আবীর আহাদ


বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিত্সার্থে 'মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতাল' নামে ঢাকার চিড়িয়াখানা রোডে একটা অত্যাধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করে তা আবার বন্ধ করে দেয়ার রহস্য আমাদের বোধগম্য নয় । সেটি চালু করে জেনারেল হাসপাতালের পাশাপাশি চলমান করোনাকালে বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষের চিকিসাসেবা দেয়া যেতে পারতো । বিশাল জায়গার ওপর নির্মিত এ হাসপাতালটিকে "মুক্তিযোদ্ধা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল" নামে জরুরিভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণের জন্য আমি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি।

দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন ।প্রতিদিন প্রাণঘাতী করোনাসহ অন্যান্য রোগে ৩/৪/৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পরপারে পাড়ি জমাচ্ছেন । তাদের অধিকাংশই আজ নানান রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত । অর্থের অভাবে সুচিকিত্সা করতে পারছেন না । মুবিম মন্ত্রী বাহাদুর সরকারি হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্রি চিকিৎসা দেয়ার নানান গালভরা প্রতিশ্রুতি দিলেও আসলে সরকারি হাসপাতালেও তাদের চিকিত্সা মেলে না । উপরন্তু মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিলে মনে হয় বেশি বেশি অবজ্ঞার শিকার হতে হয় । কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সনদ ছিঁড়ে ফেলাসহ তাদের গায়ে হাত তোলার বহু উদাহরণ ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়ছে । এমনতর অবস্থায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা বলা চলে বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মরছেন । মুক্তিযোদ্ধাদের কী দুর্ভাগ্য যে, তাদেরই শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে তারা অবহেলা অবজ্ঞা অসম্মান ও অনাদরে চিকিৎসা বঞ্চিত অবস্থায় তিলে তিলে স্বাধীনভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন !

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানের সাথে স্বতন্ত্রভাবে চিকিসা সেবাদানের জন্য ঢাকার চিড়িয়াখানা রোডে একটা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে জমি বরাদ্দ দিয়েছিলেন । কিন্তু ৭৫ সালে তাঁর তিরোধানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের হাসপাতাল প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হয়ে যায় । দীর্ঘ কয়েক বছর পর---- রাষ্টপতি হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকার ১৯৯০ সালের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানার সামনে বঙ্গবন্ধু সরকারের বরাদ্দকৃত কয়েক একর জমির ওপর একটি মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্ট হাসপাতাল নির্মাণে হাত দেন । কিন্তু দু:খজনক হলো হাসপাতালটি নির্মাণের পর ৪/৫ বছর পর চালু অবস্থায় বিএনপি সরকার সেটি এক অজ্ঞাত কারণে বন্ধ করে দেয়া হয় । আজ প্রায় ২৫/২৬ বছর হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় পরিত্যক্ত পড়ে আছে ।

চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের করুণ পরিস্থিতির আলোকে দু:খের সাথে বলতে হয়, বিভিন্ন সরকারের অনেকে বুঝি মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রের বোঝা মনে করে তাদের চিকিৎসা সুবিধাটি বন্ধ করে রেখেছেন ! হয়তো তারা দেশের স্বাধীনতা আনায়নকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বে পরশ্রীকাতর হয়ে তাদের দ্রুত মৃত্যু কামনা করেন ! তা যদি না-ই হবে তাহলে দেশের সরকার প্রধানরাও নিশ্চয়ই জানেন যে, তাদের জন্য একটি হাসপাতাল থাকলেও মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসার অভাবে ধুকে ধুকে মরছে ! যখন সরকার প্রধান পদাধিকারবলে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান, বছরে ট্রাস্টের ২/৩ টি সভা তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়, তখন তাদের মস্তিষ্কের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনার বিষয়টি কেনো আসে না----সেটি আমাদের বোধগম্য নয় ।

জানা গেছে, ১০০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতালটি এখন এক ভুতুড়ে অবস্থায় নিপতিত । এখানে রয়েছে সর ধরনের আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম । আছে জরুরি বিভাগ । অপারেশন থ্রিয়েটার । স্টোর রুম । সামনে অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে বিশেষ ধরনের দু'টি অত্যাধুনিক অ্যাম্বুলেন্স । এটি একটি জেনারেল হাসপাতাল । শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, প্রতিদিন শত শত সাধারণ মানুষও এখানে চিকিৎসা পেতো ।

