আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : সরকারি হাসপাতালের বস্তাভর্তি ওষুধ পাচারের আলোচিত ঘটনায় পৃথকভাবে দুইটি তদন্ত কমিটি গঠণ করার দুই মাস পরেও রিপোর্ট জমা দিতে পারেনি তদন্ত কমিটি। অভিযোগ উঠেছে তদন্ত কমিটিকে ম্যানেজ করে বিষয়টি ধামাচাঁপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। দুই মাসেও রিপোর্ট দিতে না পারায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দরা। ঘটনাটি জেলার গৌরনদী উপজেলা হাসপাতালের।

সূত্রমতে, গত ৭ মার্চ দিবাগত রাতে গৌরনদী উপজেলা হাসপাতালের লক্ষাধিক টাকার বস্তাভর্তি ওষুধ গোপনে পাচার করছিলেন আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ মাজেদুল কাওসার ও তার সহযোগিরা। খবর পেয়ে স্থানীয় সাংবাদিকরা তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে পৌঁছে বস্তাভর্তি ওষুধ পাচারের ছবি ও ভিডিওচিত্র ধারন করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারের নির্দেশে দুইটি গেট তালাবদ্ধ করে দশজন সাংবাদিককে প্রায় দুইঘন্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।

এ খবর ফেসবুক লাইভে ছড়িয়ে পরলে অন্যান্য সংবাদকর্মীরা এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার, গৌরনদী মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে রাত সাড়ে দশটার দিকে অবরুদ্ধ সাংবাদিকদের উদ্ধার করেন।

অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় সংবাদকর্মীদের ফেসবুক লাইভে বিষয়টি দেখে হাসপাতাল কম্পাউন্ডে শত শত এলাকাবাসী ও সংবাদকর্মীরা জড়ো হয়ে রাতেই অভিযুক্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ আমরুল্লাহ এবং আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার মাজেদুল কাওসারকে প্রত্যহারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ইউএনও’র সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেন। পরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস পুরো ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দিয়ে রাত একটার দিকে উত্তেজিত এলাকাবাসিকে শান্ত করেন।

স্থানীয় সংবাদ কর্মীরা জানান, ওষুধ পাচারের খবর পেয়ে রাত সাড়ে আটটার দিকে উপজেলা হাসপাতালে পৌঁছে তারা দেখতে পান হাসপাতালের মধ্যকার নির্জনস্থানে বিপুল পরিমান ওষুধ পোড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি অসংখ্য বস্তাভর্তি ওষুধ পাচার করা হচ্ছে। এসময় সংবাদকর্মীরা ছবি তুলে ভিডিও চিত্র ধারণ করেন। এসময় একটি গাড়িযোগে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তার হাসপাতাল কোয়ার্টারের বাসায় প্রবেশ করেন।

একপর্যায়ে সাংবাদিকরা প্রশাসনকে খবর দিলে ডাঃ মাজেদুল কাওসারসহ অন্যান্য পাচারকারীরা ২০২২ সাল পর্যন্ত মেয়াদের বেশকিছু সরকারি ওষুধ ফেলে পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সাংবাদিকরা হাসপাতাল কম্পাউন্ড থেকে বের হতে গিয়ে দেখতে পান হাসপাতালের দুইটি গেটে তালাবদ্ধ করে তাদের (সাংবাদিক) অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ইউএনও ঘটনাস্থলে পৌঁছে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে থাকেন। পরবর্তীতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাত সাড়ে দশটার দিকে তালা খুলে দেয়ার পর অবরুদ্ধ সংবাদকর্মীরা মুক্ত হন।

পরবর্তীতে ইউএনও’র নির্দেশে থানা পুলিশ তল্লাশী চালিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোয়ার্টার ও তার পাশের ঝোপ জঙ্গল থেকে বস্তা ও কার্টুন ভর্তি পাচারকরা সরকারি ওষুধ ও ইনজেকশন জব্দ করেন। যার মেয়াদ রয়েছে আগামী ২০২২ সাল পর্যন্ত।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস ঘটনার পরেরদিন উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মাসুম বিল্লাহকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠণ করেন। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফয়সাল জামিল ও গৌরনদী মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মোঃ তৌহিদুজ্জামান। একইদিন ডেপুটি সিভিল সার্জন ডাঃ মাহামুদুল হাসানকে প্রধান করে অপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা সিভিল সার্জন।

তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করার পর উপজেলা প্রাণী সম্পদ কার্যালয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে অবরুদ্ধ সাংবাদিক মাইটিভি’র গৌরনদী প্রতিনিধি মোঃ গিয়াস উদ্দিন মিয়া, দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার ও গৌরনদী উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি খোকন আহম্মেদ হীরা, আনন্দ টিভি’র ব্যুরো প্রধান কাজী আল-আমিন, দৈনিক পিপলস্ টাইমের ব্যুরো প্রধান এইচএম লিজন, চ্যানেল এস এর ক্যামেরাপারর্সন হাসান মাহমুদ সহ অন্যান্য সংবাদকর্মীদের কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত শুনে লিখিত বক্তব্য, ভিডিও এবং ছবি গ্রহন করেন। ঘটনার দুই মাস অতিবাহিত হওয়ার পরেও রহস্যজনক কারণে তদন্ত কমিটি এখনও তাদের রিপোর্ট জমা দিতে পারেননি।

তদন্ত কমিটির আহবায়ক উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মাসুম বিল্লাহ বলেন, তদন্তের কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে রয়েছে। খুবই শীঘ্রই রিপোর্ট জমা দেয়া হবে।

গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, সংবাদকর্মীদের অবরুদ্ধর খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের উদ্ধার করার পাশাপাশি বেশকিছু সরকারি ওষুধ জব্দ করা হয়। প্রাথমিক তদন্তে হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজেও হাসপাতাল থেকে অসংখ্য ওষুধের কার্টুন ট্রলি ভর্তি করে বাহিরে নেয়ার বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি আরও বলেন, তদন্ত কমিটির রির্পোট পাওয়ার পর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত হবে তার বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তদন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা দিতে বিলম্ব করার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দসহ অবরুদ্ধ সাংবাদিক সমাজ। নেতৃবৃন্দরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচার করায় অনতিবিলম্বে অভিযুক্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারকে প্রত্যাহারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন।

(টিবি/এসপি/মে ১৮, ২০২১)