শিতাংশু গুহ


মন্দিরের ধ্বংসকাহিনী কোথাও লিপিবদ্ধ ছিলোনা, মূলত: মানুষের মুখে মুখে এটি প্রচারিত ছিলো, ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এবিষয়ে গণশুনানীর লক্ষ্যে ‘রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংস ও গণহত্যা কমিশন’ গঠন করে (২৭শে মার্চ?)? ৬-সদস্যের এই কমিশনের সদস্যরা ছিলেন, বিচারপতি কে এম সোবহান, চেয়ারম্যান; প্রফেসর মুনতাসির মামুন, সদস্য; লেখক শাহরিয়ার কবির, সদস্য; সাংবাদিক বাসুদেব ধর, সদস্য সচিব; দ্বীপেন চ্যাটার্জী, সদস্য, এবং চন্দ্রনাথ পোদ্দার, সদস্য। কমিশনের দায়িত্ব ছিলো (এ) ২৭মার্চ ১৯৭১-এ রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমে গণহত্যায় নিহতদের তালিকা প্রস্তুত করা (বি) প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য নিয়ে হতাহত, ভুক্তভুগীদের ওপর অত্যাচার, খুন, ও মন্দির ধ্বংসের বিবরণ সংগ্রহ করা (সি) মন্দির ও আশ্রমের ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরা (ডি) মন্দির ও আশ্রম ধ্বংসের কারণ নির্ণয় বা ভবিষ্যতে মন্দির পুনর্নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রতিনিধিদের মতামত নেয়া এবং (ই) মন্দির ও আশ্রম পুন্:বিনির্মানে ১৯৭২ সল্ থেকে নেয়া উদ্যোগ এবং অন্যান্য আনুসাঙ্গিক বিষয় তুলে ধরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ১৩এপ্রিল ২০০০ থেকে ৫মাসব্যাপী এক গণশুনানীতে প্রায় ১শ’র বেশি মানুষ সাক্ষ্য দেন্। এর চেয়ারম্যান বিচারপতি কে, এম, সোবহান সেপ্টেম্বর ২০০০ সালে একটি প্রাথমিক রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দেন। বিচারপতি সোবহান কমিশন প্রায় ৫০জন ভিকটিমকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ২৬শে মার্চ পাকিস্তান আর্মী সকাল ১১টায় রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমে প্রবেশ করে। তাঁরা এটি ঘেরাও করে রাখে এবং কাউকে বাইরে যেতে দেয়নি। এ সময় মুসলিম লীগ নেতা খাঁজা খয়েরুদ্দিন তাদের সাথে ছিলেন। ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় কার্ফু শুরু হয়, রাত ২টায় সার্চলাইট জ্বালিয়ে শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। এসময় কামান থেকে গোলা ছোড়া হয় এবং মন্দিরে বিস্ফোরক ছোড়া হয়। এতে মন্দিরের পেছনের অংশ ও মূর্তি ধ্বংস হয়। মন্দিরের বাসিন্দারা ভয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে, কিন্তু মিলিটারিরা তাঁদের ধরে লাইন করে দাঁড় করায়। মহিলারা যাঁরা লুকিয়ে ছিলেন, বেয়োনেটের মুখে তাঁদের লাইনে দাঁড় করানো হয়, মহিলা ও শিশুদের একটি লাইন এবং পুরুষদের অন্য একটি ভিন্ন লাইনে দাঁড় করানো হয়। লাইনের সম্মুখে দাঁড় করানো হয় মন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরিকে, তাঁকে দিয়ে জোরপূর্বক ‘কলেমা’ পড়ানো হয় এবং এরপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়। অন্যদের একই কায়দায় এবং ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়। এ হত্যাযজ্ঞ যখন চলছিলো, রমনা কালীবাড়ি তখন আগুনে পুড়ছিলো। এ সময় প্রায় ৮০-১০০জনকে হত্যা করা হয়েছিলো বলে জানা যায়।

