আবীর আহাদ


যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যে জোট 'কোয়াড' এ বাংলাদেশের অংশগ্রহণ চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে যথেষ্ট খারাপ করবে বলে মন্তব্য করেছেন চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।

১০ মে সোমবার সকালে ঢাকায় কূটনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ডিক্যাবের সঙ্গে ভার্চুয়াল মতবিনিময়ের সময় ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ঐ মন্তব্য করেন । কোয়াডে অংশগ্রহণের বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, "এ ধরনের ছোট গোষ্ঠী বা ক্লাবে যুক্ত হওয়াটা ভালো না। বাংলাদেশ এতে যুক্ত হলে তা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ করবে।"

গত এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গহি ঢাকা সফর করেন। সেই সফরে কোয়াড নিয়ে যে আলোচনা হয়েছিল সেই প্রসঙ্গে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এই উত্তর দেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে নৌ চলাচল 'অবাধ ও স্বাধীন' রাখার উপায় খোঁজার যুক্তি দেখিয়ে ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যে 'কোয়াড' নামে একটা সংলাপ শুরু হয়েছিল ।

এখন আমাদের বক্তব্য হলো, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র । বাংলাদেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণে কোয়াড জোট বা অন্য কোন জোট বা কোন রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ কী সম্পর্ক রাখবে কি রাখবে না, সেটা বাংলাদেশের নিজস্ব এখতিয়ার। এ ব্যাপারে চীনকে তো নাক গলানোর অধিকার দেয়া হয়নি । চীনের রাষ্ট্রদূতের কথার মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন হুমকি রয়েছে যা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক, বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে আমি এটাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছি না । চীনের রাষ্ট্রদূতকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও পরে তার দেশ কী ভূমিকা নিয়েছিলো তা আমরা ভুলে যাইনি ।

আমরা ভুলে যাইনি । কোনোদিন ভুলবোও না । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ ও বিভীষিকাময় গণহত্যায় নানান অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র দিয়ে হানাদার পাকিস্তানকে সহযোগিতা করেছিলো চীন । শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের পরম বন্ধু ভারতকে বাংলাদেশের পক্ষে বিরত রাখার লক্ষ্যে ভারত সীমান্তে চীন তিন লক্ষ সেনা মোতায়েন করে । কিন্তু ভারতের আন্তর্জাতিক মিত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আরেক অকৃত্রিম বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকিতে চীন পিছুটান দেয় । জাতিসংঘে বারবার সে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন করলে সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেটো প্রয়োগ করে চীনকে নাস্তানাবুদ করেছিলো । এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও জাতিসংঘের তার সদস্য পদের বিপক্ষে বারবার ভেটোপ্রয়োগ করেছিলো সেই চীন । শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর জীবিতকালে সে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশ যাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিসহ সাহায্য ও সহযোগিতা না করে তার জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো সেই চীন । শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু সরকারকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে দেশকে সন্তাসের জনপদে পরিণত করে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিশেবে পরিগণিত করার লক্ষ্যে চৈনিকপন্থী নানান তথাকথিত কমিউনিস্ট ও সর্বহারা পার্টিকে মদত দিয়েছিলো সেই চীন । শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাযজ্ঞের পরই চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিলো ।

শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুবিরোধী জিয়া এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকারকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার অন্তরালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আমলা ব্যবসায়ীদের চাইনিজ পুঁজির বিশাল কমিশন খাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে সেই চীন । বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের অজুহাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কর্তাব্যক্তিদেরও চাইনিজ কমিশনের প্রেমে মজিয়ে দেশের জন্মের সাক্ষাত শত্রু সেই চীন এখন বাংলাদেশের বড় বড় মেগা প্রকল্প, অন্যান্য উন্নয়ন খাতসহ সামরিক খাতে বিপুল বাণিজ্যিক সহযোগিতা দিয়ে চলেছে ।

