আবীর আহাদ


গণবিরোধী আমলাতন্ত্র দেশের জন্য বিশাল অভিশাপ । আমলাতন্ত্র জনগণ তো বটেই, এমনকি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারকেই সে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে । একসময় তারাই হয়ে যায় সরকারের ভেতর শক্তিশালী অদৃশ্য সরকার ( Powerful Invisible Government) । তারা যতো ছোটো ও যতো বড়ো পদধারী হোক, তারা নিজেদেরকেই শাসক ভেবে বসেন । নিয়ম-কানুন, আইন-আদালত তারা মানে না । তারা নিজেরাই বিচারক । আইন হাতে তুলে নিতেও দ্বিধা করে না । সম্প্রতি প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদক সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির তথা সংগ্রহ করতে গেলে তাকে কতিপয় পুচকে কর্মকর্তাসহ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুননেসা মারধর করে দীর্ঘ ৫/৬ ঘণ্টা একটা কক্ষে বসিয়ে রেখে অত:পর পুলিশের হাতে ন্যস্ত করেন । সেই সাংবাদিক এখন কারাগারে । স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এসব কর্মকর্তা আইন হাতে নিয়ে সাংবাদিককে হেনস্থা করার পাশাপাশি বেআইনিভাবে আটক রাখার যে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছেন এর মধ্যে দিয়ে তারা তাদের ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন । তেমনিভাবে আমলারা যিনি যেখানে আছেন, তিনি মনে করেন তিনি সেখানকার গভর্নর । তারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থের অন্ধমোহে ধরাকে সরা জ্ঞান করে থাকেন । তারা কারো কাছে জবাবদিহি বা দায়বদ্ধ বলে স্বীকার করেন না । এহেন সর্বগ্রাসী আমলাতন্ত্রকে কোনো রাজনৈতিক সরকার প্রশ্রয় দিলে সরকার ও আমলাতন্ত্রের তাৎক্ষণিক স্বার্থোদ্ধার হয় বটে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ও জনগণের সর্বনাশ ঘটে । বলতে দ্বিধা নেই, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তার নানাবিধ দুর্বলতার কারণে সব সভ্যতা ভব্যতা ও নৈতিকতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আমলাতন্ত্রের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তুলে দিয়ে নিজেদের সর্বনাশ ঘটানোর পাশাপাশি দেশের সর্বনাশ ডেকে আনছে যা তারা ক্ষমতার রঙিন চশমা পরে থাকায় আঁচ করতে পারছেন না ।

আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল । জনগণের দল । তারই হাতে এদেশের স্বাধীনতা এসেছে । অথচ এ স্বাধীনতা অর্জনের পশ্চাতে যে মুক্তিযুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল, আমলাতন্ত্রের ৯৫% সদস্য ছিল সেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে । আর দু:খজনক সত্য এই যে, সেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলাতন্ত্রকেই স্বাধীন দেশের প্রশাসনে রেখে দেয়া হয়েছিলো ! এখানে অবশ্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল মনের উদারতা কাজ করেছিল । তিনি ভেবেছিলেন, অনেক রক্তপাত ও হিংসা সংঘটিত হয়েছে, আর নয় । সবাই বাঙালি । স্বাধীন দেশটাকে সবাই মিলে এখন এগিয়ে নিয়ে যাই । এ অনুভূতি থেকেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলাতন্ত্রকে ক্ষমা করে প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনে রেখে দিয়েছিলেন । তিনি আরো ভেবেছিলেন, এ অভিজ্ঞ আমলারা তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতাকে স্বাধীনতা-উত্তর ভগ্ন দেশের উন্নয়নে কাজে লাগিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশকে একটি শক্তিশালী অবকাঠামোর ওপর দাঁড় করাতে সম্ভব হবে । তবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলাতন্ত্রকে বহাল রাখলেও তাদেরকে তিনি যথাযথ নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন । তাদের অপরাধ কর্মকে শায়েস্তা করার জন্য পিও-০৯ নামক একটি কঠোর চাকরিবিধি প্রণয়ন করেছিলেন ।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর উদারতা ও চিন্তাকে তাঁর সরকারের দুর্বলতা ভেবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলাতন্ত্র খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংগঠিত হয়ে পড়ে । তারা স্বাধীন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নীতিমালায় পরিচালিত বঙ্গবন্ধু সরকারের কর্মযজ্ঞকে মানতে পারছিলো না । তারা ছিলো পাকি-মনা । চরম দুর্নীতিগ্রস্ত । ফলে ছলেকলেকৌশলে তারা নিজেদের অবস্থান সংহত করে বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে পরাজিত দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে দেশের মধ্যে নানান অরাজকতা সৃষ্টিতে ইন্ধন জোগায় । দেশের খাদ্য সংকটকে পুঁজি করে দেশের মধ্যে একটি কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে । ৭৪ সালের সেই দুর্ভিক্ষের ধারাবাহিকতায় ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এবং ৩রা নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় । ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ । আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতি ও বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চারনেতা হত্যার পশ্চাতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমলাতন্ত্র অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ।

