স্টাফ রিপোর্টার : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে রিমান্ডে থাকা হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক মামুনুল হকের চতুর্থ বিয়ের বিষয়েও কিছু তথ্য মিলেছে। এছাড়া মামুনুলসহ হেফাজত নেতাদের পরিচালিত মাদরাসাগুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাবে ব্যাপক গরমিল পাওয়া গেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে।

গত ১৮ এপ্রিল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসা থেকে মামুনুল হককে গ্রেফতার করা হয়। ১৯ এপ্রিল তাকে একটি মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবসহ বিভিন্ন ঘটনায় ১৭টি মামলা রয়েছে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে। এছাড়া স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরবিরোধী আন্দোলনের সময় সহিংসতার মূলহোতা হিসেবেও মামুনুলের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।

তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, রিমান্ডে মামুনুলকে মামলা সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন করা হলেও ঘুরে-ফিরে আসছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ঘিরে নাশকতাসহ বেশ কয়েকটি সহিংসতার ঘটনা। এসব বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাকে। সাত দিনের রিমান্ডের তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) জিজ্ঞাসাবাদে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন তিনি।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মামুনুলকে পুলিশের একাধিক ইউনিট বিভিন্ন মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। রিমান্ডে আনার পর মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তবে তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রসঙ্গক্রমে ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চে হেফাজতের নাশকতার বিষয়টি উঠে আসে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা রিমান্ডে তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘সরকারের শীর্ষ মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ে সমালোচনা করছেন, তাদের ‘জুতাপেটা’ করার ঘোষণা দিয়েছেন। সেকথাগুলো ওয়াজ মাহফিলে বলে এবং বিভ্রান্তিকর বার্তা দিয়ে কওমি মাদরাসার কোমলতি শিশুদের আক্রমণাত্মক করেছেন। এই ঘটনার দায় তো আপনি এড়াতে পারেন না। আপনার উসকানিতে নাশকতাগুলো হয়েছে’। জবাবে মামুনুল হক বলেন, ‘যেহেতু আমি নেতা, আমি তো দায় এড়াতে পারিই না’।

সূত্র জানায়, রিমান্ডে মামুনুলের কাছে তার পারিবারিক জীবন, শিক্ষকতাসহ নানা বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। পুলিশের সব প্রশ্নে অকপটে উত্তর দিয়েছেন মামুনুল। কোনো প্রশ্ন তাকে দুইবার জিজ্ঞেস করতে হয়নি।

গোয়েন্দা সংস্থার একটি ইউনিট জানায়, দীর্ঘদিন ধরে তারা মামুনুল হকের বিষয়ে ছায়া তদন্ত করছে। তদন্তে তারা মামুনুলের ‘চতুর্থ বিয়ে’র বিষয়ে ‘কিছু তথ্য’ পেয়েছে। তবে সে বিষয়ে এখনই সরাসরি বক্তব্য দিতে চাইছে না তারা।

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে সরাসরি কিছু না বললেও তদন্তের বিষয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. হারুন-অর-রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, সাধারণ মানুষকে উসকানি, সরকারকে বিদায় করা, মন্ত্রীদের কটূক্তি করার বিষয়গুলো নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। এছাড়া এসব কাজে তাকে (মামুনুল) দেশ বা দেশের বাইরে থেকে কেউ প্যাট্রোনাইজ (পৃষ্ঠপোষকতা) করছে কি-না, অর্থ দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান বানানোর প্রচেষ্টা হচ্ছে কি-না, সবকিছুই আমাদের তদন্তে আসবে।

মাদরাসা পরিচালনায় আয়-ব্যয়ে অনিয়ম

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, মামুনুল হকসহ হেফাজতের ইসলামের শীর্ষ নেতাদের পরিচালিত কওমি মাদরাসায় ব্যাপক অনিয়ম পেয়েছে তদন্ত দল।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, হেফাজতে ইসলামে খেলাফতে মজলিসের বেশ কিছু নেতা রয়েছেন। এই দুই দলের নেতারা নিজেদের মধ্যে মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্ব ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন খেলাফতে মজলিসের আমির আল্লামা আজিজুল হক। তিনি বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসার দায়িত্ব নেন। তবে আদালত যখন মাদরাসাটির জন্য একটি স্বতন্ত্র বোর্ড করতে বলেন এবং এটি নিশ্চিত করতে একজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করেন, তখন আজিজুল হক মাদরাসাটি পরিচালনার দায়িত্ব দেন তার ছেলে মামুনুল হককে।

সূত্র জানায়, মামুনুলসহ হেফাজতের নেতারা এভাবে যাত্রাবাড়ী, বারিধারা, লালবাগের বেশ কয়েকটি মাদরাসা পরিচালনা করছেন। এসব মাদরাসার আয়-ব্যয়ে ব্যাপক গরমিল পাওয়া গেছে। এসব মাদরাসায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে যেসব অনুদান এসেছে, সেগুলোর বিস্তারিত তথ্যাদিও নেই। পাশাপাশি মাদরাসাগুলো অবৈধভাবে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ নিয়ে বছরের পর বছর বিল পরিশোধ না করেই পরিচালনা করা হচ্ছে। শক্ত প্রমাণাদি পেলে এসব বিষয়েও মামলা করবে পুলিশ।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২৬ মার্চ বাংলাদেশে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার এ সফরের বিরোধিতায় বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করে হেফাজত। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে বিক্ষোভ থেকে সহিংসতাও হয়। পরে এর জেরে হরতাল ডাকে হেফাজত। এসব সহিংসতায় বেশ কিছু প্রাণ ঝরে।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে রয়েল রিসোর্টে এক নারীর সঙ্গে অবস্থানকালে অবরুদ্ধ হন মামুনুল হক। ওইদিন তিনি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানান, সঙ্গে থাকা নারী তার দ্বিতীয় স্ত্রী। যদিও পরে তার দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

অবরুদ্ধ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই হেফাজত নেতারা ওই রিসোর্টে লাঠিসোটা নিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর ও নাশকতা চালিয়ে মামুনুলকে নিয়ে যান।

পুলিশের ওপর হামলা ও রিসোর্টে ভাঙচুরের অভিযোগে ওই ঘটনায় একাধিক মামলা হয়, যেখানে মামুনুলকে আসামি করা হয়।

পরে মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা এক সাধারণ ডায়েরিতে (জিডিতে) মামুনুলের তৃতীয় বিয়ের খবর পাওয়া যায়।

(ওএস/এসপি/এপ্রিল ২২, ২০২১)