স্টাফ রিপোর্টার : মৌলভীবাজারে কথিত টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনাটি ছিলো নিখুত এক সাজানো নাটক। পুলিশি তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় পুলিশ রিপন দেব নামে এক যুবককে আটক করে থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাঁর কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেড়িয়ে আসে। আটক রিপন দেবকে মিথ্যা ছিনতাই ঘটনা সাজানোর দায়ে পরদিন বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।

গত বুধবার (২১ এপ্রিল) মৌলভীবাজার শহরের কুসুমবাগ এলাকা থেকে ব্যবসায়ী রিপন দেব নাথ’র কাছ থেকে ছুরিকাঘাত করে চার লক্ষ টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যায় বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে রীতিমত তোলপাড় সৃষ্টি হয় মৌলভীবাজার শহরজুড়ে।

ঘটনার পর রিপন জানিয়েছিল ওই দিন সকাল ১১ টার দিকে শহরের কুসুমবাগ এলাকা থেকে সে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে। সেখানে রিপন জানায়, তার মালিকানাধিন সমশেরগঞ্জ বাজারে অবস্থিত রেডিএন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন ক্রয় করার জন্য মৌলভীবাজার শহরের কুসুমবাগ শপিং সিটিতে অবস্থিত সিটি ব্যাংকে চার লক্ষ টাকা জমা দিতে যান। হঠাৎ একটি মোটরসাইকেলে ছিনতাইকারিরা এসে তার হাতে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করে তাঁর হাতে রাখা টাকার ব্যাগটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

উপরোক্ত ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে ঘটনার পর থেকেই বেশ তৎপর হয়ে উঠে মৌলভীবাজার মডেল থানা পুলিশ। কথিত ছিনতাই ঘটনায় রিপন দেব নাথ (২৮) নামের ওই তরুণকে থানায় নিয়ে সত্যতা যাচাইয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে পুলিশ। আর তাতেই বেড়িয়ে আসে থলের বিড়াল,উন্মোচন হয় মিথ্যা ছিনতাই নাটকের। ঘটনার স্পট থেকে হাসপাতালের বেড আর রিপটনের হাতের বেন্ডিজ সব মিলিয়ে নিখুঁত এক নতুন অভিনয়ের মাধ্যমে সাজানো ছিনতাই নাটক রীতিমত পুলিশকে করেছে হতভাগ।

গত বুধবার রাত ১১ টার দিকে মৌলভীবাজার মডেল থানা পুলিশ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর উপস্থিতিতে কথিত ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তিকে সরাসরি উপস্থিত করান। এসময় পুরো ঘটনাটি সাজানো নাটক ছিলো তাও সাংবাদিকদের সামনে স্বীকার করেন রিপন দেব নাথ।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রিপন দেব নাথ এর দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী চার লক্ষ টাকা নিয়ে আসার স্থান, যোগাযোগ মাধ্যম সহ ঘটনাস্থলে টাকাসহ নেমে ব্যাংকে যাওয়ার বিষয় গুলো পুলিশ প্রতিটি বিষয়ে সরজমিনে যাচাই-বাচাই করলে তার দেওয়া বক্তব্যে যথেষ্ট গড়মিল পায়।

পরবর্তীতে মৌলভীবাজার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াছিনুল হকের নির্দেশে পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) মোঃ মশিউর রহমান এর নেতৃত্বে রিপন দেব এর বক্তব্য পর্যালোচনা করে জানা যায়, রিপন দেবনাথ বিভিন্ন পাওনাদারদের ঋন পরিশোধের কথা বললেও তা পরিশোধ না করতে পেরে ফয়সল মনছুর নামের এক ব্যক্তির পাওনা ৬ লক্ষ টাকা পরিশোধের তারিখ ওই দিন ২১ এপ্রিল ধার্য্য করে। রিপন দেবনাথ পাওনাদার ফয়ছল মনছুরকে বারবার টাকা ফেরৎ দেওয়ার বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে টাকা প্রদানে আশ্বাস দিয়ে শহরে আসে।

এক পর্যায়ে টাকা সংগ্রহ না করে কসুমবাগ এলাকায় চার লক্ষ টাকা ছিনতাইয়ের অভিনব পন্থা অবলম্বন করে এই মিথ্যা ছিনতাইয়ের ঘটনা সাজিয়ে নিজেই তার হাত কেটে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদেও রিপন দেব নাথ স্বীকার করে নেয় পুরো ঘটনাটি ছিল তার সাজানো।

জিজ্ঞাসাবাদে রিপন আরও জানায়,সে গত এক বছর পুর্বে বারডেম জেনারেল হাসপাতাল-২ ঢাকায় ডিপ্লোমা মেডিকেল ল্যাব টেকনোলজিস্ট হিসাবে মাষ্টার রুলে কর্মরত ছিলেন। এরই মাঝে শ্রীমঙ্গল থানার শমসেরগঞ্জ বাজারে জনৈক ফয়সল মনছুর এর সহিত রেডিয়েন্স ডায়াগনষ্টি সেন্টার ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসা চলাকালীন সময়ে রিপন দেবনাথ বিভিন্ন লোকজনের নিকট হতে ঋনগ্রন্থ হয়। আর এসব কারনেই সে এই ছিনতাইয়ের ঘটনা সাজায়৷

রিপন জানায়,ব্যবসায়ীক কাজে আরেক জায়গা হতে টাকা পাওয়ার কথা ছিল,টাকা না পাওয়ায় আমাকে লজ্জার সম্মুখিন যাতে না হতে হয় সেকারনে আমি দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ি। এর পরই কুসুমবাগ শপিং সিটির রেলিং থেকে স্লিপ খেয়ে পড়ে গিয়ে হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হই। পরবর্তীতে হাসপাতালে গিয়ে হাতে বেন্ডিজ লাগিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা সাজাই। তাতে মূল উদ্দেশ্য ছিলো নিজের কথা এবং সম্মান রক্ষা করা।

মৌলভীবাজার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াছিনুল হক জানান, শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদারে মডেল থানা পুলিশ সার্বক্ষণিক ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মৌলভীবাজারের মত শান্তিপূর্ণ একটি শহরে এমন ঘটনা প্রথমেই আমাদের কাছে সন্দেহ তৈরি হয়, আর এরই প্রেক্ষিতে ভিকটিম রিপন দেব নাথকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রকৃত ঘটনার রহস্য উন্মেচন করতে সক্ষম হই আমরা। তিনি বলেন, মিথ্যা ঘটনা সাজানোর ওই অপরাধে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) মশিউর রহমান বলেন, প্রথমে খবর পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে রিপন দেব এর সাথে ঘটনার বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি,তাতে তার দেয়া তথ্য একেক সময় একেক রকম হওয়ায় তৈরি হয় খানিকটা সন্দেহ। এর পর তার দেয়া তথ্যনুযায়ী ঘটনাস্থল এবং আশেপাশের সড়কের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করেও এর কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য: রিপন দেব নাথ মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ভুজবল গ্রামের নীলমনি দেব নাথের ছেলে।

(একে/এসপি/এপ্রিল ২৩, ২০২১)