention to provoke publish or broadcast anything by means of any website or any electronic format which hurts religious sentiment or values then such activity of that person will be considered an offence

(2) If any person commits an offence under sub section (1), the person will be sentenced to a term of imprisonment not exceeding 7 (seven) years and/or fine not exceeding 10 (ten) lac or both.

(3) If any person commits the offence mentioned in sub-section (1) second time or repeatedly, he will be punished with imprisonment not exceeding 10 (ten) years and/or fine not exceeding 20 (twenty) lac taka or both.

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।