কিন্তু নির্মাণের ৪/৫ বছরের মাথায় মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নির্মিত বিশেষ আধুনিক হাসপাতালটি কেন বন্ধ করা হলো, তা আজো রয়েছে অজানা । মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মালিকানাধীন এ হাসপাতালটির এমন অবস্থা কেনো, তা এখানকার কেউ জানেন না । এতে আমি বিস্মিত হয়েছি ।

কয়েক বছর পূর্বে আমার এক ঘনিষ্ঠ ছোটভাইতুল্য মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব:) যখন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, তখন একদিন তাঁর কাছে আমি এ হাসপাতালটির বিষয়ে জিজ্ঞেস করি । তিনি এ হাসপাতালটির জায়গা-জমি, মালিকানা, পরিচালন পদ্ধতি, ব্যাঙ্ক লোন, মামলা----সব মিলিয়ে বিগত বিএনপি-জামায়াত এটিকে চরম হযবরল অবস্থায় ফেলে রেখে গেছে বলে একগাদা সমস্যা তুলে ধরেন । তিনি এ-বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরবেন বলে জানান । জেনারেল শিকদার প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি পেশ করেছিলেন কিনা তা আর জানা যায়নি । কারণ তিনি ছিলেন একজন চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ।

যেখানে প্রতিদিন চিকিৎসার অভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা মারা যাচ্ছেন, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা পাচ্ছেন না, চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিলে অপমানিত হচ্ছেন, সিট না পেয়ে মেঝেতে শুতে বাধ্য আছেন-----চিকিৎসক ও কর্মচারীদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখলে গালমন্দ করে তা ছিঁড়ে ফেলছেন----অথচ তাদের জন্য নির্মিত অত্যাধুনিক হাসপাতালটি আজ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ভুতুড়ে হয়ে আছে ! হাসপাতালটি নিয়ে যতোই সমস্যা ও ঝামেলা থাকুক, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সেসব সমস্যা ও ঝামেলা কোনো বিষয়ই নয় । দু:খজনক হলো, সবার হাসপাতাল চালু রয়েছে----মুক্তিযোদ্ধাদের হাসপাতাল কেন চালু করা যাবে না ?

চলমান করোনা মহামারীর সময় অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়েও মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটে গিয়ে চিকিৎসা না পেয়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন । মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালটি চালু থাকলে অন্ততঃ কিছু চিকিৎসা তো তারা পেতেন । কিন্তু তাদের জন্য নির্মিত হাসপাতালটি বন্ধ ! এটা যেনো তাদের ভাগ্যের চরম পরিহাস ।

মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে লেগে আছে একটা চক্র । মুক্তিযোদ্ধারা যাতে সমাজে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ সম্মান না পান, চাকরি-বাকরি-ব্যবসা না করতে পারেন, চিকিৎসা সেবা না পান-----তথা মুক্তিযোদ্ধারা মৌলিক মানবাধিকার থেকে যে সেই গোড়া থেকেই বঞ্চিত হয়ে আসছে-----মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালটি যেনো তারই সর্বশেষ নির্মম উদাহরণ । আজ বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত শিবিরের শত শত হাসপাতাল সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে চিকিৎসা দিচ্ছে, করোনার সময় যখন বেশিরভাগ প্রাইভেট হাসপাতাল গুলো বন্ধ ও মানুষকে জিম্মি করে বিশাল ব্যয়বহুল চিকিৎসা দিচ্ছে, সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের হাসপাতাল বন্ধ থাকাতে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হতাশ । তাদের চিকিৎসার সব পথ রুদ্ধ । এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি মুক্তিযোদ্ধারা যাতে চিকিৎসা না পায় এটার অংশ হিসেবেই এ হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে----যাতে তারা চিকিৎসার অভাবে দ্রুত মরণসাগরে পাড়ি জমান ? স্বাধীনতার সুফলভোগীরা বোধ হয় এটাই চান !

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-মরণের এ-সন্ধিক্ষণে তাদের শেষ জীবনে একটু চিকিৎসা সহায়তা প্রাপ্তির লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালটি মেডিকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমি বিশেষ আবেদন জানাচ্ছি । যেহেতু হাসপাতালটি চালু একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, সেহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে মাসিক মুক্তিযোদ্ধা ভাতার সাথে ১০ হাজার টাকা মাসিক চিকিৎসা ভাতা প্রদানের জন্যেও বিশেষ অনুরোধ জানাচ্ছি ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।