শিতাংশু গুহ


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-র জন্মদিন, এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি’র বাংলাদেশ সফরকে মাথায় রেখে ইসলামী মৌলবাদ ১৭ই মার্চ পরিকল্পিতভাবে সিলেটের শাল্লা, নোয়াগাঁও, দিরাই-এ হিন্দুদের ওপর আক্রমন করেছে। সেতুমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাঁদের ঘটনার জন্যে দু:খপ্রকাশ করে বলেছেন, ঘটনার বিচার হবে। র‍্যাব-এর মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এলাকায় গেছেন এবং বলেছেন, কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা। তাই হয়তো শেষপর্যন্ত ঘটনার একদিন পর মামলা হয়েছে। 

এলাকাটি জনপ্রিয় প্রায়ত সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের। এবার মোমিনুল হকের হেফাজতি বাহিনী সেখানে তান্ডব করেছে। শুধুই কি হেফাজত? ৮৮টি বাড়ী, ৮টি মন্দির ভাংচুর হয়েছে, মহিলাদের শ্লীলতাহানি, লুটতরাজ তো ছিলই। কয়েক হাজার তৌহিদী জনতা এলাকার প্রায় ৫শ’ হিন্দু পরিবারের ওপর চড়াও হয়, তান্ডব চলে কয়েক ঘন্টা। হিন্দুরা আগে টের পেয়েছিলো, তবে পুলিশ টের পায়নি? মিডিয়া জানাচ্ছে, প্রশাসন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি এবং তথাকথিত প্রগতিশীলরা সবাই সবকিছু জানতো, কেউ ব্যবস্থা নেয়নি? দীর্ঘক্ষণ পাঁচ থেকে ত্রিশ হাজার সন্ত্রাসী হিন্দুপাড়ায় তান্ডব চালায়, সবাই ঘুমিয়ে ছিলেন, কারো কোন দায় ছিলোনা?

ঝুমন দাস আপন নামে এক হিন্দু যুবক ফেইসবুকে হেফাজত-ই-ইসলাম নেতা মুমিনুল হকের বিরুদ্ধে এক ষ্ট্যাটাসে লিখে, “মুমিনুল হকের মূল উদ্দেশ্য দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। কিছুদিন আগে তিনি ভাস্কর্য ও মূর্তি নিয়ে উস্কানি দেন--। এরসাথে ছিলো মুমিনুলের ছবি, নিচে লেখা ‘বলদকার বাহিনীর’।” বাংলাদেশে মাদ্রাসায় ছোট্ট শিশুদের বলাৎকার নিয়ে অনেক সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে’-হয়তো ‘বলদকার--’ কথাটি সেই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে? এতেই ক্ষেপেছে হেফাজত! তাঁদের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে! কাজেই ‘ধর হিন্দুদের’।

ঝামেলা এড়াতে হিন্দুরা ১৬মার্চ ওই হিন্দু যুবককে পুলিশের হাতে তুলে দেয়, পুলিশ তাঁকে হাজতে প্রেরণ করে, এরপরও তৌহিদী জনতা ৫/৬টি হিন্দুগ্রামে আক্রমন চালায়। পাঠক, কিছু বোঝা গেলো? মন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, বিচার হবে, কিন্তু শাল্লার ঘটনার বিচার চাহিয়া সরকারকে বিব্রত করতে চাইনা, কারণ আজ পর্যন্ত কোন ঘটনার বিচার হয়নি, ভবিষ্যতে হবে এমন গ্যারান্টি কোথায়? বাংলাদেশের হিন্দুদের স্বার্থ হিন্দুদেরই দেখতে হবে; সংখ্যালঘু’র স্বার্থ সংখ্যালঘুদেরই দেখতে হবে। অতীতে কখনো কোন সরকার হিন্দুর পক্ষে ছিলোনা, এখনো নেই? প্রশাসন হিন্দুদের বিতাড়ন করতে পারলে বাঁচে!

