আবীর আহাদ


ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোনো প্রয়োজন নেই । কার বিশ্বাস সঠিক, কার বিশ্বাস বেঠিক কিংবা কার ধর্ম সঠিক, কার ধর্ম বেঠিক অথবা কে আস্তিক, কে নাস্তিক ----এসব নির্ণয়ের ভার স্বয়ং আল্লাহর এখতিয়ারে । ধর্ম ব্যবসায়ীরা এসব নিয়ে ব্যবসা ফাঁদতে পারেন, হানাহানি রক্তারক্তি ঘটাতে পারেন, তাতে কোনো মানুষের বা ধর্মের একরত্তি লাভ নেই । বরং ধর্ম সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে একধরনের অনীহা সৃষ্টি হতে বাধ্য । এবং সচেতন মহলে ক্রমান্বয়ে অনীহা সৃষ্টি হয়েছেও ! একটা কথা মনে রাখতে হবে, যেখানেই ধর্মের উগ্রতা, সেখানেই কিন্তু ধর্মের অধ;পতন নিহিত । কারণ ধর্মান্ধতার মধ্যেই বর্বরতা নৃশংসতা পৈশাচিকতা ও পাশবিকতা নিহিত । আবার যে ধর্মীয় সমাজ জবরদস্তি ও ধর্মান্ধতা ছড়ায়, সে সমাজে মানবতা, সহমর্মিতা ও সম্প্রীতি থাকে না । আন্তধর্ম ও অন্যান্য ধর্মের সাথে সেখানে নিত্যনৈমিত্তিক মতবিরোধ সৃষ্টি হয়ে হিংসা বিদ্বেষ হানাহানি ও রক্তপাত ঘটে থাকে । তখন নিরীহ ও সচেতন মানুষের মনে ধর্মের প্রতি একধরনের বিমুখতা সৃষ্টি হয় ।

ফলে ধর্মের স্বাভাবিক গতিও ব্যহত হয় । সম্ভবত: এসব কারণে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : 'যার যার ধর্ম তার তার কাছে', 'ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই' কোন ধর্ম সঠিক,'কোন ধর্ম বেঠিক তা নির্ণয়ের ভার আল্লার ওপর', 'কে আস্তিক কে নাস্তিক তার বিচারের ভার আল্লার ওপর' । আর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য রয়েছে আরেকটি সুরায় । সেটি হলো : 'সেবিবান মেজিয়ান, স্ক্রিফচার, পলিথিস্ট, ইহুদি খৃস্টান মুসলমান----এর বাইরে আর যারা আছে, যারা সৎ কার্য করে, তাদের কোনো ভয় নেই, নিশ্চয়ই তাদের জন্য প্রভূর পক্ষ থেকে পুরস্কার রয়েছে ।'

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের ফসল । বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি । ফলে বাংলাদেশ চলবে এবং চলতে থাকবে সেই আদর্শের ভিত্তিতে । এখানে বহু ধর্মের সহাবস্থান মেনেই সব ধর্মাবলম্বীদের ধর্মচর্চা করতে হবে । তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশের একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক আলেম সমাজ যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার আলবদর আলশামস আলমুজাহিদ বাহিনীর সদস্য হয়ে হানাদার পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে সশস্ত্র ও আদর্শিকভাবে সহযোগিতা করেছিলো তাদের অনেকেই এখনো সেই মতাবলম্বী হয়ে রয়েছে । তারা এখনো বাংলাদেশকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে না । তাদের উত্তরসূরিরাও একইভাবে একই পথে হাঁটছে । তারা কেউবা জামায়াত-শিবির, কেউবা বিএনপি, কেউবা জাতীয় পার্টি, কেউবা হেফাজতে ইসলাম, কেউবা ইসলামী আন্দোলন, কেউবা অন্যান্য ইসলামী নামধারী জঙ্গি সংগঠন করে ।

এদের পাশাপাশি আরেকটি ইসলামী সংগঠন বা সংস্থাকে আমরা দেখছি, তারা অত্যন্ত নিরীহ । তারা হলো আহমদীয়া সম্প্রদায় (কাদিয়ানী)। এই সম্প্রদায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষতার চিন্তাচেতনা ও আদর্শকে ধারণ করেন বলেই আমার মনে হয় । এ-কারণেই সম্ভবত: জামায়াতী, হেফাজতী ও অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিবাদীরা আহমদীয়া সম্প্রদায়কে একটি ঠুনকো অজুহাতে অমুসলিমসহ কাফের বলে ফতোয়া দিয়ে থাকে ।

আমি তো আগেই বলেছি, কে কাফের, কে মুত্তাকি সে-বিচার করবেন স্বয়ং আল্লাহ্ । এ-নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের ধর্মীয় অঙ্গনে কোনো অবস্থাতেই ধর্মীয় কোন্দল ও হানাহানি সৃষ্টির সুযোগ নেই । আমরা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত জনগণ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করি না । পছন্দ করি না বলেই ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত হেফাজত ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ভরাডুবি ঘটে । এ-বিষয়টি অনুধাবন করতে পারলে তাদের জন্য মঙ্গল ।

আর শেষ কথা হলো: ধর্মীয় আবরণে বা সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা করা হলে তাদের জন্য ন্যক্কারজনক পরাজয় অবধারিত । কারণ বাঙালি ধর্মভীরু হলেও ধর্মান্ধ নয় । বাঙালির স্বাভাবিক জীবনাচার, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও জাত্যাভিমান ধরে কেউ টান দিলে , তখন বাঙালি ধর্মের সব বাঁধন ছিঁড়ে ফেলতে এক মিনিটও সময় নেয় না । ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে । সুতরাং ধর্ম দিয়ে নয়, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দিয়েই সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন নির্বাহ করতে হবে । এর ব্যত্যয় ঘটলে ধ্বংস অনিবার্য ।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।