শেখ সাদ বীন শরীফ, নড়াইল : নড়াইলের ক্লিনিকগুলো প্রসূতি মায়েদের জন্য মৃত্যু ফাঁদ। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে অপচিকিৎসায় ভুক্তভোগীরা প্রতিকার চেয়ে পাবেন না এই আশংকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপোষ মীমাংশা করেন। বছরের পর বছর ধরে অদক্ষ আর অনুন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা চলছেও অদৃশ্য কারণে ক্লিনিকগুলোর ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেয় না প্রশাসন, ক্ষমতার জোরে পার পেয়ে যান ক্লিনিক মালিকেরা।

নড়াইল শহরের ভওয়াখালী গ্রামের খন্দকার মাহফুজনুর। সন্তান সম্ভাবা স্ত্রী ঝুমাকে গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর ভর্তি করেন শহরের ইমন ক্লিনিকে। অপারেশনে বাচ্চা প্রসবের পর থেকে রোগীর যন্ত্রনা শুরু হয়, এরপর প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে বের হতে থাকে রক্ত ধারা। এই অবস্থায় চিকিৎসা না দিয়েই জোর করে ক্লিনিক থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়।

২৪ ডিসেম্বর আল্ট্রাাসনো করে পেটের ভিতরে জমাট বাধা রক্ত দেখা যায়। স্ত্রীকে বাচাতে খুলনার একটিক্লিনিকেনিয়ে গেলেজানতেপারেনঝুমার পেটেরভিতরেপচনধরায়জরায়ু, প্রস্রাবের নালী কেটে ফেলতে হবে। জরুরী ভিত্তিতে ২য় দফা অপারেশন করা হয় ঝুমার। কয়েক দফায় ৪ লক্ষ টাকা খরচ করলেও স্ত্রী ঝুমা রয়েছেন আশংকাজনক অবস্থায়। প্রতিকার চেয়ে ক্লিনিকের দুই মালিক আর চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ২৫ জানুয়ারী আদালতে মামলা করেছেন।

ডিসেম্বর মাসে ইমন ক্লিনিকে ভওয়াখালির মৌসুমী খানম এর সিজার অপারেশনের ৫ দিন পর সেলাই কাটতে গিয়ে দেখা গেল কোন সেলাই লাগেনি। সন্তান প্রসবের পর তার তলপেটে যন্ত্রনা বাড়তে থাকে। ক্লিনিকে অভিযোগ জানালে ক্লিনিকের লোকেরা এসে কয়েক ডোজ ব্যাথার ইনজেকশন দিয়ে পরে আবার কেটে তলপেট সেলাই করেন।

স্বামী তিতাসের অভিযোগ, ইমন ক্লিনিকসহ অনেক ক্লিনিকে কমদামী সুতা ব্যবহার হয়, কোথাও ডাক্তার নাই এমনকি নার্সও নাই, সম্পূর্ণ খামখেয়ালীতে চলছে চিকিৎসা।

ইমন ক্লিনিকে মা হতে এসে আরো করুণ অবস্থা হয়েছে দিঘলিয়ার সুজয় ঘোষের স্ত্রী সুপ্রিতী ঘোষের। অপারেশন হবার পরে তার শরীরে ইনজেকশন পুশ করে একজন আয়া, যে ইনজেকশন ধীরে ধীরে অর্ধেক অ্যাম্পুল শরীরে পুশ করার কথা আয়া ঐ ইনজেকশন পুরোটাই একবারে শরীরে পুশ করেন। এতে সুপ্রিতী ঘোষের মুখে ফেনা উঠে মরমর অবস্থা হলে জরুরীভাবে তাকে খুলনার একটি বেসরকারী হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর ধীরে ধীরে সুস্থ্য হলেও আশংকা কাটেনি ঐ নারীর।

সুজয় ঘোষের অভিযোগ, ইমন ক্লিনিকে কোন ডিপ্লোমা নার্স নেই, আয়ারাই নার্স। ক্লিনিক মালিকের স্ত্রী নার্স না হয়েও অপারেশন থিয়েটারে থাকেন।পারিবারিক সব কাজই চলে অপারেশন থিয়েটারে। নিজেদের ডিসপেন্সারী থেকে ঔষধ বিক্রি আর রোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করলেও এখানে সেবার বদলে বাজে চিকিৎসা পাওয়া যায়।

৩ বছর আগে একই রকমভাবে ইমন ক্লিনিকে মা হতে এসে আজো যন্ত্রনায় ভুগছেন চাচুড়ি গ্রামের ৩০ বছরের সুমনা বেগম।