প্রথমে পুরুষদের হত্যা করতে দেখে মহিলারা চিৎকার করতে শুরু করলে তাদের বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করা হয়, অনেকে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। হত্যাযজ্ঞ শেষ হলে পাকিস্তানী সৈন্যরা হতাহত সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেয়। অনেককে হত্যা আগে ‘জয়বাংলা’ বলতে বাধ্য করা হয়? মন্দিরের সাথে গরুর ঘরে তখন প্রায় ৫০টি গরু ছিলো, এসব অবলা প্রাণীও রক্ষা পায়নি, এদের পুড়িয়ে মারা হয়! ভোর ৪টার দিকে ‘অপারেশন রমনা’ শেষ হয়, এ দুই ঘন্টা রমনা কালীবাড়িতে আর্ত-চিৎকার, আগুন, মানুষ পোড়া গন্ধ, গুলি, বোমার শব্দে এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। সৈন্যরা কিছু যুবতীকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো, যাওয়ার সময় তাঁরা ওদের সাথে করে নিয়ে যায়! প্রত্যক্ষদর্শীর মতে ওঁরা ১২জন যুবতীকে ধরে নিয়ে যায়, যাদের আর কখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মন্দির পুরোহিতের স্ত্রী সুচেতা গিরি বা জটালি মা ও অন্য কয়েকজন এ হত্যাকান্ড থেকে রেহাই পায়, পরদিন সকালে তাঁরা ভস্মীভূত মন্দির ও নিহত প্রিয়জনকে পেছনে ফেলে পালিয়ে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুন আলী ফকির, শাহবাগ মসজিদের খাদেম, যেটি রমনা কালীমন্দির থেকে বেশি দূরে নয়, জানান, পাকিস্তান আর্মী সবাইকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ এবং ‘লা-ইলাহা-ইল্লাহু’ বলতে বাধ্য করে। লক্ষী রানী বেঁচে যাওয়াদের একজন, তিনি জানান, তাঁর বাবা কিশোর ঠাকুর ২৫শে মার্চ ১৯৭১ মুক্তাগাছা থেকে তাকে দেখতে মন্দিরে আসেন। লক্ষীরাণী স্বামীসহ রমনা মন্দিরে থাকতেন। পাকিস্তানীরা তার বাবাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলী করে হত্যা করে এবং তাঁর লাশ আগুনে নিক্ষেপ করে। দৈনিক ইত্তেফাকের সাব-এডিটর আহসানউল্ল্যাহ জানান, ৩দিন পর রমনা কালীমন্দিরে গিয়ে তিনি মন্দিরের ভেতরে আরো ১০টি লাশ এবং বাইরে ১৪টি আধপোড়া, গলিত লাশ দেখতে পান। কমলা রায় বেঁচে যাওয়া আরো একজন। তিনি জানান, পাকিস্তানী সৈন্যরা মন্দিরের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। ভয়ে মহিলারা সবাই হাতের শাঁখা ও সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেলেন। তিনি বলেন, পুরুষদের মাটিতে ফেলে অত্যাচার করা হয়, অনেকে এমনিতেই আধ্মরা হয়ে যায়, এদের সবাইকে মেরে আগুনে ফেলে দেয়া হয়, এমনকি শিশুদের আগুনে নিক্ষেপ করা হয়!

কমিশন ঐ বীভৎস হত্যাকান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া কেউ থাকলে বা তাঁদের নিকট আত্মীয় কেউ থাকলে তাঁদের নামধাম জমা দেয়ার জন্যে বিশ্বব্যাপী আহবান জানিয়েছিলো, যাতে ভবিষ্যতে কোন স্মৃতিসৌধ নির্মিত হলে ঐসব নাম তাতে স্থান পায়। ডেইলি ষ্টার জানায়, পূজা উদযাপন পরিষদ ২২শে জুন ২০০৬ সালে মন্দিরটি স্থানান্তর না করার জন্যে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বরাবরে একটি স্মারকলিপি দেয়। ইয়াহু নিউজ ২৬ জুন জানায়, মন্দির কমিটি’ র চেয়ারম্যান গয়েশ্বর রায় মন্দিরের জন্যে জমি বরাদ্ধ করার অনুমোদন দেয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানান। তার মতে নির্ধারিত স্থানটি মন্দিরের মূল জায়গার সন্নিকটে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু এটি স্থানান্তর করতে চেয়েছিলেন, কিন্ত হিন্দুরা তা মেনে নেয়নি।

ঢাকা ইউনিভার্সিটি’র অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ ড: মুনতাসির মামুন লিখেছেন, যদিও মন্দিরটি তৈরী হয়েছে হিন্দু কারুকার্য্যের ভিত্তিতে, এর ১২০ ফুট সুউচ্চ ‘শিখর’টি বঙ্গবন্ধু’র ৭ই মার্চ ১৯৭১ ভাষণের ছবিতে বহুলভাবে প্রচারিত হয়েছে। মায়ের ডাক পত্রিকা বলছে, পাকিস্তান আর্মী মন্দিরটি ধ্বংস করেছে, বাংলাদেশ সরকার মন্দিরের জমি একটি ক্লাবকে দিয়েছে (ঢাকা ক্লাব)। ৩১শে জানুয়ারি ১৯৭২ দৈনিক পূর্বদেশ জানায়, পাকিস্তান আর্মী ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ বা মে মাসে প্রথমে পুনরায় রমনা কালিবাড়ীতে হানা দেয়! রমনা কালীবাড়ি ফিরে পেতে ১৯৮৪ সালে এনিয়ে সিভিল কোর্টে মামলা হয়, তবে মামলায় শেষপর্যন্ত কি হয়েছে, তা অজানা।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।