শুধু তাই নয়, দেশের বড়ো বড়ো প্রকল্পের দরপত্রে কমমূল্যের কার্যাদেশ নিয়ে, কাজ শুরু করার একটি পর্যায়ে কিছুদিন পর বাগড়া দিয়ে বসে যে, ঐ অর্থ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে না ! এ অসৎ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চাইনিজ কোম্পানিগুলো আমাদের দেশের সর্বস্তরের কমিশনখোর কর্তাব্যক্তিদের প্রলুব্ধ করে এভাবে দফায় দফায় বিশাল মূল্যবৃদ্ধি করে থাকে । পদ্মাসেতুসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের মধ্যে এ প্রাকটিস বিদ্যমান । শুধু তাই নয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার লক্ষ্যে তথাকথিত সমুদ্র বন্দরের সুযোগ নিতে গিয়ে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীকে উস্কানি দিয়ে প্রায় পনের লক্ষ আরাকানী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ভেতর পাঠিয়ে আমাদের দেশের রাজনৈতিক আর্থমাজিক পরিবেশ ও নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক এক চাপ সৃষ্টি করেছে সেই চীন । এর মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগর ও ভারত সাগরে চীন তার সামরিক উপস্থিতি জানান দিয়েছে ।

শুধু তাই নয়, এই সেই চীন, যে তথাকথিত ঋণ ও সাহায্য-সহযোগিতার অন্তরালে বিশেষ করে তার আন্তর্জাতিক সামরিক কৌশলের অংশ হিশেবে সে ইতোমধ্যে পাকিস্তান, মায়ানমার, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাকে তো বটেই---হালে ইরানকে তার কক্ষপুটে বন্দী করার চক্রান্ত করছে । বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও সামরিক খাতে চীন এযাবত অত্যন্ত গোপনে তার রাজনৈতিক মিশন বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে এখন সে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের নানাবিধ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে । বাংলাদেশকে তার তথাকথিত শত্রুকে মোকাবিলা করার অজুহাত দেখিয়ে চীন এখানে তাদের বিপুল পরিমাণের রদ্দিমার্কা সামরিক মারণাস্ত্র দিয়ে বাংলাদেশকে সাজিয়ে তুলছে । জিয়া এরশাদ ও খালেদা জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ সরকার চৈনিক ট্যাবলেট গিলে নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার প্রক্সি দিচ্ছে ! প্রকাশ্যে বলা না হলেও, বাংলাদেশের ইমিডিয়েট শত্রু হিশেবে ভারত ও মায়ানমারকে চিহ্নিত করা হচ্ছে ।

মুক্তিযুদ্ধের রক্তের বন্ধু ভারত আমাদের শত্রু----এটা কি ভাবা যায় ? মিয়ানমার হতে পারে । কারণ একাত্তরে সেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করেছে । মিয়ানমার এখন আর কোনো স্বাধীন দেশ নয় । তার রাজনীতি অর্থনীতি সমরনীতি সবকিছুই চীন দ্বারা পরিচালিত । চীন যদি আমাদেরকে মায়ানমারের জুজুর ভয় দেখিয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে চীনই প্রকারান্তরে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে । তাইতো সে ভারত ও মায়ানমারকে বাংলাদেশের শত্রু গণ্য করিয়ে তার গুদামজাতকৃত রদ্দি সমরাস্ত্র আমাদেরকে কিনতে বাধ্য করছে । শুধু এশিয়া নয়, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বাজার এখন চীনের দখলে । অচিরেই দেখা যাবে পাকিস্তান নেপাল মায়ানমার শ্রীলঙ্কা ইরান হয়ে চীনের ঋণগ্রহীতা অনেকগুলো আফ্রিকান দেশকে চীন তার সামরিক বলয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে সেসব দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরণ করে ফেলবে ।

বাংলাদেশকে অনেক আগেই সে তার গ্রীবে নিয়ে নিতে পারতো, কিন্তু ভারতের পেটের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান থাকায় সে তার অভিলাষ পূরণ করতে পারেনি । আর পারেনি বলেই এদেশের কমিশন খাওয়া লুটেরা শাসকগোষ্ঠীর মাধ্যমে সীমাহীন বাণিজ্যের অবাধ সুযোগ লাভ করে বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশের বাজার দখল করে নিয়েছে । এর পাশাপাশি কিছু অপ্রয়োজনীয় সামরিক মারণাস্ত্র দিয়ে বাংলাদেশকে সজ্জিত করেছে । এর ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের কিছটা মাথাব্যথা হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই । কারণ মায়ানমার আমাদের দেশকে ঠুনকো ও দুর্বল ভেবে চীনের মদদে তার পনের লক্ষ্য শরণার্থীকে বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে । তাতে বাংলাদেশের সামরিক হাত কুচকে গেলো ! তাহলে বাংলাদেশের পরবর্তী শত্রু কে ?

