আবীর আহাদ


বঙ্গবন্ধুর নির্মম মৃত্যুর ছ'বছর পর ১৯৮১ সালের ১৭মে শেখ হাসিনা ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন । তখন তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সভাপতি । মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জেনারেল জিয়া সরকারের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে তিনি দেশের মাটিতে পদার্পণ করেই অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে দলের হাল ধরলেন । তারপর অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে নানান রাজনৈতিক মেরুকরণের পথ পরিক্রমায় তিনি আজ দেশের প্রধান রাজনৈতিক নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত এবং একনাগাড়ে বহু বছর ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন । রাজনীতিক ও শাসক হিশেবে শেখ হাসিনার সার্বিক কর্মকাণ্ডের চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণের সময় এখনো আসেনি । তারপরও তাঁর রাজনৈতিক ও রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে একটা যৎকিঞ্চিত মূল্যায়ন করা যেতে পারে ।

ব্যক্তিগত সততা, মেধা, সাহস ও দেশপ্রেমে শেখ হাসিনা অনন্য তাতে কোনোই সন্দেহ নেই । এসব গুণাবলি তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন তাঁর মহান পিতা বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে । কিন্তু দীর্ঘ রাজনৈতিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকেও দলীয় ও সরকার প্রধান হিশেবে দলে ও সরকারে কাকে কোথায় রাখতে হবে, কোথায় কাকে আনতে হবে, কাকে এমপি উপদেষ্টা ও মন্ত্রী করতে হবে, কাকে পাশে রাখতে হবে, কাকে দল ও ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে হবে—-এসব ব্যাপারে তিনি আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে পারেননি । কোনো ব্যক্তির সততা মেধা ত্যাগ ও দেশপ্রেমকে মূল্যায়ন না করে সেই ব্যক্তির প্রতি তাঁর অন্ধস্নেহ এবং তাঁর প্রতি সেই ব্যক্তির আনুগত্যের বিষয়টিকে তিনি বেশি প্রাধান্য দেন বলে মনে হয় । তাঁর এ সরল বিশ্বাসে এ-প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থীসহ দুর্নীতিবাজ-লুটেরারা তাঁর দল ও সরকারে ঢুকে পড়ে । এ ব্যতীত আওয়ামী লীগ দলের ভেতর ও বাইরের শুভানুধ্যায়ী মহলেও যে বহু সৎ মেধাবী ও ত্যাগী মানুষ রয়েছেন, এসব বিষয়ে তিনি ভেবে দেখেন বলে মনে হয় না !

বিশেষ করে যাদের দিয়ে তিনি সরকারের মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টামণ্ডলী সাজিয়েছেন, তাদের অনেকেই তাদের পদের যোগ্যই নন । তারা অনেকেই নানাভাবে সমালোচিত ও বিতর্কিত । তারা মানসিকভাবে দুর্বল । এ-সুযোগে ধুরন্ধর আমলাতন্ত্র তাদের ‘আসল’ চরিত্র নিয়ে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে নিয়েছে । এ অবস্থায় তিনিও তাঁর মনোনীত জনপ্রতিনিধি, দলীয় নেতা ও এমপিদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছেন বলেই মহামারী করোনাকালীন ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় তাদের বাদ দিয়ে আমলাদের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন, যা দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিকদের প্রতি এক অশনি সংকেত !

ক্ষমতাসীন দল ও সরকার, বিশেষ করে কিছু মন্ত্রী ও উপদেষ্টার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমলারা সরকারি বিশাল বিশাল উন্নয়ন প্রকল্প ও কেনাকাটায় আকাশচুম্বি বাড়তি ব্যয়মূল্য দেখিয়ে বিভিন্ন খাত থেকে শতসহস্র কোটি টাকা লুটপাটের হোলিখেলা চালিয়ে যাচ্ছে । অপরদিকে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, লিজিং কোম্পানি ও পুঁজিবাজারে চলছে ধারাবাহিক হরিলুটের কারবার । সরকারের আর্থিক নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর যোগসাজশে দেশ থেকে নানান উপায়ে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে । এসব বন্ধ ও এসবের সাথে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে যারা জড়িত তাদের ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না ।

একইভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা ও গরিমা ভুলুণ্ঠিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাটি এড়িয়ে নানান গোঁজামিলের নির্দেশিকা দিয়ে একটি বাণিজ্যিক প্রকল্পের অবতারণা করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় প্রায় আশি/পঁচাশি হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে ফেলা হয়েছে ! মুক্তিযোদ্ধাদের হাজারো বাদপ্রতিবাদ সত্বেও বিএনপি-জামায়াতের অসৎ উদ্দেশ্যে তৈরিকৃত জামুকার মাধ্যমে এসব অপকর্ম চলছে তো চলতেই আছে । সাম্প্রতিককালে রাজাকার তালিকা প্রকাশের নামে সেই তালিকায় কিছু মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশ করে বে-আক্কেলের মতো একটি কাজ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক সরকারের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছেন যার ফলে তাকে নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে দু:খ প্রকাশ করতে হয়েছে । এছাড়া ব্যাঙ্ক ও শেয়ারবাজারের লুটপাটের দরবেশখ্যাত উপদেষ্টা, সড়ক ও যোগাযোগমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী,স্বাস্থ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী ও এমপিদের কার্যকলাপ ও কথাবার্তা দেশের সাধারণ মানুষ চরম বীতশ্রদ্ধ হলেও একজন মন্ত্রী-উপদেষ্টা-এমপির কিছুই হলো না ! মূল নাটের গুরু আমলারাও ধরাছোঁয়ার উর্দ্ধে অবস্থান করছে ! দেখুন করোনাকালীন সরকারের অবস্থা ! করোনাকালীন এ দু: সময়ে গোটা সরকার একাই চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা—-কোথায় তাঁর মন্ত্রী এমপি সচিব সাহেবরা ? তাঁকে যদি একা সবকিছুই করতে হয় তাহলে ঐ মন্ত্রিসভা, ঐ উপদেষ্টামণ্ডলী ও ঐ সচিবালয়ের কী প্রয়োজন ?