সরেজমিন ইমন ক্লিনিকে ঘুরে কোন প্রশিক্ষিত নার্স পাওয়া গেল না, কয়েকজন আয়াকে নার্স সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ক্লিনিক মালিকের স্ত্রী শিল্পি বেগম দ্রুত প্রতিবেদকের সাথে কথাবলতে ছুটে আসেন। অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে পর্দা দিয়ে আড়াল করে অন্যান্য আসবাবপত্র রাখা হয়েছে। প্রত্যেকটি রোগীর প্রেসক্রিপশনে ২০/২২ টি করে ঔষধ লেখা আছে। কয়েক মাস হলো বেসরকারী একটি কলেজ থেকে সদ্য পাশ করা একজন আবাসিক চিকিৎসক থাকলেও তার রুমের সামনে কোন নেম প্লেট দেখা গেল না। মালিক সরোয়ার হোসেন এরপরই নীচ থেকে দোতলায় আসেন। কিছুটা হম্বিতম্বি করার চেষ্টা করলেও পরে থেমে যান। কয়েকজন সাংবাদিককে ফোন করেন ক্লিনিকে আসার জন্য।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বললেন, রাত হলে ক্লিনিকের ৪ তলায় নারী এবং অন্য আসর বসে।

অপারেশ থিয়েটারে নিজের সবসময় থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, আমাদের ক্লিনিক তো তাই রোগীর ভাল মন্দ দেখার জন্য ক্লিনিকে থাকি। অভিযোগ আছে অপারেশন চলাকালীন শিশু সন্তানকে তিনি অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে ভাতও খাওয়ান, যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

আবাসিক চিকিৎসক ডা. সপ্নীল আকাশ চিকিৎসার নানা সমস্যা বিষয়ে নিজেদের দায় স্বীকার করে বললেন, সব সময়তো এ ধরনের ঘটনা ঘটে না এটা অনেকটাই অনাকাংক্ষিত।

ক্লিনিক মালিক সরোয়ার হোসেন একটিমাত্র ভুল চিকিৎসার কথা স্বীকার করলেও বাকিগুলো রোগীদের উপর দায় চাপিয়ে বলেন, রোগীরা অচেতনভাবে চলাফেরার কারণে ভোগে, আবার প্রেসার বেড়েও অসুস্থ্য হতে পারে। এ সবই নির্ভর করে উপরওয়ালার উপর।

ডিভাইন ক্লিনিক মালিক ডা. শামীম আক্তার বলেন, একটি ক্লিনিকে সার্বক্ষনিক চিকিৎসক এবং নার্স আব্যশক থাকতে হবে। কোন কোন ক্লিনিকের চিকিৎসার গাফিলতির জন্য আমাদের সব ক্লিনিকের যেমন দুর্নামহয় তেমনি প্রসূতি মায়েরা দীর্ঘ রোগে ভোগেন।

বেসরকারী ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এসেনিয়েশসের সাধারণ সম্পাদক এসএম সাজ্জাদ রহমান বলেন, আমরা নিয়মিত মাসিক মিটিং করি, ক্লিনিকগুলোর কোন দুর্বলতা থাকলে সেগুলো সংশোধনের জন্য বলাহ য়।

শুধু ইমন ক্লিনিকই নয়, নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে চলা মর্ডান সার্জিক্যাল ক্লিনিক, লোহাগড়া রমা সার্জিক্যাল ক্লিনিক, আল ইসলামিয়া ক্লিনিক, মোর্শেদা ক্লিনিক, মিজানুর নার্সিং হোম। ক্লিনিকের নিয়ম না মানা কালিয়ার, কালিয়া সার্জিক্যাল ক্লিনিক।

এছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক ক্লিনিক আর বড়দিয়ার হাজী খান রওশন আলী হাসপাতাল লাইসেন্স ছাড়াই গত ৩ বছর ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, জেলায় বর্তমানে ৬০টি ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার এর বেশিরভাগই লাইসেন্স হালনাগাদ নাই। ৪টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স প্রক্রিয়াধীন, ৯টি লাইসেন্সবিহীন ডায়াগনষ্টিক সেন্টার বহাল তবিয়তে চালু রয়েছে। এই অবস্থায় নতুন আরো ৪টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স এর জন্য আবেদন করেছে।

(এস/এসপি/মার্চ ০৩, ২০২১)