বাংলাদেশে ভারতের একজন সাবেক হাইকমিশনার যার সাথে আমার একটা ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো, তিনি ঢাকায় এক আলোচনা সভা শেষে আমাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশ আর্থসামাজিক ও সামরিক খাতে স্বনির্ভর থাকুক, এটা ভারত কামনা করে । কিন্তু উভয় দেশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির পরিবেশ সৃষ্টি করে নয় । মনে রাখবেন, আপনাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রায় চোদ্দ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছেন । বাংলাদেশের সাথে ভারতের রক্ত ও নাড়ির সম্পর্ক । এ সম্পর্ক চিড় ধরলে কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না-----

চীন যে তথাকথিত দু'টি পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনসহ কিছু ফ্রিগেট বাংলাদেশের শত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশের কাছে সস্তামূল্যে প্রদান করেছে, সে ব্যবহারের কোনো ব্যবস্থা তো দেখা যাচ্ছে না । মায়ানমার চীনের প্ররোচনায় জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়ে জোর করে তার দেশের যে পনের লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে মিয়ানমার বাংলাদেশের চরম শত্রু হিশেবে আবির্ভূত হলো, সেখানে মায়ানমার সামরিক বাহিনীকে একটু ভয় দেখানোর জন্যে হলেও বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ডুবিয়ে রাখা সেই অত্যাধুনিক সাবমেরিন ও ফ্রিগেটগুলো একটু মাথা উঁচু করে তো সাগরের মধ্যে সাঁতার কাটতে পারতো । বারবার মায়ানমার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করার পরেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটু জবাবও দেয়া হলো । তাহলে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ আর কার বিরুদ্ধে চীনপ্রদত্ত মারণাস্ত্র ব্যবহার করবে ? ভারতের বিরুদ্ধে ? এছাড়া বাংলাদেশের সীমান্তে আর কোনো শত্রু দেশ নেই যে, সে ঐ অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে ?

এবার তিস্তা সম্পর্কে আসি । তিস্তার জল ভাগাভাগি নিয়ে বহুকাল যাবত বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে একটি টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে । বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে অভিন্ন সীমান্তে কিছু কিছু অমীমাংসিত বিষয় থাকাই স্বাভাবিক । তেমনি বাংলাদেশের সাথেও ভারতের সিটমহল বিনিময়, ফারাক্কা সমস্যার সমাধান, সমুদ্রসীমা, সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম বন্ধসহ বন্দী বিনিময়, অন্যান্য আরো বহুপুরনো সমস্যার সমাধানে হচ্ছে । তিস্তা নিয়ে উভয় দেশের জলপ্রবাহ সংক্রান্ত সমস্যার কারণে এ সমস্যাটা একটা রাজনৈতিক ইস্যু হিশেবে আত্মপ্রকাশ করেছে । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি যেমন বিএনপি জামায়াত হেফাজতে, চৈনিক সমর্থিত কিছু রাজনৈতিক দল, এসব দলের পক্ষে অবস্থান নেয়া বুদ্ধিজীবী ও প্রচারমাধ্যমসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তি তিস্তা সমস্যা নিয়ে দু'দেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে বিষয়টা তাতিয়ে তুলেছেন । ইতিমধ্যে ভারত-বন্ধু আওয়ামী লীগের মধে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চেতনার মেরুকরণ শুরু হওয়াতে তাদের মধ্যে একধরনের ভারতবিরোধিতার জাগরণ ঘটায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনায় সিক্ত ক্ষমতাসীন বিজেপি ও অপরাপর হিন্দুত্ববাদী জঙ্গিরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানারকম অশালীন ও অসৌজ্ন্যমূলক বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে চলেছেন ।

