শীতাংশু গুহ


পুলিশের ভাষ্যমতে মুনিয়া আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যা মহাপাপ। যিনি আত্মহত্যা করেন, তাঁর প্রতি সহানুভূতি থাকতে পারে, কিন্তু আত্মহননকে সমর্থন করা যায়না। এও সত্য, একজন মানুষ যখন আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাঁর সামনে বাঁচার আর কোন পথ খোলা থাকেনা, চারিদিকে তিনি অন্ধকার দেখেন, তিনি মৃত্যু’র মধ্যে দিয়ে বাঁচতে চান। মুনিয়া সম্ভবত: মরে বেঁচেছেন। আমার সাংবাদিক বন্ধু তাসের মাহমুদ চমৎকারভাবে বলেছেন, “মুনিয়া কাউকে হত্যা করেনি, নিজে মরেছে। আর বসুন্ধরা? ওঁরা এ পর্যন্ত কত মানুষ হত্যা করেছে, এর কি কোন ইয়ত্তা আছে”? এটি ঠিক, বসুন্ধরার জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটি নির্মম, এবং বহু গরিবের অভিশাপে অভিশংসিত। 

মুনিয়া’র মৃত্যু’র পর কিছু মানুষের দরদ উথলিয়া উঠেছে? কারণ কি? কত মুনিয়া এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে, কে খবর রাখে? এর কারণ মুনিয়া নন, বসুন্ধরা। মুমিনুল হক কেচ্ছার পর মুনিয়া। মুমিনুল হক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গেছেন, তিনি ধরা খেয়েছেন। ঝর্ণা উপলক্ষ্য মাত্র। বসুন্ধরার এমডি’র ‘পটেটো ফল্ট’ আছে? কার নাই? এরশাদ চাচারও ছিলো। কথা হচ্ছে, সবাই ধরা খায় না, আনবীর ধরা খেয়েছেন। মুনিয়া’র সাথে ফষ্টিনষ্টি আইনের চোখে অপরাধ নয়? মুনিয়ার মৃত্য তাঁকে বিপদে ফেলেছে। আনবীর কি মুমিনুলের ভাগ্য বরন করবেন, নাকি তাঁর কপালে ‘অন্যকিছু’ ঘটবে?

এ ঘটনায় অনেকে সাংবাদিক, সম্পাদকের ওপর ক্ষ্যাপা। কি লাভ ক্ষ্যাপে? মুনিয়ার মৃত্যু সংবাদ তো মিডিয়াই দিয়েছে, তাই না? নিউইয়র্কে জন্মভূমি সম্পাদক রতন তালুকদার দু’টি মিডিয়ার নাম নিয়ে লিখেছেন, ‘ছিঃ ছিঃ’। সাবেক রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমদ বেশ রাগের সাথেই বলেছেন, বসুন্ধরা গ্রূপের কোন পত্রিকাতেই ‘আনবীরের’ নাম নেই? আরিফ মাহবুব কিন্তু বলেছেন, সাংবাদিকরা সাহসের সাথে এগিয়ে আসতে না পারলে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিন্। কবি ফকির ইলিয়াস লিখেছেন, সাংবাদিক-সম্পাদক ক্রীতদাস হয়ে গেলে, মালিকপক্ষকে দেবতুল্য মনে করাই স্বাভাবিক। ইমরান এইচ সরকার লিখেছেন, বিচার চাই? প্রবীর শিকদার লিখেছেন, মুনিয়ার আত্মহত্যা নিয়ে ওদের আগ্রহ নেই, ওঁরা ব্যস্ত এমডি-কে সুরক্ষা দেয়ায়, তাই মুনিয়ার চরিত্র হনন। সাংবাদিক সাবেদ সাথী আমাকেও কিঞ্চিৎ বাঁশ দিয়েছেন, বেশ ক’টি নাম দিয়ে তিনি লিখেছেন, মুনিয়া ইস্যু: নিউইয়র্কের কথিত সচেতন নাগরিক সমাজ কোথায়?

সাংবাদিক শাহাবুদ্দিন সাগর খবর দিয়েছেন, ‘মুনিয়ার চরিত্র হননের জন্যে নাকি বিগ বাজেট’, প্রবীর শিকদারও একই তথ্য জানিয়েছেন। কিছু নমুনা দেখা যাক, একটি পত্রিকা লিখেছে, ‘পুরুষ শিকার ছিলো মুনিয়ার নেশা ও পেশা’। অন্য একটি পত্রিকা লিখেছে, ‘পোশাকের মত প্রেমিক বদলাতেন মুনিয়া’। আরো আছে, ‘মুনিয়ার চার প্রেমিক’ বা অভিনেতা বাপ্পীর সাথে গভীর প্রেম ছিলো মুনিয়ার। মিডিয়ার এসব শিরোনাম দেখে যেকেউ মানবেন যে, মেয়েটি শুধু সুন্দরী তা নয়, যথেষ্ট স্মার্টও বটে! পুরুষের মাথা খাওয়ার যোগ্যতা তাঁর ছিলো, কেন যে মেয়েটি মরতে গেল কে জানে? সাংবাদিক পুলক ঘটক দেখলাম বেশ উত্তেজিত, তাঁকে বলেছি, বেশি উত্তেজনা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

