আবীর আহাদ


কাশ্মীরকে ভূসর্গ বলা হয়। এর প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক পরিবেশ এতোই মনোরম যে, বিশ্বের বহু পর্যটক এর আকর্ষণে বহু বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এখানে ছুটে আসতেন। কিন্তু কাশ্মীরের ভৌগোলিক গুরুত্ব ও প্রাকৃতিক সম্পদের মোহে আশপাশের রাষ্ট্র পাকিস্তান, চীন ও ভারতের মধ্যে চলে আসছে নানান দ্বন্দ্ববিরোধ। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর একটি প্রাচীন মনোমুগ্ধকর সভ্যতা আজ তাই খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেছে। তাকে নিজেদের পুরোপুরি দখলে নেয়ার জন্য চলছে কথিত রাষ্ট্রত্রয়ের মধ্যে নিরন্তর সংঘাত। যুদ্ধ। বিগ্রহ। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। ফলে গোটা কাশ্মীর এখন অশান্তির আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। সেখানে প্রতিনিয়ত হিংসা ও রক্তপাত ঘটছে। সেই ভূসর্গ কাশ্মীর এখন আর বিদেশী পর্যটকদের জন্যেও নিরাপদ নয়।

ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র ও সভ্যতা বিচার করা সঠিক হবে বলে মনে হয় না। একটি রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সেই রাষ্ট্রকে বিবেচনা করাই যুক্তিযুক্ত। কাশ্মীর প্রসঙ্গে নিয়ে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে তার ভূ-রাজনীতি তথা পারিপার্শিক রাষ্ট্রসমূহের দৃষ্টিভঙ্গিও বিবেচনায় নিতে হবে।

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তানকে স্বাধীনতা প্রদান করে কাশ্মীরের বিষয়টি তাদের মর্জির ওপর ছেড়ে দিয়ে অমীমাংসিত রেখে দেন। কথা ছিলো এমন, কাশ্মীর হয় ভারতে অথবা পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত হবে, নয়তো নিজেরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তুলবে।

কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য এই যে, পাকিস্তানি শাসকচক্রের সহ্য হলো না। স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে হুঁট করে সে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে কাশ্মীরের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চলটি দখল করে বসে এবং সে-স্থানের নামকরণ করে 'আজাদ কাশ্মীর'। যার পরিমাণ গোটা কাশ্মীরের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। বাকি অংশের দিকেও যখন তারা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তখন জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজা হরিসিং পাকিস্তানের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে ভারত সরকারের আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে ভারত অনায়াসেই কাশ্মীরের বাকি অংশটি দখল করে নিতে পারতো। কিন্তু সেটি না করে ভারত সরকার স্বায়ত্তশাসন চুক্তির আওতায় জম্মু ও কাশ্মীরকে একটি রাজ্যের মর্যাদা দিয়ে ভারত ইউনিয়নভুক্ত করে নেন। এ-প্রক্রিয়ায় জম্মু ও কাশ্মীরের অবিসংবাদিত মুসলিম নেতা শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহও সামিল ছিলেন । যে স্বায়ত্তশাসন চুক্তির কথা বলা হয়, সেটি তৈরি করেছিলেন ঐ শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলে জানা যায় । অপরদিকে সম্ভবতঃ ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধে চীন কাশ্মীরের আকসাই অঞ্চল দখল করে নেয় যার নাম আকসাই চীন। এটা গোটা কাশ্মীরের প্রায় পনেরো শতাংশ।

পাকিস্তান ও চীন যে কাশ্মীরের প্রায় পঁয়তাল্লিশ শতাংশ ভূমি রীতিমতো দখল করে তাদের রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত করেছে তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই, যতো মাথাব্যথা ভারতকে নিয়ে। এমন ব্যথার দাম কে দেবে? বিশেষ করে কাশ্মীর নিয়ে নিজের অপরাধ ঢেকে রেখে পাকিস্তান বহুকাল যাবত ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা বলে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের কবল থেকে তথাকথিত স্বাধীনতার নামে বিচ্ছিন্ন করে নিজের দখলে নেয়ার লক্ষ্যে নিজের সৈন্যবাহিনী ও আজাদ কাশ্মীরে লালিত সশস্ত্র বাহিনীসহ নানান কিংভূতকিমাকার মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সংগঠন দিয়ে জম্মু-কাশ্মীর ও ভারতের মূল ভূখণ্ডে ধারাবাহিক যুদ্ধ ও হামলা চালিয়ে আসছে। অপরদিকে পাকিস্তানের বন্ধু চীনও বসে নেই। সেও ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরকে তার দখলে নেয়ার লক্ষ্যে কয়েকবার ভারতের সাথে যুদ্ধের পাশাপাশি পাকিস্তানের মতো সেখানকার কতিপয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নানান মদত দিয়ে আসছে।

বহির্শত্রু ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার প্রত্যেক রাষ্ট্রের যেমন রয়েছে, তেমনি ভারতেরও রয়েছে এবং তাদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে যা কিছু করার তারাও তাই করছে । তাদের রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের একান্তই আভ্যন্তরীণ বিষয়।

আমাদের বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের তথাকথিত শান্তিবাহিনী বহুদিন যাবত ঐ অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধসহ ধারাবাহিক সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত ছিলো। দু:খজনক হলেও সত্য এই যে, পার্বত্য বিচ্ছিন্নতাবাদী তথাকথিত শান্তি বাহিনীকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে মদত দিয়েছিলো পাকিস্তান ও চীন। আর এর মূলে ছিলো একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ। কিন্তু আমাদের সেনাবাহিনী ও আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পাকিস্তান ও চীন সমর্থিত তথাকথিত শান্তি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছে । এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামে আজ শান্তি বিরাজ করছে। তদ্রূপ ভারত তার রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ জম্মু ও কাশ্মীরের নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনে যা কিছু করণীয় করছে, যেটা তার অধিকার। এ নিয়ে কারো মাথা ঘামানোর কিছু নেই। অতএব বাস্তব অবস্থার আলোকে কাশ্মীরের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা বিচার-বিবেচনা করাই যুক্তিযুক্ত বলে আমরা মনে করি।

লেখক : চেয়ারম্যান একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।