মানিক সরকার মানিক, রংপুর : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও জাতীয় পতাকা অবমাননা মামলার অন্যতম বিবাদী তাবিউর রহমান প্রধানকে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ ও সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভিযোগ, সাবেক ভিসি আব্দুল জলিলের সময়ামলে অবৈধভাবে তার নিয়োগ এবং বর্তমান ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ তার সংঘবদ্ধ দুর্নীতির প্রধান সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত তাবিউর রহমান প্রধানকে অনিয়মের মাধ্যমে পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। শুধু তাই নয় অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে কুপ্রস্তাবেরও অভিযোগ রয়েছে। ‘কাছে এসো, ভালবাসো, নম্বর কোন বিষয় না’ একজন শিক্ষকের এমন উক্তি সম্বলিত একটি কুপ্রস্তাবের বিষয় অনেকের হাতে এসেছে বলে জানা গেলেও গণমাধ্যমকর্মীদের হাতে আসেনি। যে কারণে তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে প্রশ্ন উঠেছে ওই তরুণ শিক্ষকের খুঁটির জোর কোথায় ? এদিকে বেরোবির বিভিন্ন অনিয়মের তদন্তকারী ইউজিসির তদন্তদল তাদের তদন্ত শেষে ঢাকা ফিরেছেন।

অভিযোগকারীদের মতে,পতাকা অবমাননা মামলার আসামিকে পদোন্নতি দেয়া হলো। গত বছর মহান বিজয় দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় পতাকা বিকৃত করে অবমাননার ঘটনায় তাবিউর রহমান প্রধানসহ ১৯ শিক্ষক ও কর্মকর্তাসহ অভিযুক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি। তাজহাট থানায় দায়েরকৃত পতাকা অবমাননার একটি মামলায়ও ওই ১৯ জনের সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিলে আদালত তা আমলে নেয়। আসামিরা এখন জামিনে আছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২ ফেব্রুয়ারি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদটি শুন্য হলে অবৈধভাবে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব নেন ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ। পরে ৪ মার্চ অবৈধভাবে প্লানিং কমিটি গঠন করে ডিন ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে একাই সেই কমিটির দুটি সদস্য পদ দখল করেন ভিসি। প্লানিং কমিটির আরেক সদস্য ছিলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম।

অভিযোগ উঠেছে, ভিসি নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ তার মেয়াদের শেষ দিকে এসে তাবিউর রহমান প্রধানকে পুরস্কৃত করতে ৭ মার্চ দুপুরে পদোন্নতি বোর্ড গঠন করে পদোন্নতির জন্য সিন্ডিকেটে সুপারিশ করেন। যেখানে তিন সদস্যের মধ্যে ভিসি একাই দুটি স্বাক্ষর করেন। শুধু তাই নয় একইদিন ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সিন্ডিকেট আহবান করে সেখানে তাবিউর রহমানের পদোন্নতি অনুমোদন করিয়ে নেন ভিসি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী বিভাগের মোট শিক্ষকের এক-তৃতীয়াংশের সমন্বয়ে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্লানিং কমিটি গঠন হওয়ার কথা। আর সে কমিটি কমপক্ষে তিন সদস্যের হওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে আইনে। অর্থাৎ ডীন হিসেবে প্লানিং কামটির সদস্য বা অন্য কোন কারণে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে অন্য বিভাগের কেউ বা প্রশাসনিক ব্যক্তি প্লানিং কমিটির সদস্য হতে পারেন না। কিন্তু উপাচার্য কলিম উল্লাহ শুধুমাত্র তাবিউর রহমানকে অবৈধভাবে পদোন্নতি দিয়ে আইন ভঙ্গ করে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব নেন, অবৈধভাবে প্লানিং কমিটির সদস্য হন এবং তড়িঘড়ি করে বোর্ড গঠন করেন এবং যাবতীয় অনিয়ম বিশেষ সিন্ডিকেট ডেকে অনুমোদন করিয়ে নেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই বিভাগের শিক্ষক ও পতাকা অবমাননা মামলার বাদী মাহামুদুল হক বলেন, নিয়োগ থেকে পদোন্নতি পর্যন্ত তাবিউর রহমান সকল প্রক্রিয়াই অবৈধভাবে হলে শিক্ষক হিসেবে চাকরি করার আর কোন আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি থাকে না। তিনি জানান, এর আগে তাবিউর রহামানের নামে রংপুর কোতয়ালী থানায় পুলিশের করা মামলার কারণে ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫তম সিন্ডিকেট সভায় তার পদোন্নতি স্থগিত করা হয়েছিল। এদিকে কয়েকটি মামলায় জামিনে থাকা অবস্থায় প্রায় এক ডজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত করে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অথচ পতাকা অবমাননা মামলার আসামিকে পদোন্নতি দেয়া হলো।

