ঝিনাইদহ প্রতিনিধি : সরকার এমএলএম কোম্পানির লাইসেন্স না দিলেও ঝিনাইদহে ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছে কয়েকটি কোম্পানি।উপাজর্নের লোভে পড়ে এই সমস্ত কোম্পানির প্রতারণার ফাঁদে পা দিচ্ছে বেকার ও শিক্ষার্থী তরুণ-তরুণীরা। এমন এক প্রতারণা মূলক ভুয়া এমএলএম কোম্পানি ওয়ার্ল্ডমিশন ২১ লি. ।

ঝিনাইদহ শহরের হাটের রাস্তায় হামদর্দ মার্কেটে ২০১৯ সালের আগস্ট মাসের দিকে অফিস নেয় ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ লিমিটেড নামের একটি এমএলএম কোম্পানি।এই বিল্ডিংয়ের ৪র্থ তলায় মাসে ৬ হাজার টাকার ভাড়ায় একটি কক্ষ নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কোম্পানি।

রাজবাড়ী জেলা শহরের বাসিন্দা আহসান উল্লাহ আমানের রেফারেন্সে সদস্য হয়ে ঝিনাইদহ সরকারি কেসি কলেজের রসায়ন (অনার্স-২য় বর্ষ) বিভাগের শিক্ষার্থী সাঈদ আনোয়ার এই সেন্টারে কাজ শুরু করে। সাঈদ আনোয়ারের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা জেলা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ এলাকার একটি গ্রামে।

সাঈদ আনোয়ার ঝিনাইদহ সরকারি কেসি কলেজ, এটিআই, সিটি কলেজ সহ ঝিনাইদহের বিভিন্ন এলাকার শতাধীক লোকজন এই এমএল এম কোম্পানির সদস্য করেছে।

সরজমিন দেখা যায় প্রায় ৩০ জনকে সদস্য বানানোর জন্য কনসাল্টেশন দিচ্ছে সাঈদ আনোয়ারের মাধ্যমে সদস্য হওয়া বিভিন্ন সেলস ম্যান।

সাঈদ আনোয়ারের রেফারেন্সে সদস্য হয়েছে চুয়াডাঙ্গার ষড়াবাড়িয়া গ্রামের রাসেল। সে ঝিনাইদহ কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ৬ম সেমিস্টারের ছাত্র। ২০১৯ সালের আগষ্টে সে ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ লিমিটেড’র সদস্য হয়ে এই পর্যন্ত ৫ হাজার টাকা উপার্জন করেছে।

আহসান উল্লাহ আমান জানান, তার কাছ থেকে ঝিনাইদহ জোনে সদস্য রেফারেন্স শুরু।তিনি দাবি করেন তিনি ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট। একটি মাদ্রাসায় চাকরি করতেন।করোনা শুরু হওয়ার পরে সেটি ছেড়ে দিয়ে এখন এই কাজের উপর নির্ভরশীল হয়েই জীবিকা নির্বাহ করছেন। থাকেন ঝিনাইদহ শহরের আদর্শ পাড়ার একটি ভাড়া বাসায়।

মূলত ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ লিমিটেড নামের এই এমএলএম কোম্পানি ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।ডেসটিনি লিমিটেড ২০০০ এর বিরাট দুর্নীতি ও প্রতারণা ধরা পড়লে সরকার এমএলএম আইন প্রণয়ন করে। এই আইন অনুযায়ী ১৬ কোম্পানি লাইসেন্স পেতে সরকেরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট স্টক রেজিস্টার বিভাগে আবেদন করে। ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ সহ ৪ কোম্পানিকে এই সময় লাইসেন্স দিলেও ডেসটিনি,তিয়ানশি বিডি সহ ১২ কোম্পানিকে লাইসেন্স দেয় নি সরকার। পরবর্তীতে ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ লিমিটেড ও মডার্ন হারবাল সহ ৪ কোম্পানির লাইসেন্স রিনিউ করেনি সরকার।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে এমএলএম কোম্পানির নামে এই প্রতারণা ব্যবসা বন্ধ সহ সংশ্লীষ্ঠদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে অভিযান চালিয়েছে।

ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ লি. বায়োনারী ৫০/৫০ ভিত্তিতে কমিশন ভিত্তিক কাজ করে থাকে। লাইসেন্স নেওয়ার শুরুতে ৮ টি পণ্যের উপর লাইসেন্স নিয়েছিল কোম্পানিটি। মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও হ সার্টিফিকেট ও ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছে তারা।

ঝিনাইদহের এই অফিসে গিয়ে দেখা যায় কক্ষের এক পাশে একটি শো-কেচে কিছু হারবাল প্রোডাক্ট রয়েছে।যেগুলোর বেশির ভাগই তাদের কোম্পানির লেবেল লাগানো। তাদের দাবি তারা ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য,আইটি ট্রেনিং সহ বিভিন্ন সেবা ও পণ্য বিক্রি করে সদস্য সংগ্রহ ও সদস্যদের মাধ্যমে ডোর টু ডোর বিক্রি করছে।

ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেন পালোয়ান জানান, তারা বৈধ উপায়ে বিজনেস করছেন। সরকার তাদের লাইসেন্স দিয়েছিল। কিন্তু রিনিউ না করলেও কোর্টের স্টে অর্ডার নিয়ে তারা ব্যবসা করছেন।

তবে তাদের এই পণ্যগুলি কোথায় ম্যানুফ্যাকচার হয় জানতে চাইলে তিনি নির্দিষ্ট করে কিছুই বলতে চাননি। ২০১৬ সালে লাইসেন্স প্রাপ্তির আবেদনের সময় এই কোম্পানি দাবি করে তাদের ৮৮ হাজার সদস্য রয়েছে।

সরকারের সংশ্লীষ্ট বিভাগ এই এমএলএম কোম্পানির বিরুদ্ধে আর্থিক সহ ৪ টি অনিয়ম পায়। যার কারণে সদস্য সংগ্রহ সহ সকল কার্যক্রম স্থগিত করতে বলেন। এমনটিই জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। তবে আরওসি’র বেশির ভাগ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এমএলএম সারা বিশ্বে একটি প্রতারণা পদ্ধতি বলে ইতোমধ্যে স্বীকৃত হয়েছে। বাংলাদেশে এই ব্যবসার অনুমোদন দেওয়া উচিত হয়নি।এটি একটি অবৈধ ব্যবসা। এটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

সকল কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বললেও কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ওয়ার্ল্ডমিশন ২১ লি. । অভিযোগ রয়েছে কিছু হারবাল পণ্য যার উতপাদন খরচ ১৫০ টাকার নিচে সেই পন্য লেবেল লাগিয়ে তার দেড় হাজার থেকে দুই হাজার কোথাও বা পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করছে।

খুব নিম্নমানের ইলেক্ট্রিক পণ্য যা ব্র্যান্ড বিহীন। এমন পণ্য তাদের সেলস ম্যান দিয়ে বিক্রি করছে। বোঝানো হয়চ্ছে সাড়ে পাঁচ হাজার বা সাত হাজার টাকার পণ্য কিনে সদস্য হলে আজীবন উপার্জনের সুযোগ। সে আর কোন কাজ না করলেও তার নিচে তার আইডির রেফারেন্সে পণ্য বিক্রি হলেই অটো কমিশন পাবে সে।

এই প্রতারণার ফাঁদে পা প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন সদস্য। জানাগেছে এই অফিস থেকে প্রতিমাসে লাখ টাকার উপরে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। যা দাম নির্ধারণ থেকে শুরু করে উতপাদন সব আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে। কোথায় এই পণ্য ম্যানুফ্যাকচার হয় তা নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পর্যন্ত।

নতুন করে লাইসেন্স না পেলেও মুজিব বর্ষের লোগো সম্বলিত বিভিন্ন প্রচারপত্র বিলি সহ সদস্য বাড়িয়ে যাচ্ছে তারা।তাদের ৬০ হাজার ৬৮৫ জন সেলস অফিসার থাকলেও কারোরই নিয়োগ পত্র নেই। তাদের সেলস এক্সিকিউটিভ আছে ২৬০৮ জন, মার্কেটিং এসোসিয়েট আছে ২৪৭৬ জন, এসিসট্যান্ট মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ আছে ১০৬৪ জন, মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ আছে ৪৬২ জন, সিনিয়র মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ আছে ২১৪ জন, রিজিয়োনাল মার্কেটিং ম্যানেজার রয়েছে ১১১ জন, এসিসট্যান্ট মার্কেটিং ম্যানেজার রয়েছে ৪৩ জন, ডেপুটি মার্কেটিং ম্যানেজার রয়েছে ২৩ জন, মার্কেটিং ম্যানেজার রয়েছে ৯ জন এবং সিনিয়র মার্কেটিং ম্যানেজার রয়েছে ৬ জন।

তবে এদের কাউকেই কোন নিয়োগ পত্র দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেন পালোয়ান। পণ্য সেলস করতে না পারলে তাদের কোন বেতন বা কমিশন নেই।

ঝিনাইদহ শহরের এক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, তারা আমাদের প্রতারণার মাধ্যমে সদস্য করে। আমি এই বিষয়ে এদের কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলে তারা আমাকে পাত্তায় দেয়নি। তারা যে হারবাল পণ্য বিক্রি করে তার বেশির ভাগই ভুয়া। কোন কাজ হয়না। কিন্তু দাম অনেক বেশি।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ লি. সারাদেশে ৫৪ টা জেলা শহরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও। বর্তমানে তাদের সদস্য সংখ্যা ১১ লাখের বেশি।

এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ঝিনাইদহ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সুচন্দন মণ্ডল জানান, আমরা কোন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পায়নি।তবে আমারা অভিযোগ পেলে খুব দ্রুত ব্যবস্থা নিবো।

(একে/এসপি/মার্চ ০৪, ২০২১)