একদা আমার কলিগ সাংবাদিক সুভাষ চন্দ বাদল একাই সাংবাদিকের পক্ষে মাঠে নেমে পড়েছেন। তিনি লিখেছেন, নিজের আক্রোশ মেটাতে পেশার ক্ষতি করবেন না। সমস্যা হচ্ছে, মানুষ ভুলে যায়, সাংবাদিকরা এই সমাজেরই অংশ, সমাজে পচন ধরলে, সাংবাদিকের একাংশেও পচন ধরে। সাংবাদিকরা পেশাজীবী, চাকুরীজীবি, মালিকের পত্রিকায় চাকুরী করেন। সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে কোন শব্দ নেই, যা আছে সেটি ‘মালিকের স্বাধীনতা’। মালিক যা চান তাই হয়! কোন সাংবাদিকের ঘাঁড়ে কয়টা মাথা যে মালিকের বিরুদ্ধে লিখবেন? এটিও সত্য, একদা সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের সংগ্রামী ভূমিকা ছিলো, এখন নেই! তবে যাঁরা মালিক সম্পাদক, বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল নন এবং ‘রক্তচক্ষু’ উপেক্ষা করতে পারেন, তাঁরা ইচ্ছে থাকলে ‘নির্ভিক’ সাংবাদিক হতে পারেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, মুনিয়া বিচার পাবে কিনা? পাল্টা প্রশ্ন হচ্ছে, কিসের বিচার? আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ায় বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কতজনের বিচার হয়েছে? মুনিয়া এমডি’র ফ্ল্যাটে না মরলে বড়জোর ‘কলেজ ছাত্রীর আত্মহত্যা’ শিরোনামে ছয় লাইনের একটি নিউজ হতো, তাই না? দরদটা কি মুনিয়ার জন্যে? নাকি এমডি’র পক্ষ-বিপক্ষ? যাঁরা সাংবাদিকদের ধোলাই দিচ্ছেন, তাঁরা কি সবাই ‘ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির’? মুনিয়ার আত্মা শান্তিতে থাকুক। সামান্য এক মেয়ে সমাজটাকে একটা ‘অসামান্য’ ধাক্কা দিয়েছে, এটাই বড়কথা। বিচার মুনিয়ার দরকার নেই, বিচার প্রয়োজন সমাজের জন্যে। যে দেশে প্রধান বিচারপতি পালিয়ে জান বাঁচায়, সেদেশে কিসের বিচার আশা করেন?

আনবীর এবং মামুনুল হক ঘটনার বিস্তর ফাঁরাক। মামুনুল হকের ক্ষেত্রে সরকার একটি পক্ষ ছিলো, আনবীর-র ক্ষেত্রে সরকার নিরপেক্ষ থাকতে পারেন, আইন এর নিজস্ব পথে চলতে পারে। মামুনুল হককে ধরার জন্যে প্রশাসন সুযোগ খুঁজছিলেন, আনবীর নিজে এসে জালে ধরা দিয়েছেন। মামুনুল ধর্মান্ধ, রাজাকার, ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন, আনবীর বড়লোকের লম্পট পুত্র। আনবীর-র যত টাকা আছে তা দিয়ে কয়েক হাজার ‘মামুনুল’ কেনা যায় এবং ‘মানি টকস’। শেষ পর্যন্ত এই ঘটনা কোন দিকে মোড় নেবে কেজানে, তবে শিগগিরই নুতন কোন ঘটনা এসে মুনিয়া কাহিনী চাপা দিয়ে দেবে তা বলা বাহুল্য। তাই, মুনিয়ার জন্যে কেঁদে লাভ নেই, ‘চাচা আপন বাঁচা’। মুনিয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলে যাঁরা সোচ্চার হয়েছেন, মুনিয়া অ-মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হলে কি তাঁরা সোচ্চার হতেন না? ফিরোজা শুক্লা একটি ছবি দিয়ে প্রশ্ন করেছেন, ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেন একজন মহিলাকে কটূক্তি করে জেল খেটেছেন, যেসব নারীনেত্রী তখন সোচ্চার ছিলেন, মুনিয়া’র ক্ষেত্রে তারা চুপ কেন?

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।