শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী দেওয়ানজী দীঘিটি হারিয়ে যেতে বসেছে। বালু ও মাটি ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ ছাড়াও পাড়ের গাছ কেটে সাবাড় করা হয়েছে। এতে জীব-বৈচিত্র্য বিনষ্টর পাশাপাশি বিপর্যয় নেমে এসেছে পরিবেশের। জনসাধারণের ব্যবহার্য্য এ দীঘিটি একটি প্রভাবশালী মহল গ্রাস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে,পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী,যেকোনো ধরনের জলাধার বা পুকুর ভরাট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং ভরাটকারীর বিরুদ্ধে আইনের ৭ ধারায় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে পরিবেশগত ক্ষতি ও বিধ্বংসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে।বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৬(ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, “আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনো শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না।”

স্থানীয় প্রশাসন বলছে, পুকুরটি সাধারণের ব্যবহার্য্য এবং প্রভাবশালী মহল মাটি ভরাট করে যে স্থাপনা নিমার্ণ করছে, তা বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এনিয়ে আদালতে মামলা’রও আশ্রয় নিয়েছে স্থানীয় এলাকাবাসী।

এ সময় স্থানীয় এলাকাবাসি মো.আফসার আলী সাংবাদিকদের জানান, জনগণের পুকুরে জনসাধারণ মাছ ছেড়ে আসছে। এমাছ মাদ্রাসা, এতিমখানার শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসি ভক্ষণ করে। কেউ ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে যাতে না পারে এজন্য এলাকাবাসি সতর্ক রয়েছে। কিন্তু,তারপরও স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতা,ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এশটি প্রভাবশালী মহল পুকুরটি দলখে আবারো অপতৎপরতা শুরু করেছে। বালু ও মাটি দিয়ে ভরাট করছে পুকুরটি।

তিনি জানান, দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ফক্কাবাদ মৌজার জে.এল.নং-১৪২ এর সি.এস ৬৪৯ খতিয়ানের ২৮২৭ দাগের ৬ দশমিক ৯ একর পুকুরপাড়,২৮২৮ দাগে ৫ দশমিক ৪১ একর পুকুর এবং ২৮২৭/৩০৯৯ দাগে ১ দশমিক ৬ একর ডাঙ্গা রয়েছে। জলভাগ এবং পাড়সহ প্রায় ১১ একর আয়তনের বিশাল আকারের দেওয়ানজী দীঘি। দিনাজপুর বিরল উপজেলার ফরককাবাদ ইউনিয়নে অবস্থিত এই পুকুর পাড়ের অধিকাংশ গাছ কেটে বেশকিছু জলভাগ অংশ বালু ও মাটি দিয়ে ভরাট করায় পরিবেশ বির্পযয়সহ পানি সংকটের আশংকা করছে এলাকাবাসী। এলাকার জহিরুল ইসলাম,নূরুল ইসলাম, স্বপন চন্দ্র শীলসহ অনেকের অভিযোগ একটি প্রভাবশালী মহল তা অত্মসাৎ করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।ইতিমধ্যে পুকুর পাড়ে গড়ে উঠেছে বেশকিছু দালান বাড়ি ও স্থাপনা।

সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পুকুরে নেই আগের সেই বৈচিত্র্যতা। বদলে গেছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। নেই দেশি মাছ, শামুক, শাপলা-পদ্মসহ নানান প্রজাতিরর জলজ উদ্ভিদ।

স্থানীয় আমিরুল ইসলাম, আব্দুল গফ্ফার ও মেহেরাব আলী জানান,আগে প্রতিবছর শীতকাল এলেই নানা রং-বেরঙের নাম জানা, অজানা পাখি’র সমাগম ঘটতো দেওয়ানজী দীঘিতে। অতিথি পাখি’র বিচরণের চোখ ধাঁধানো দৃশ্য মানুষের নজর কাড়তো।পুকুরে ঝাঁকে ঝাঁকে এ পাখিগুলিকে নামতে দেখা যেতো। বর্ণিল সব অতিথি পাখি’র কলতানে মুখরিত হয়ে উঠতো প্রকৃতি ও পরিবেশ। একটি প্রভাবশালী মহলের কড়াল গ্রাসে এখন সব হারিয়ে গেছে। অসংখ্য এলাকাবাসীর এমন অভিযোগ।