এরপরও বাংলাদেশে অনেকে চমৎকার ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ দেখতে পান? তাদের জানা উচিত ‘হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর বাড়ীঘর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ যদি সম্প্রীতি হয়, ‘গনিমতের মাল’ জোরপূর্বক ধর্মান্তর, ধর্ষণ, যদি সম্প্রীতি হয়, নিশ্চয় তা নিয়ে তাঁরা গর্ব করতে পারেন। বাস্তবতা হচ্ছে, আজকের বাংলাদেশ একটি কট্টর সাম্প্রদায়িক দেশ, পরিস্থিতি পাকিস্তানের মত ভয়াবহ। পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক দেশ, এঁকে চেনা যায়; বাংলাদেশ সম্প্রীতির মুখোশ পরে ‘হিন্দু ও সংখ্যালঘু’ নিধনে নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে যাচ্ছেন। মৌলবাদী শক্তি তা ঠেকাতে চেষ্টা করছে। পুলিশের কর্মকর্তা মুনিরুল ইসলামের বক্তব্য প্রশংসনীয়। বিদেশমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য উৎসাহজনক। আমরা চাই মোদী বাংলাদেশে আসুন, আপনি স্বাগতম। আপনি বঙ্গবন্ধুর মাজারে যান, ওড়াকান্দি যান, সাতক্ষীরা যান, আমাদের অনুরোধ মোদীজি প্লীজ আপনি শাল্লায় যান। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, আপনি আসুন, দেখুন, বাংলার মাটি বা শাল্লায় হিন্দুরা কেমন আছেন? হিন্দুরা চায় দিল্লী কথা বলুক, পশ্চিমবঙ্গ কথা বলুক, মমতা ব্যানার্জী হয়তো বলবেন না, তিনি মোল্লা তোষণে ব্যস্ত, তাই বিজেপি কথা বলুক, দিলীপ ঘোষ কথা বলুক। আর কত! ‘এনাফ ইজ এনাফ’।

হেফাজত নেতারা বলেছেন, তাঁরা এটি ঘটাননি। মাওলানা আতাউল্লাহ বলেছেন, সাধারণ মানুষ ঘটিয়েছে। এথেকে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ কতটা অ-সাম্প্রদায়িক? একজন উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের নাম এসেছে, তিনি আওয়ামী লীগ। সেখানকার তথাকথিত প্রতিশীলরাও তামাশা দেখেছে। ঘটনা হয়তো রামু’র মত, সবাই মিলে হিন্দুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে! এটাই সত্যিকার ‘অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিত্র’। সুনামগঞ্জের ঘটনায যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে তা হচ্ছে, ‘আওয়ামীলীগের ভিতরে হেফাজত নাকি হেফাজতের ভিতরে বাংলাদেশ’?

বাংলাদেশের ভূমিপুত্র হিন্দুর পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সংখ্যালঘুদের বুঝতে হবে, ‘ইসলামপন্থী প্রগতিশীলরা’ তাঁদের জন্যে এগিয়ে আসবে না! সরকার ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ অথবা ‘মৌননীতি’ পালন করবে। হিন্দু বাঁচতে হলে মাটি ধরেই উঠে দাঁড়াতে হবে। হিন্দুরা রাম, কৃষ্ণ বা শিবের পূজা করেন, এদের সবার হাতে অস্ত্র, শুধু হিন্দু নিজে নিরস্ত্র। আক্রমণের ভয়ে পালিয়ে বেড়ায়? এটিও বুঝতে হবে, মানুষ কতটা আতঙ্কে থাকলে এমনটা হতে পারে? ‘সারভাইভাল অফ দি ফিটেষ্ট’ বলে একটা কথা আছে, বাঁচতে হলে হিন্দুদের ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’ হাতে নিয়েই বাঁচতে হবে? ‘যদ্দেশে যদাচার’, কথাটা ভুলে গেলে চলবে কেন?

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।