গত বছর মহান বিজয় দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় পতাকা বিকৃত করে অবমাননার ঘটনায় তাবিউর রহমান প্রধানসহ ১৯ শিক্ষক ও কর্মকর্তাসহ অভিযুক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি। তাজহাট থানায় দায়েরকৃত পতাকা অবমাননার একটি মামলায়ও ওই ১৯ জনের সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিলে আদালত তা আমলে নেয়। আসামিরা এখন জামিনে আছে। ওই কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কলিম উল্লাহকে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কাগজিক সুপারিশ করলেও এখন পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেননি। উল্টো ভিসি অভিযুক্ত শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়েছেন।

তাবিউর রহমানের প্রভাষক পদে নিয়োগেও অবৈধতার অভিযোগ আছে। বাছাইবোর্ড ও সিন্ডিকেটের নথিতে দেখা যায়, ২০১২ সালে ১৩ জানুয়ারি ভিসি প্রফেসর ড. আব্দুল জলিল মিয়ার সময়ের বাছাই বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী মেধা তালিকায় একজন যোগদান না করায় অপেক্ষমান তালিকার প্রথম মাহামুদুল হক-এ যোগদান করার কথা। বাছাই বোর্ডের সুপারিশপত্রে তাবিউর রহমানের নামই ছিল না। পরে কম্পিউটারে প্রিন্টকৃত ১ ও ২ নম্বর সিরিয়ালের পরে ৩ নম্বর সিরিয়াল হাতে-কলমে লিখে অপেক্ষামান তালিকায় তৃতীয় হিসেবে তাবিউর রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত করে ২২তম সিন্ডিকেটে পাস করা হয়।

২৩তম সিন্ডিকেটে তাবিউরের নিয়োগটি বাতিল করা সত্ত্বেও আবার জালিয়াতি করে তার নামটি নিয়োগের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। অথচ বাছাইবোর্ড অনুযায়ী ওই তালিকায় প্রথম মাহামুদুল হকের নিয়োগ পাওয়ার কথা ওই সময় থেকেই। মাহামুদুল হক হাইকোটের রায়ে ১০ মার্চ ২০১৯ ওই বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে পারলেও ওই সময় থেকে নিয়োগ কার্যকর করেননি ভিসির দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে তারিউর রহমান। বরং তাকে বর্তমান ভিসির দুর্নীতিরসহযোগি হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন।

এর আগে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক তাবিউর রহমান প্রধানের ‘অবৈধ ও জালিয়াতির মাধ্যমে’ নিয়োগ বাতিল চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে লিগ্যাল নোটিশ দেয়া হয়। হাইকোর্টের রায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত একই বিভাগের শিক্ষক মাহামুদুল হকের পক্ষে গত বছরের ২ ডিসেম্বও নোটিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, রেজিস্ট্রার এবং ওই বিভাগের বিভাগীয় প্রধানকে পাঠায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ূম। জাতীয় পতাকা অবমাননার মতো এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে অভিযুক্ত ও নিয়োগ নিয়ে তুমুল বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও ওই শিক্ষকের পদোন্নতি দেয়াটা মুক্তিযুদ্ধে নিহত সকল শহীদের সাথে ঠাট্রা-বিদ্রুপ করা ছাড়া কিছুই নয় বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষর্থীরা।

বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও গণিত বিভাগের শিক্ষক মশিউর রহমান বলেন, ভিসি নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার সিন্ডিকেশনের অন্যতম সদস্য তাবিউর রহমান প্রধান। তার নিয়োগটিই তো অবৈধ। তরিঘরি করে অনিয়মের মধ্য দিয়ে জাতীয় পতাকা অবমাননার ফৌজদারি মামলার অন্যতম আসামি এ ব্যক্তির সকল অনিয়মকে ধৃষ্টতা দেখিয়ে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে, যা আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি এবং নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ। অনিয়ম-দুর্নীতির কারিগর ভিসি কলিমউল্লাহর পক্ষেই এরকম পদোন্নতি দেয়া সম্ভব।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবু কালাম মো: ফরিদ উল ইসলাম বলেন, জাতীয় পতাকা অবমাননার মতো একটি স্পর্শকাতর মামলায় জড়িত থাকা এবং নিয়োগ নিয়েও যেখানে বিতর্ক রয়েছে সেখানে ভিসি কিভাবে তাকে পদোন্নতি দিলেন বিষয়টা খতিয়ে দেখা দরকার। সার্বিক বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহর মুঠোফোনে ফোন দেয়া হলে তিনি বলেন, এটি হচ্ছে একাডেমিক ম্যাটার, এটা নিয়ে আমি মন্তব্য করব না। এর পরেই ফোনটি কেটে দেন তিনি।

(এম/এসপি/মার্চ ১৬, ২০২১)