আবীর আহাদ


বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বকে ঢেকে দেয়ার লক্ষ্যেই রাজনৈতিকভাবেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টি করা হয়েছে । এ-জন্যে দায়ী বিভিন্ন সরকারের মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক সংজ্ঞা ও ভুল নির্দেশিকা । এর সুযোগ গ্রহণ করেছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ইউনিয়ন উপজেলা জেলা ও কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল । সুযোগ নিয়েছে বিভিন্ন সময়ের ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী এমপি ও বিভিন্ন পর্যায়ের দলীয় নেতৃবৃন্দ । বর্তমানে নিচ্ছে জামুকা নামক জাদুর কাঠি । অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে, জীবিত প্রায় ষাট/সত্তর হাজার মুক্তিযোদ্ধার বিপরীতে কমবেশি আশি হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সরকারি তালিকায় স্থান পেয়েছে !

এ-কথাগুলো আমি আনুষ্ঠানিকভাবে অনেকবার বলেছি যে, বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তর সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণ করা মোটেই কঠিন নয়, তেমনি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিতাড়ন করা মোটেও দু:সাধ্য নয় । বঙ্গবন্ধুর সেই সংজ্ঞা হলো এমন : "মুক্তিযোদ্ধা হলেন সেই ব্যক্তি যিনি একটি সশস্ত্র সংঘবদ্ধ ফোর্সের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ।" সেই নিরিখে দরকার সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা । সরকার যদি বঙ্গবন্ধুর উক্ত মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক সংজ্ঞা বাস্তবায়নের জন্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিশন গঠন করে, সেই কমিশনের মধ্যে বিচারবিভাগ সশস্ত্রবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধকালীন কমান্ডারদের সম্পৃক্ত করতেন তাহলে মাত্র পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যেই একটি পূর্ণাঙ্গ ও অবিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা তৈরি করা সম্ভব হতো ।

অনেকে বলে থাকেন যে, মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত ও বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্যে যেসব রাজনৈতিক নেতা, তৎকালীন এমএনএ, এমপিএ, কূটনীতিক, স্বাধীনবাংলা বেতারকর্মী, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, খেলোয়াড়, ডাক্তার, নার্স, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারী প্রমুখ বিপুল অবদান রেখেছেন তারাও কি মুক্তিযোদ্ধা নন ? এ-প্রসঙ্গে উদাহরণ দেয়া হয় যে, সামরিক বা সশস্ত্রবাহিনীতে অনেক ধোপা, নাপিত, গোয়েন্দা, কেরানি, প্রকৌশলী, ব্যাণ্ডপার্টি, ডাক্তার, নার্স, পাচক প্রভৃতি থাকেন, তারাও তো সামরিক বা সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য বলে বিবেচিত । তাহলে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ও মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ঐসব অ-সশস্ত্র ব্যক্তিবর্গ মুক্তিযোদ্ধা বলে বিবেচিত হবেন না কেন ?

তাদের জ্ঞাতার্থে বলতে হয়, সামরিক বা সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের মধ্যকার উপরোল্লেখিত ঐসব অ-সশস্ত্র সদস্যদের অবস্থান দেখা গেলেও তারা কিন্তু সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত । প্রয়োজনে তারাও যুদ্ধের মাঠে অস্ত্র নিয়ে নেমে পড়ার যোগ্যতা রাখে । আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ঐসব অ-সশস্ত্র ব্যক্তিবর্গের কোনোই সামরিক প্রশিক্ষণ ছিলো না, ফলে যুদ্ধের রণাঙ্গনে তাদের কোনোই ভূমিকা ছিলো না; তারা ছিলেন নিরাপদ দূরত্বে । অন্যদিকে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের সশস্ত্র সহযোগী রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে মাঠে-ময়দানে খেয়ে-না-খেয়ে জীবন দিয়ে-নিয়ে, মরে-মেরে জীবনপণ যুদ্ধ করেছেন । সুতরাং সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অ-সশস্ত্রদের গলিয়ে ফেলা কোনোভাবেই সমীচীন নয় । মুক্তিযুদ্ধের ঐ অ-সশস্ত্র ব্যক্তিবর্গকে অন্যকোনো অভিধায় অভিষিক্ত করুন তাতে আপত্তি নেই; কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে নয় । ঐতিহাসিক অবদানে যার যা প্রাপ্য মর্যাদা তাকে তাই দেয়ার উদার মানসিকতা থাকতে হবে । অন্যথায় তা হবে ইতিহাস বিকৃতি ।

সরকার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ, বেসামরিক আমলা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী প্রমুখদের এভাবে বিবেচনা করতে হবে যে, মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বে অর্জিত দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে বলেই যারা জীবনে যা কল্পনাও করেননি তারা তাই হয়েছেন, হচ্ছেন ও হতেই থাকবেন । সুতরাং সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অন্য কাউকে সমান্তরাল ভাববেন, অ-মুক্তিযোদ্ধাদের ভারে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অসম্মানিত হবেন, মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভুয়ারাও সমান মর্যাদা লাভ করবেন এবং তা চেয়ে চেয়ে দেখবেন----এটাতো কোনো সভ্য ও বিবেকবানদের কাজ হতে পারে না । তাই জাতীয় ইতিহাসের স্বার্থে অতি দ্রুত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে অ-মুক্তিযোদ্ধাদের বিতাড়ন ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় তথা সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলে জাতীয় দায়িত্ব পালন করবেন, এটাই সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি ।

ইতোমধ্যে সরকারের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ২০১৭ ও ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইয়ের কয়েকটি কার্যক্রম শেষ করেছে । এখন তারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের কাজে হাত দিয়েছে। ১ম পর্ব নামক একটি প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাকে আমরা অন্ধকারের মধ্যে আলোর ছটা আখ্যায়িত করলেও তার মধ্যে নানান জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ভারতীয় তালিকায় নাম রয়েছে----এমন কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম এ তালিকায় না আসায় বিস্ময়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে প্রথম পর্বের তালিকায় ( বিশেষ করে লাল মুক্তিবার্তার মধ্যে বিপুলসংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা) অনেক অমুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশিত হয়েছে বলে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অভিযোগ উঠেছে। এমতাবস্থায় প্রকাশিত তথাকথিত চূড়ান্ত তালিকা বিপুল প্রশ্নভারে জর্জরিত হচ্ছে এবং আলোর ছটাটি আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

আমরা চাই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা। আমরা চাই তাদের সঠিক তালিকা। আমরা চাই, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় যেমন একজনও অমুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারবে না, তেমনি কোনো অবস্থাতেই প্রকৃত একজন মুক্তিযোদ্ধা তালিকা বহির্ভূত থাকবেন না । এ বিষয়টি নিয়ে আমি একাধিকবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি । লাল মুক্তিবার্তা, মুজিবনগর, যুদ্ধাহত ও অন্যান্য তালিকার মধ্যেও বিপুলসংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অস্তিত্ব আছে, এটাও তাঁকে বলেছি । তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে । এরই মধ্যে অনুভব করছি যে, একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ঐসব তালিকা থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে এবং এ ব্যাপারে তারা অনেকখানিই অগ্রসর হয়েছে। আমরা আশা করছি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের এবারের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকাটা আলোর ঝলকানিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। এবং এ প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক জাতীয় মর্যাদা ও ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করে তাঁদের আর্থসামাজিক উন্নত জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।