অতীতের ধারাবাহিকতায় দুর্নীতি ও লুটপাট এখন দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে । এ-ব্যাপারে সরকারের তেমন মাথাব্যথা পরিলক্ষিত হচ্ছে না । অপরদিকে পোড়খাওয়া দলীয় নেতাকর্মীসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে পাশ কাটিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত শিবির ফ্রিডমপার্টি বিএনপি হেফাজত চাটুকার ও সুযোগসন্ধানীরা সরকারি দলের উচ্চস্তরের নেতৃবৃন্দকে বিশাল অর্থ দিয়ে আওয়ামী লীগ ঢুকে গিয়ে দলের বিভিন্ন স্তরের পদ বাগিয়ে নিচ্ছে । এ-প্রক্রিয়ায় সরকারের ভেতরে থেকে ক্যাসিনো সম্রাট, গণিকা সম্রাজ্ঞী, ব্যাঙ্কিং দরবেশদের চরম উত্থান ঘটছে । এছাড়া সরকারের প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের মধ্যে কতিপয় মাফিয়া পরিবারের উত্থান ঘটেছে যারা ভূমিদখল, বাজার দখল, মিডিয়া দখল, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখলসহ সারা দেশটাকে জিম্মি করে ফেলেছে । খুন, ব্যভিচার, নিপীড়নসহ সর্বপ্রকার ঘৃণ্য ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড যেনো তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । তাদের ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না । তারা বিশাল অর্থ ছিটিয়ে সবাইকে ক্রয় করে বশে রাখে । এ-ব্যাপারটা দলীয় হাইকমান্ড বা প্রশাসনের অগোচরে হচ্ছে এটা ভাবার অবকাশ নেই । বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপরিণামদর্শি চিন্তা ও মেরুকরণের পথ ধরে হেফাজতে ইসলামের মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধর্মান্ধ জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সাথে আওয়ামী লীগের গাঁটছড়ার বিষয়টি কোনোভাবেই দেশপ্রেমিক ও সচেতন মানুষ মেনে নিতে পারছেন না । অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ তথা রাজাকারদের উত্তরসূরিরা আওয়ামী লীগ নেতাদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে দলে ঢুকে, যেসব মুক্তিযোদ্ধা তাদের বাপ-দাদাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারগিরির শাস্তি দিয়েছিলো, সেসবের প্রতিশোধ নেয়ার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের ওপর হত্যা, নির্যাতন, সম্পত্তি লুটসহ নানান উৎপীড়ন চালালেও এ বিষয়ে দল ও প্রশাসনের তেমন কোনো প্রতিকারমূলক তৎপরতা নেই ! কী পরিতাপের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলাতন্ত্র ও রাজাকার প্রজন্মের কূটকৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটাটিও বাতিল করতে হলো বঙ্গবন্ধু-কন্যার হাত দিয়ে !

সবকিছু পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে, দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার নয়—-দেশটি দাঁড়িয়ে রয়েছে একা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনারই ব্যক্তিগত সততা সাহস মেধা ও দেশপ্রেমের ভাবমূর্তির ওপর । এটা একটা দেশ ও জাতির জন্য মোটেই সুখকর নয় । দেশ, দল ও সরকার পরিচালিত হওয়া উচিত আদর্শিক ও চেতনানির্ভর একটি টিমওয়ার্কের মাধ্যমে । চারদিকে অসৎ ও দুর্নীতিবাজচক্র পরিবেষ্টিত থেকে কোনো একক সৎ ব্যক্তির পক্ষে দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে কাঙ্ক্ষিত পথে এগিয়ে নেয়া যায় না । অন্যদিকে একক ব্যক্তির পক্ষে অগণন দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করাও সম্ভব নয় । এজন্য কৌশলে ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে দলের মধ্যকার কর্মী ও দলের বাইরে অবস্থানরত শুভানুধ্যায়ীদের মধ্য থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত সৎ মেধাবী সাহসী ও ত্যাগী লোকদের বসিয়ে দিয়ে দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াচক্রকে ধরাশায়ী করার কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে । এরপর দেশ ও দলের জন্য ক্ষতিকর মাফিয়া দুর্নীতিবাজ লুটেরা হাইব্রিড ও সুযোগসন্ধানীদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে বের করে দিতে হবে । তাদের স্থান হবে কারাগারে । তৃতীয়ত: বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের ভিত্তিতে দেশকে পরিচালিত করার লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরিহার করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে রাষ্ট্র ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে ।

বাঙালি জাতি বিশ্বাস করে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে এবং তাঁর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মশাল হাতে নিয়ে তাঁরই সুযোগ্যা কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব, যদি তিনি দল, প্রশাসন ও আর্থিকখাত থেকে দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের বলয় ভেঙে চুরমার করে বেরিয়ে আসতে পারেন ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।