স্থানীয় জনসাধারণ তা মানলেও বিট্রিশ আমলে জনসাধানণের জন্য ব্যবহার্য্য উল্লেখ করা নিস্কর বিশাল আকারের এই দেওয়ানজী দীঘি এখন ব্যক্তি মালিকানা’র দাবী উঠেছে। এলাকাবাসি এবং ব্যক্তি মালিকানা দাবীদাররা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। পুকুরে পাল্টা-পাল্টি মাছের পোনা অবমুক্ত এবং মাছ ধরারও প্রতিযোগিতা চলছে। জনসাধারণ মাছ ধরার উৎসবও করেছে। এনিয়ে বিস্তর অভিযোগ মালিকানা দাবিদারদের।

পুকুরের মালিকানা দাবীদার মো.আখতার আলম এবং মো.ফারুক হোসেন জানান, ওই জমির মালিক তার পিতা তমিজ উদ্দিন আহাম্মদ।জমিদার রায়তী স্বত্বে তার পিতার নামে ওই জমি পত্তন দিয়েছে। তারাই ওই জমি ভোগ দখল করে আসছেন।

তবে, তাদের সাথে বার বার যোগাযোগ করা হলেও মালিকানাধীনের স্বপক্ষে দলিলাদি দেখাতে কাল ক্ষেপণ করেছেন তারা। শেষ পর্যন্ত কোন দলিলাদি তারা দেখায়নি।

পুকুরটি সাধারণের ব্যবহার্য্য’ের এবং প্রভাবশালী মহল মাটি ভরাট করে স্থাপনা নিমার্ণ ছাড়াও পুকুরের পানি দূষণ অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসন।

বিরল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিনাত রহমান বলেন,সি.এস রেকর্ডে ওই জমি জনসাধরণের ব্যবহার্য্যের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে তা ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ড হয়েছে। পবরর্তী রেকর্ডে জনসাধরণের ব্যবহার্য্যের কথা উল্লেখের জন্য আমরা ভূমি কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত ভাবে জানিয়েছি।

দিনাজপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিনিয়র কেমিস্ট এ.কে.এম.ছামিউল আলম কুরসি জানান,২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা এক আদেশে বলা হয়, পাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, জনগণের আশ্রয়স্থল রক্ষা ও অগ্নিনির্বাপণে সহায়তা করতে কোনো অবস্থায় খাল-বিল, পুকুর-নালাসহ প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট করা যাবে না এবং এর গতিপথ পরিবর্তন করা যাবে না। তবে কোনো দপ্তর যদি সরকারি কাজে নিজস্ব পুকুর ভরাট করতে চায়, সে ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পুকুর ভরাটের একটি প্রস্তাব পাঠাতে হবে। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ এর ৮ ও ১২ ধারার বিধানমতে, কোনো ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করলে ৫ বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে অথবা উভয়দন্ডে দন্ডনীয় হবে।

তিনি জানান, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ৬ (ঙ) অনুযায়ী,জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি এমনকি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর ভরাট না করার বিধান রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাধার বা পুকুর ভরাট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং ভরাটকারীর বিরুদ্ধে আইনের ৭ ধারায় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে পরিবেশগত ক্ষতি ও বিধ্বংসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে।

জীব-বৈচিত্র্য এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এই ঐতিহ্যবাহী দেওয়ানজী দীঘি দূষণ ও দখলমুক্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের যেমন দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন জনসচেতনার,এমনটাই তাগিদ দিচ্ছেন পরিবেশবিদরা।

(এস/এসপি/এপ্রিল ১৫, ২০২১)