অতীতে বহুবার এধরনের ঘটনা ঘটলেও দু'দেশের সরকার অত্যন্ত বিজ্ঞতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন । কিন্তু বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ যখন বাণিজ্য ও চৈনিকদের অন্যান্য সুবিধাদি দিতে গিয়ে প্রকাশ্যে তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষপটে দু'দুদেশের অভিন্ন শত্রু চীনকে প্রাধান্য দেয়ার নামে ভারতে অবহেলা করছে বলে ভারতীয়দের মনে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে । ঠিক এই ধরনের একটি উতপ্ত সময় চীন বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছে । যে বিষয়টি দু"টি দেশের মধ্যকার সমস্যা, সেটিকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান নিশ্চয়ই সুদূরপরাহত নয় । আমাদের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদি যে যার অন্ধ অহমিকা ও বাণিজ্যিক লাভালাভের বিষয়গুলো পরিহার করে দু'দেশের মানুষের মানবিক দিকগুলো তুলে ধরেন, তাহলে নিশ্চয়ই সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারে ।

আমি তিস্তা বা জলবিষয়ক কোনো কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি নই । দেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা ও সচেতন নাগরিক হিশেবে আমার দেশপ্রেমময় হৃদয়ে চীনের প্রস্তবিত প্রকল্পের মধ্যে যতোটা না বাণিজ্যিক লাভালাভের বিষয় রয়েছে, তার অন্তরালে চীনের এ প্রকল্পের মধ্যে যে বিশাল ভূমি তথা গ্রাম নগর শহর ও পরিবেশগত অবকাঠামোর অপচয় হবে, তা কীভাবে উপসম হবে ? তিস্তার মধ্যে নদী খনন, নদীশাসন, লক্ষ লক্ষ লোককে পুনর্বাসন এমনতর বিপুল সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে ? এরপর আছে ভারতের তরফ থেকে প্রতিক্রিয়া । এ সময় ভারত যদি কাউন্টার পদক্ষেপ হিশেবে তার ভূমিতে একাধিক বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানি এককভাবে প্রত্যাহার করে সেই জল বিকল্প নদী বা খাল খনন করে জলের প্রবাহ সেদিকে প্রবাহিত করে,তখন বাংলাদেশ কী করতে পারবে ? এ অবস্থার প্রকল্পটি মাঠেই মারা যাবে, অথচ আমরা চীনের ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে থাকবো ! এছাড়া তিস্তা প্রকল্পের ভূমি ও পুঁজির নিরাপত্তা বিধানের নামে যদি চীন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের পেটের মধ্যে কোনো দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিপুল সামারিক লোকবল ও মারণাস্ত্রের সমাবেশ ঘটায়, তখন কি আমাদের দেশের ভারতবিরোধী অপশক্তি ও ক্ষমতাসীন বাণিজ্যক আওয়ামী লীগ কি উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে ? পারবে না । এ অবস্থায় তিস্তাকে কেন্দ্র করে ভারত-চীনের চাপাচাপিতে বাংলাদেশের ভাগ্য কী ঘটবে, সেটা অবশ্য আমার জানা নেই ।

সুতরাং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে, আমার জাতিরাষ্ট্রের জন্মের শত্রু চীনকে আমরা বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে বরদাস্ত করতে পারি না । মুক্তিযুদ্ধের রক্তের বন্ধু ভারতের সাথে আমরা বড়ো-ছোটভাই হিশেবে প্রয়োজনে তাদের সাথে ছোটোখাটো লাঠালাঠি করবো । তারপর আলোচনার টেবিলে বসে উভয় পক্ষ কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও সমস্যার সমাধান করবো । কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দু'বন্ধুর মধ্যকার দ্বন্দ্বে মুক্তিযুদ্ধের জন্মের শত্রু চীনকে নাক গলাবার সুযোগ দেয়া যাবে না । না----

লেখক :মুক্তিযোদ্ধা লেখক গবেষক, চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।