শেখ হাসিনার সামনে এমন জ্বলজ্বলে ইতিহাস থাকলেও তিনি সেটাকে পাত্তা না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও ইতোমধ্যে আওয়ামীবিরোধী মনোভাবে গড়েওঠা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রকেই পরম বিশ্বাসে কাছে টেনে নিয়েছেন । অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, প্রশাসনকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাসহ দুর্নীতিমুক্ত করার তাঁর শত আহ্বান ও নির্দেশের প্রতি আমলাদের কোনোই ভ্রুক্ষেপ নেই । তারা তাঁর সরকারের একশ্রেণীর দুর্বৃত্তপরায়ণ রাজনৈতিক শক্তির যোগসাজশে সরকারের নানান উন্নয়ন প্রকল্প ও কেনাকাটার মধ্যে সাগরচুরির মহোৎসব ঘটিয়ে চলেছে । চলমান করোনাকালীন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি, অনৈতিকতা, অব্যবস্থা ও লুটপাটের যে হোলিখেলা চলছে, কী এমন অবস্থার সৃষ্টি হলেও সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনোই ব্যবস্থা নিতে পারছে না । শুধুমাত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয়, বলা চলে গোটা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক পদগুলোতে অর্থের বিনিময়ে দুর্নীতিবাজ আমলাদের বসিয়ে দেয়া হয়েছে । আর পদে বসেই তারা ফ্রিস্টাইল দুর্নীতি ও লুটপাট করে যাচ্ছে । তাদের কোনো জবাবদিহিতার বালাই নেই । তারা যেনো ধরাছোঁয়ার উর্দ্ধে । দুর্নীতিবাজ নেতা এমপি ও মন্ত্রীসহ আমলাতন্ত্রকে প্রশ্রয় দিলে অবস্থাটা এমন হওয়াই স্বাভাবিক ।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী আমলাতন্ত্রের সাথে আপোস করে এ সরকার সবচাইতে বড়ো ভুলটি করেছেন বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে । মূলত: ঐ আমলাতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজাকার সন্তানদের তথাকথিত আন্দোলনের অজুহাতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে বঙ্গবন্ধু ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চরমভাবে অপমান করা হয়েছে । পাশাপাশি প্রশাসনকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে খোলামেলাভাবে রাজাকারি প্রশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা হয়েছে । এখন বলা চলে বাংলাদেশের প্রশাসন চলছে রাজনৈতিক সরকারের নেতৃত্বে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী আমলাতন্ত্রের নেতৃত্বে । মূলত: দুর্নীতি লুটপাট এবং অযোগ্যতা ও অদক্ষতার কারণেই রাজনৈতিক সরকার ধুরন্ধর আমলাতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে থাকে । তখন রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক সরকারের দর্শন নয়, আমলাতন্ত্রের দর্শনই মুখ্য ভূমিকা পালন করে । এখানেই আওয়ামী লীগ সরকারের চরমতম পরাজয় ।

