টাঙ্গাইল প্রতিনিধি : টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের শূভল্যা গ্রামে একটি কিশোর গ্যাংয়ের দাপট দিন দিন চরম আকার ধারণ করছে। গত এক বছরে ওই গ্যাংয়ের নির্যাতনের শিকার হয়েছে পাশের ভাতগ্রাম ইউনিয়নের ভাতগ্রাম ও বরাটি গ্রামের প্রায় ডজন খানেক পরিবার। এছাড়া ওই গ্যাংয়ের অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়ে বরাটি গ্রামের যুবতী-কিশোরীদের অভিভাবকরা বাড়িতে না রেখে অন্যত্র পাঠিয়ে পড়ালেখা করাতে বাধ্য হচ্ছেন। 

জানা গেছে, টাঙ্গাইল জেলা সদর ও মির্জাপুর উপজেলা সদরে যাতায়াতে মহাসড়কে উঠতে ভাতগ্রাম ও বরাটি গ্রামের মানুষের শূভল্যা-বরাটি ও ধল্যা-বরাটি সড়ক দুটিই একমাত্র ভরসা। ধল্যা-বরাটি সড়ক দিয়ে শূভল্যা হয়েই উপজেলা সদরে যাতায়াতের সড়ক হওয়ায় তা স্থানীয়রা তুলনামূলকভাবে কম ব্যবহার করে থাকে। ভাতগ্রাম ও বরাটি গ্রামের মানুষজন সাধারণত শূভল্যা-বরাটি সড়কটি যাতায়াতে বেশি ব্যবহার করে থাকে।

সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ভাতগ্রাম ও বরাটি গ্রাম দুটি প্রত্যন্ত এলাকা(রিমুভ এরিয়া) হওয়ায় এবং শূভল্যা গ্রাম হয়ে যাতায়াতের সড়ক থাকায় শূভল্যা দক্ষিণ পাড়ায় প্রায় দুই বছর আগে একটি সংঘবদ্ধ কিশোরগ্যাং গড়ে ওঠে। ওই গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা ১৮-২০জন। তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয়রা হচ্ছেন- স্থানীয় সোহাগ মিয়া(২০), আশিক(২১), মাসুম(২০), শিপলু(১৮), প্রাপ্ত খান(১৯) প্রমুখ।

সরেজমিনে ভাতগ্রাম ও বরাটি গ্রামের অনেকেই জানান, সোহাগ মিয়া, আশিক, মাসুম, শিপলু ও প্রাপ্ত খানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাংয়ের অত্যাচার-নির্যাতনের কথা বলে শেষ করা যাবেনা। ওই গ্যাংয়ের ভয়ে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শূভল্যা গ্রামের ওই কিশোরদের ভয়ে স্থানীয় অভিভাবকরা তাদের স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েদের অন্যত্র আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বা হোস্টেলে রেখে পড়ালেখা করাতে বাধ্য হচ্ছেন। বরাটি ও ভাতগ্রামের বউ-ঝি’রা দিনের আলোতেও তাদের ভয়ে বাড়ির বাইরে বের হয়না। বাইরে বের হলে তাদের নজরে পড়লেই নানা রকম অশ্লীল কথাবার্তা ও ইঙ্গিতের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করে থাকে। সন্ধ্যার সময় যুবতী বা কূলবধূদের কাউকে বাড়ির বাইরে বা সড়কের পাশে পেলেই জোড় করে ধরে নেওয়ার চেষ্টা করে। কেই প্রতিবাদ করতে গেলে হরহামেশাই চড়-থাপ্পর দেয় এবং বাড়াবাড়ি করলে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে থাকে।

সবশেষ মঙ্গলবার (২৩ মার্চ) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওই কিশোরগ্যাংয়ের শিকার হন বরাটি গ্রামের মৃত আওয়াল খানের ছেলে মো. রায়হান খান ও তার স্ত্রী সীমা আক্তার। শূভল্যা-বরাটি নির্মাণাধীন সড়কে বরাটি জামে মসজিদের পাশে একটি মিনিট্রাক ও অটোরিকশার সাইড নেওয়াকে কেন্দ্র করে বাকবিতন্ডা হলে মো. রায়হান খান তাদেরকে থামাতে গেলে মিনিট্রাকের চালক ওই কিশোরগ্যাংকে মোবাইলে খবর দেয়।

খবর পেয়ে কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যরা এসে মো. রায়হান খানের বাড়িতে গিয়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে তাকে মারপিট করে। রায়হানকে বাঁচাতে গেলে তার স্ত্রী সীমা আক্তারকেও বেদম মারপিট করে এবং কানের লতি ছিঁড়ে গহনা ছিনিয়ে নেয়। এ সময় তারা মো. রায়হান খানদের পাঁচটি পরিবারের ৬-৭জনকে পিটিয়ে জখম করে। এ ঘটনায় মো. রায়হান খান বাদি হয়ে কিশোরগ্যাংয়ের ৭ সদস্যকে আসামি করে মির্জাপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।

তারা আরও জানান, গত এক বছরে বরাটি গ্রামের মারুফ খান, রোকন খান, তুষার বিশ্বাস সহ এক ডজনেরও বেশি পরিবার ওই কিশোরগ্যাংয়ের অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

ভাতগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান মো. আজাহারুল ইসলাম জানান, শূভল্যা ও ধল্যা এলাকার ওই কিশোরগ্যাংয়ের অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে নিজভুমে পরবাসীর মত জীবন-ধারণ করছে। তিনি তাদের নিয়ে একাধিকবার গ্রাম্য সালিশে বসার কারণে ওই গ্যাংয়ের অত্যাচারের একজন ভুক্তভোগী। রাস্তা-ঘাটে উত্ত্যক্ত করার কারণে স্থানীয় অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের বাড়িতে রেখে স্কুল-কলেজে পড়াতে পারেনা।

ফতেহপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ জানান, স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন তালুকদারের গ্রাম শূভল্যা। তার দুই ছেলে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। ইতোপূর্বে ইয়াবা সহ পুলিশ তার এক ছেলেকে গ্রেপ্তারও করেছিল। তারা দুই ভাই ওই এলাকায় কিশোরগ্যাং তৈরি করেছে। ওই গ্যাংয়ের মাধ্যমে তারা স্থানীয় পর্যায়ে নানা অপকর্ম করে থাকে। তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবার কারণে তিনি ওই কিশোরগ্যাংয়ের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেন না।

মির্জাপুর থানার এসআই আবুল বাসার জানান, মঙ্গলবার সকালে বাড়িতে চড়াও হয়ে মারপিট, লুটপাট ও ভাংচুরের ঘটনায় মো. রায়হান খান বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। অতীতের কোন ঘটনার বিষয়ে কেউ বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেনি তাই পুলিশ কোন ব্যবস্থা নিতে পারে নাই।

মির্জাপুর থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) মো. রিজাউল হক জানান, শূভল্যায় কোন কিশোরগ্যাং গড়ে ওঠেছে বলে তিনি জানেন না। ভুক্তভোগীরা তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এছাড়া কিশোরগ্যাংয়ের বিষয়েও তিনি খোঁজখবর নিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।

(আরকেপি/এসপি/মার্চ ২৫, ২০২১)