নওগাঁ প্রতিনিধি : নওগাঁর মান্দা উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়নের বড়বেলালদহ গ্রামের গৃহিণী বিলকিস খাতুন। সখের বসে তিনি ৫শ’ টাকায় কিনেছিলেন বায়োচার উৎপাদনের কৃষি বন্ধু চুলা। শুরুর দিকে এলাকার গ্রুপের সদস্য হয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। পেয়েছিলেন বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজির বীজ। আগ্রহ নিয়ে বায়োচার উৎপাদন করে ব্যবহার করেছেন ফসলের জমিতে। অবশিষ্ট বয়োচার বিক্রি করেছেন মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিসিডিবির কাছে। 

গৃহিণী বিলকিস বলেন, তাদের জমিজমা নেই। বসতভিটার উঠান কৃষিতে সামান্য বায়োচার ব্যবহারের পর অবশিষ্ট ‘চার’ দীর্ঘদিন ধরে পড়ে রয়েছে তাদের দলনেত্রী আনজুয়ারা বিবির বাড়িতে। সিসিডিবি ১৫ টাকা কেজিতে কিনে নেয়ার আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন নেই। এ চুলায় সব মাপের জ্বালানী ব্যবহার করা যায় না। যে ধরণের খড়ি ব্যবহার করতে হয় সেটিও বিরক্তিকর বলে দাবী করেন বিলকিস। এসব কারণে চুলার ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। একই গ্রামের গৃহিণী শাহানা বিবিও চুলার ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন দীর্ঘদিন।

শুধু বিলকিস খাতুন আর শাহানা বিবিই নয়, বড়বেলালদহ বায়োচার ভিলেজের ৩২ জন গৃহিণী এখন আর কৃষি বন্ধু চুলা ব্যবহার করছেন না। একইভাবে বন্ধ রয়েছে শামুকখোল পল্লীর ২০টি চুলা। অন্য গ্রামের গৃহিণীরাও তাদের কৃষি বন্ধু চুলায় আগুন জ্বালেনি দীর্ঘদিন।

গৃহবধূ শাহিদা খানম জানান, চুলায় উৎপাদিত কয়লা গুড়া করার জন্য মেশিন দিতে চেয়েছিল সিসিডিবি। এজন্য প্রতি কেজি কয়লার বিপরীতে নেয়া হয়েছে ২ টাকা ৫০ পয়সা করে। কিন্তু বড়পই গ্রামে একটি মেশিন পাঠানো হলেও তা অকেজো হয়ে পড়েছে কয়েকদিনের মধ্যেই। এরপর থেকে তাদের উৎপাদিত কয়লা বস্তায় ভরে ফেলে রাখা হয়েছে। সিসিডিবি’র মিথ্যা আশ্বাসে তারা হতাশ ও হতোদ্ভম হয়ে পড়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক গৃহিণী জানান, চুলা ব্যবহারের জন্য সবসময় চাপ দিয়ে আসছে সিসিডিবি’র লোকজন। ব্যবহার না করলে চুলা তুলে নিয়ে যাবারও হুমকি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু নিজেদের টাকায় কেনা চুলা কীভাবে সিসিডিবি তুলে নিয়ে যাবে তা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেন তারা।

গৃহিণীরা এও অভিযোগ করেন, তাদের উৎপাদিত বায়োচার ১৫ টাকা কেজি দরে কিনে সিসিডিবি কৃষকের কাছে ৩৫ টাকায় বিক্রি করে। এতে মধ্যসত্বভোগী সিসিডিবি দ্বিগুনেরও বেশি টাকা বাণিজ্য করে, কিন্তু তারা ঘাম-শ্রমের মূল্যটুকুও পান না। প্রতি কেজি কয়লা গুড়ো করার নামেও তাদের কাছে নেয়া হয় আরো আড়াই টাকা। সবমিলে প্রতি কেজি বায়োচারের মূল্য পান তারা সাড়ে ১৩ টাকা। তার ওপর আবার উৎপাদিত কয়লা ঠিকমতো কিনে না সিসিডিবি। অথচ তাগিদের পর তাগিদ কয়লা বানাও, না হলে তুলে নিয়ে যাবো চুলা। গৃহিণীরা বলছেন, তারা নীলচাষীদের মতো অসহায় আর সিসিডিবি খানিকটা নীলকরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মান্দা উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিজয়পুর ও কামারকুড়ি, কুসুম্বা ইউনিয়নের বড়বেলালদহ, শামুকখোল ও হাজী গোবিন্দপুর, নুরুল্লাবাদ ইউনিয়নের জোতবাজার, কালিকাপুর ইউনিয়নের চকমানিক এবং প্রসাদপুর গ্রামে ১৩২ টি চুলা সরবরাহ করা হয়। আইসিসিও এবং কার্ক ইন এক্টাই এর সহায়তায় ডিএইকে সঙ্গে নিয়ে বেসরকারি সংস্থা সিসিডিবি মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

প্রকল্প শুরুর দিকে উল্লেখিত গ্রামের কৃষকরা সামান্য পরিমাণ জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে বায়োচার ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করেন। এখন তাদের উদ্যম আর নেই। তবে চলতি রবি মৌসুমে উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়নের হাজী গোবিন্দপুর গ্রামের মতিউর রহমান, ময়নুল ইসলাম, আজাহার হোসেন, আব্দুর রাজ্জাকসহ কয়েকজন কৃষক তাদের সবজি ফসলের সামান্য জমিতে বায়োচার ব্যবহার করেছেন।

কৃষকরা জানান, প্রতি এক শতক জমিতে অন্তত: ৫ কেজি বায়োচার ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে আসছে সংস্থাটি। গৃহিনীদের নিকট থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে কিনে গুড়ার পর কৃষকের কাছে তা বিক্রি করা হচ্ছে ৩৫ টাকা কেজি। এতে এক বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে খরচ পড়বে অন্তত: ৬ হাজার টাকা। অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় জমিতে বায়োচার ব্যবহারের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তারা।

সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, ২০১৬ সালে দিনাজপুরের দাউদপুর, মানিকগঞ্জের শিবালয় ও নওগাঁর মান্দা উপজেলায় পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে বায়োচার উৎপাদনের কাজ শুরু করা হয়। ইতোমধ্যে দিরাজপুরের দাউদপুরে এ প্রজেক্টের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধের দ্বারপ্রান্তে মান্দা উপজেলার কার্যক্রম।

তবে কৃষি বন্ধু চুলা ব্যবহার বন্ধের অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন সিসিডিবির বায়োচার প্রজেক্টের সমন্বয়কারী সমীরণ বিশ্বাস। তিনি বলেন, কিছুকিছু চুলা দু’এক বেলা ব্যবহার হচ্ছে। ব্যবহার জনিত কারণে কিছু চুলা নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলো অচিরেই মেরামত করা হবে।

তিনি আরও বলেন, শিঘ্রই ‘বায়োচার ট্রেড সেন্টার’ নামে একটি সেলস্ সেন্টার খোলা হবে। তখন গৃহিনীরা তাদের উৎপাদিত বায়োচার বিপণণ কেন্দ্রে সহজেই বিক্রি করতে পারবেন।

(বিএস/এসপি/মার্চ ০৩, ২০২১)