দেশ দু'টি ভাগে বিভক্ত । মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বিপক্ষ শক্তির প্রতি বিশাল মনের উদারতার কারণে নমনীয় হলেও বিপক্ষ শক্তি মনের দিক থেকে বংশপরম্পরায় এখনো প্রতিহিংসা পরায়ণ । তারা বংশানুক্রমিক বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে এখনো মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি । এটা বিজ্ঞজনেরা সবাই বুঝলেও আমাদের উদারমনের প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারেননি বলে মনে হয় । দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সৎ মেধাবী ও ত্যাগী মানুষ থাকতে কেনো যে তিনি সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিশেবে বেছে নিলেন একজন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ-করা প্রয়াত কর্নেল আবদুল মালেকের পুত্রকে তা আমাদের বুঝে আসে না ! অপরদিকে জনগুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিশেবে বেছে নিয়েছিলেন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর একজন দালালের পুত্রকে ! চলমান করোনা সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে এই মন্ত্রী ও মহাপরিচালকের অদক্ষতা অযোগ্যতা ও দুর্নীতির কারণে সরকারকে দেশ-বিদেশের কাছে কতো যে নাকানিচোবানি খেতে হয়েছে এবং হচ্ছে, তারপরও সরকারের হুঁশ হচ্ছে না ! এই মন্ত্রী ও মহাপরিচালকসহ প্রশাসন ও বিভিন্ন অঙ্গনে অবস্থানরত দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না । শাহেদ আরিফ সাবরিনার মতো ছিঁচকে অপরাধী ও বিচ্ছিন্নভাবে বলির পাঁঠায় গেলেও নেপথ্যের গডফাদার ও পৃষ্ঠপোষক তথা আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা যে বহাল তবিয়তে থাকবে তা সবাই জানে ।

যেকোনো দেশের দুর্নীতিবাজ-লুটেরা রাজনৈতিক দল ও শাসকদের জন্য আমলাতন্ত্র কিছুকালের জন্য আশীর্বাদ হলেও দিনের শেষে আমলাতন্ত্রই সেই রাজনৈতিক দল ও শাসকদের পতনের মূল কারণ হিশেবে আত্মপ্রকাশ করে । এজন্য দেশপ্রেমিক শাসকরা দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রকে কোনোভাবেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না । কিন্তু দু:খজনক সত্য এই যে, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বর্তমান অদূরদর্শী সরকার আজ বহুদিন যাবত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রের হাতে বন্দী হয়ে দিশাহীন অবস্থার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে ! অবস্থা মনে হয় এমন জায়গায় চলে গেছে, যার ফলে আমলাতন্ত্রের ভয়ে আওয়ামী লীগ সরকার আজ স্বাধীনতার সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মর্যাদায় মূল্যায়ন করতে পারছে না । অপরদিকে আমলাতন্ত্রের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সময় মতো তাদের সম্মানী ভাতা ও শিষ্টাচার পাচ্ছেন না । মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থা হবে যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর ও গণবান্ধব সেখানে আমলাতন্ত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জনগণকে পদদলিত করে চলেছে । অথচ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগ । দেশের মধ্যে যে সাগরসম লুটপাট দুর্নীতি ও অব্যবস্থা বিরাজ করছে, তার সিংহভাগ সংঘটিত হচ্ছে এ আমলাতন্ত্রের দেখিয়ে দেয়া কলাকৌশলের মাধ্যমে । বিশেষ করে সরকারি ছোট-বড়ো-মেগা প্রকল্প ও কেনাকাটার মাধ্যম যে লুটপাট সংঘটিত হয়ে আসছে তা অতি বিস্ময়কর হলেও সরকার হিশেবে আওয়ামী লীগ তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না । মনে হয় আওয়ামী লীগ সরকার আমলাতন্ত্রের স্টিলফ্রেমের মধ্যে বন্দি হয়ে হিতাহিতবোধশূন্য হয়ে পড়েছে । আওয়ামী লীগের এ দুর্বলতা ও রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব মেনে নেয়া যায় না । এটা দেশ ও জাতির জন্য ভয়াবহ অশনি সংকেত ।

জননির্ভর রাজনৈতিক দল হিশেবে আওয়ামী লীগকে তাঁর দল ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এখনি আমলাতন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে আসতে হবে । অন্যথায় তাকে করুণ পরিণতি বরণের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে !

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।