বগুড়া প্রতিনিধি : বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় আমিনপুরে ১০০ বিঘা জমিতে শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তুলতে বিশেষ ধরণের ধানের চারা (বেগুনী ও সবুজ রঙয়ের) রোপণ করা হয় প্রায় এক মাস আগে। সেই চারাগুলোতে এখন বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি দেখা যাচ্ছে। ধানক্ষেতে ফুটিয়ে তোলা ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’ পরিদর্শন করেছেন গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের প্রতিনিধিদল।

মঙ্গলবার (৯ মার্চ) পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা জানিয়েছেন, শস্যক্ষেতের বিশাল ‘ক্যানভাসে’ ফুটিয়ে তোলা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নান্দনিক প্রতিকৃতিটি বিশ্ব রেকর্ড গড়তে সব শর্ত পূরণ করেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের স্বীকৃতি মিলবে।

গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের পক্ষে এই শস্য চিত্র পরিদর্শন করেন শের-ই বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহাম্মেদ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক এমদাদুল হক চৌধুরী। তারা গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের মনোনীত প্রতিনিধি।

প্রতিনিধিদলের প্রধান অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহাম্মেদ বলেন, ‘‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা স্কেচে তৈরি বঙ্গবন্ধুর ছবির সঙ্গে শতভাগ মিল রয়েছে এবং স্কেচে ব্যবহৃত রঙের সঙ্গেও শতভাগ মিল রয়েছে। শস্যের প্রকারেও ভিন্নতা রয়েছে, নির্দিষ্ট স্থানে সুনিদ্দিষ্টভাবে। ড্রোন থেকে তোলা ছবিও শতভাগ ঠিক আছে।’’

তিনি আরো বলেন, ‘শস্যচিত্রে মূল ইমেজ ৬০ ভাগ আছে কি না, সেই মাপজোখ করতে শেরপুর উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের সার্ভেয়ার দল কাজ করেছে। তারা মাপজোখের প্রতিবেদন দিলে দু-তিন দিনের মধ্যে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ সপ্তাহের মধ্যেই গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের স্বীকৃতি পেতে পারে বাংলাদেশ।’

অধ্যাপক এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের শর্তে বলা হয়েছে, দুটি ভিন্ন রংয়ের শস্যের ব্যবহার থাকতে হবে। এখানে তার পূর্ণতা এসেছে। শস্যের ৪০ ভাগ হবে বেজ, আর ৬০ ভাগ হতে হবে মূল ইমেজ। এই শস্যচিত্রে সেই নিয়ম সঠিকভাবে মেনে চলা হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন দুটি রংয়ের শস্য ব্যবহার করা হয়েছে। শস্যের যে ঘনন্তের কথা উল্লেখ রয়েছে; তাও পরিপূর্ণভাবে মানা হয়েছে। শস্য চিত্রে শস্যের রং প্রাকৃতিক হওয়া আবশ্যিক; আমিনপুর মাঠে সবুজ ও বেগুনি রঙের শস্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে দুই ধরনের শস্যের রঙ-ই প্রাকৃতিক পাওয়া গেছে।

তিনি আরো বলেন, গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের স্বীকৃতি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যা যা দরকার তার সবকটি শর্তই এখানে পরিপূর্ণভাবে মানা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’ ফুটিয়ে তুলে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখানোর উদ্যোগটি ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের’। গত ২৯ জানুয়ারি এই প্রকল্পের চারা রোপণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের’ আহ্বায়ক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক।

গত মঙ্গলবার (৯মার্চ) ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের’ আহ্বায়ক আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রতিনিধিদলের সঙ্গে পরিদর্শনে আসেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’ একটি ভিন্ন ধারার, ভিন্ন মাত্রার অনন্যসাধারণ, নান্দনিক একটি কাজ। এর মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্বজুড়ে অনন্য সম্মানের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এটি হবে সবচেয়ে দুর্দান্ত, সবচেয়ে নান্দনিক ও সবচেয়ে বড় কাজ।

বাহাউদ্দিন নাছিম আরো জানান, শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখানোর মাধ্যমে আমরা বিশ্ববাসীকে জানাতে চাই, বাঙালি বিশ্বাসঘাতক ও অকৃতজ্ঞ নয়। বঙ্গবন্ধু শুধু কৃষক ও বাঙালির নেতা নন, জাতির পিতা। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের স্বীকৃতি অর্জন করে আমরা ইতিহাস গড়তে চাই। বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর কাছে জাগ্রত করতে চাই।

‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের’ সদস্যসচিব এবং ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এস এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত বছরের মার্চ মাস থেকে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’ কর্মসূচির কাজ শুরু করা হয়। বেগুনী ও সবুুজ রঙের ধানগাছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তুলতে চায়না থেকে বেগুনী রঙের ধানের জাত(এফ-১) আমদানি করা হয়েছে। ১০০ বিএনসিসি ক্যাডেটকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এ কাজের জন্য তৈরি করা হয়। ক্রপ মোজাইক ফিল্ড ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে ইতিমধ্যেই ব্রিটেন, জাপান, ভারতের রেকর্ড ভেঙে বর্তমানে চীন অবস্থান করে নিয়েছে। তবে কোনো দেশই শস্যচিত্রে জাতির পিতাকে তুলে ধরতে পারেনি। গিনেস বুকে নাম লেখানোর মাধ্যমে অনন্য ইতিহাস গড়বে বাংলাদেশ।

প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে দেখা যায়, শেরপুর উপজেলার আমিনপুর মাঠে বৃহত্তর আঙ্গিকে শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে। সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিকৃতির আয়তন ৪০০ বাই ৩০০ মিটার। এর বাহিরেও আরো জায়গা রয়েছে এবং গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের সবগুলো নির্দেশনা পরিপূর্ণভাবে মানা হয়েছে।

গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের তথ্য অনুযায়ী, সর্ববৃহৎ শস্যচিত্র ২০১৯ সালে চীনের তৈরি করা। যার আয়তন ছিল ৭৫ বিঘা। ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ার কৃর্তপক্ষের দাবি, বগুড়ায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তুলতে প্রায় ১০০ বিঘা জমি ব্যবহৃত হয়েছে। এটিই একক ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি। চীনের রেকর্ড ভাঙা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’ দেখতে আসছে। সাধারণভাবে এই প্রতিকৃতি দেখা যাচ্ছে না। তবে পাখির মতো উপর থেকে ড্রন ক্যামেরার মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। আয়োজকরা জানান, ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৩০ জন নারী শ্রমিক কাজ করেছেন। তাদের সঙ্গে প্রতিদিন যুক্ত ছিলেন ১৫ থেকে ২০ জন পুরুষ শ্রমিক। তাদের সমন্বয়ে এই কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে।

জানা যায়, এর আগে ১৩ রেজিমেন্টের বিএনসিসির ১০০ জন সদস্য প্রতিকৃতি তৈরি করেছে। একদল শুকনো জমিতে প্রতিকৃতি নির্মাণ করেছে এবং আরেকদল কাঁদা জমিতে লে-আউট তৈরি করেছে। পরে নকশার দায়িত্ব পায় এক্সপ্রেশন লিমিটেড নামে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান। এই ১০০ বিঘা জমি স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি বিঘা জমি ৯ হাজার টাকায় সাত মাসের (নভেম্বর থেকে মে) জন্য ইজারা নেয়া হয়েছে। এই ফসল উঠে গেলে কৃষকরা আবার তাদের জমি ফেরত পাবেন।

(আরআর/এসপি/মার্চ ১০, ২০২১)