আবীর আহাদ


সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা অর্থনৈতিক দর্শনের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন । সেটা হলো "Money is no problem" । সেই থেকে এ অর্থনৈতিক দর্শনটি কালে কালে জনপ্রিয়তা পেয়ে গোটা দেশ ও জাতিকে নাচিয়ে দিয়ে আসছে । সবাই এখন সেটাকেই জীবনদর্শনের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হিশেবে গণ্য করছে ।

মূলত: জেনারেল জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকার একটি অপকৌশলের আশ্রয়ে এধরনের একটি অর্থনৈতিক প্রথা চালু করেছিলেন । তাঁর এ অপদর্শন চালু হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি সেই প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার সাথে জড়িত অনেক উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিক মন্ত্রী এমপি আমলা ব্যবসায়ী ঠিকাদার প্রকৌশলী শিল্পপতিসহ সরকারের আত্মীয়-স্বজন সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট করে শত শত হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে । তাদের কাছে টাকা আসলেই কোনো সমস্যা নয় । টাকা দিন পদপদবী নিন ! অবাধ লুটপাট করুন এবং জায়গা মতো ভাগ দিয়ে আসুন । কমিশন দিন, নিরাপত্তা নিন ! গিভ এণ্ড টেক । এই দেয়া-নেয়ার ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের লুটপাটের অর্থনীতি । এমনই অঢেল টাকা যা দেশের মধ্যে রাখার জায়গা না-থাকাতে বিরাট অংশ নানান অনৈতিক পন্থায় সুইস ব্যাংক, পানামা ব্যাঙ্কসহ আমেরিকা কানাডা দুবাই ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া মালায়েশিয়া সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য দেশে পাচার করে সেসব দেশের ব্যাঙ্ক ও ব্যবসায় বিনিয়োগ করছে ।

কারা এসব অবৈধ অর্থের মালিকসহ পাচারের সাথে জড়িত তাদের খবর অবশ্যই সরকারের নখদর্পণে রয়েছে । তাছাড়া বিগত কিছুকাল পূর্বে সুইস ও পানামার ব্যাঙ্কে কাদের অর্থ রয়েছে সে-বিষয়ে পানামা পেপার্স নামক মিডিয়ায় খবরও প্রকাশিত হয়েছে । সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও দুদক এসবের খবর অবশ্যই জানে । বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে এ যাবতকালের মধ্যে ১৪/১৫ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে । এসব অর্থে লণ্ডন, দুবাই, কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশের বিভিন্ন বড়ো বড়ো শহরে বাঙালি/বেগমপল্লীও গড়ে উঠেছে । অনেক লুটেরা আছে, যারা বিদেশে স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের রাজকীয় জীবন যাপনে রেখে নিজে একলা দেশের মাটিতেও রাজকীয় জীবনযাপন করছে এবং লুটপাট করে চলেছে । এসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের কার্যকলাপ দেখে মনে হয়, তারা বাংলাদেশকে একটি নিরানদ লুটপাটের ক্ষেত্র ও অভয়ারণ্য বলে গণ্য করে ।

আসলেই বাংলাদেশ এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে, যে যেখানে অর্থের বিনিময়ে পদপদবী লাভ করে সে সেখান থেকে শত শত কোটি টাকা কামাই করে ! চরম অসৎ উপায়ে এমনতর অর্থ লুটপাট করলেও তারা ধরাছোঁয়ার উর্দ্ধে থেকেই যায় ! এমন এক অর্থলিপ্সুতায় বাংলাদেশ অবস্থান করছে যে, দশ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয়মূল্য একশো কোটি----এক কোটি টাকার মালামাল ক্রয়মূল্য দশ কোটি----একটা পাঁচশো টাকার বালিশ ছয় হাজার টাকা, একটা দশ হাজার টাকার নারকোল গাছ নয় লক্ষ টাকা, একটা কম্পিউটার মেরামতে পঁচিশ লক্ষ টাকা, একটা বিশ হাজার টাকার পর্দা পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকা-----এমনিভাবে হাজার হাজার সরকারি ছোট বড় ও মেগা প্রকল্প ও মালামাল ক্রয় খাতের মূল্য শত/হাজার গুণ বাড়তি ব্যয় দেখিয়ে শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে এসবের সাথে জড়িতরা রাতারাতি বিরাট ধনিকে পরিণত হচ্ছে ! যার ফলে সমগ্র বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে অতি দ্রুততম সময়ে ধনিকশ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে । এছাড়া ব্যাঙ্ক ও শেয়ারবাজার লুটসহ অন্যান্য বিভিন্ন খাত থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুটপাট হয়ে যাচ্ছে । এসব বিষয়ে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ।

এসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের লুটপাটের কিছু কিছু খবর প্রকাশিত হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা দুদক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে । অথবা বলা চলে লুটেরাদের সাথে দেয়া নেয়ার ভাগাভাগির প্রক্রিয়ায় সবকিছু ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে ।

বাংলাদেশে এই যে অর্থের অবাধ গতিপ্রকৃতি----সেটাই হলো জেনারেল জিয়াউর রহমানের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক অপদর্শন, যার ওপর নির্ভর করে আমাদের দেশে লুটপাটের অর্থনীতি ও দুর্নীতির অবাধ রাজত্ব গড়ে উঠেছে । আর দু:খজনক সত্য এই যে, এভাবেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সযতনে দূরে সরিয়ে দিয়ে দেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে জেনারেল জিয়াউর রহমানের দর্শন সার্থকভাবে অনুসরণ করে চলেছে । আজ দেশের মধ্যে যে কয়েকটি অপ্রতিরোধ্য লুটেরা মাফিয়াচক্র গড়ে উঠেছে তার উদ্যোক্তা জেনারেল জিয়া-এরশাদ-খালেদা হলেও তা পত্রপল্লবে বিকশিত ও পরিপূর্ণতা পেয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে । এখন এসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়াদের ক্ষমতা এতোটাই বেড়েছে যে, লুটপাট, খুন, ব্যভিচারসহ জঘন্যতম অপরাধ করেও তারা সরকারের নাকের ডগার ওপর দিয়ে আস্ত বিমানে চড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে পারে । এটাই হলো জিয়াই আর্থরাজনীতির সার্থক পরিণতি যা এখন পলে পলে তিলে তিলে বাঙালি মানসের জীবনদর্শনরূপে আবির্ভূত হয়েছে !

লেখক :মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, গবেষক।