এমডি অভি, নারায়ণগঞ্জ : কদম রসুল দরগাহ, নামেই বুঝা যায় রসুলের কদম (পা) কে বুঝানো হয়েছে। আর রাসুল (হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইছালাম) এর কদমের ছোঁয়া পড়েছে এমন একটি পাথর আছে বলেই এই দরগাহের নামটির এমন নামকরণ করা হয়েছে বরে কথিত আছে যা এই এলাকার ধর্মভক্ত মানুষজন মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। এই দরগাহটি নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্যতম একটি দর্শন স্থান যা বন্দর উপজেলার নবীগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী কোল ঘেঁষে অবস্থিত তা প্রায় পাঁচশত বছর আগের ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ধারণা করা হয়, দরগায় রক্ষিত পাথরের ফলকের উপর দৃশ্যমান পদচিহ্নটি প্রকৃতপক্ষে হযরত মুহম্মদ (সা:) এর পদচিহ্ন। পরে সেই পাথরটিকে মানুষের পায়ের পাতার আকৃতিতে কাটা হয়। পাথরের এই ফলকটি দরগাহের ভিতর অত্যন্ত যত্নের সাথে সংরক্ষিত করে রাখা আছে। কদম রসুল এই পাথরের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এখানে তাই প্রতিদিন বহু ধর্মপ্রাণ মুসলিম এই দরগাহ জিয়ারত করতে আসেন। এই মাঝার ও পাথর নিয়ে লোকমুখে বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও গল্প প্রচলিত আছে। কিন্তু এই পাথরের ছাপটি রসুলের পায়ের ছাপ দাবি করা হলেও ইসলাম ধর্মের মতে এর কোন স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি।

এই দরগাহের পশ্চিম দিকে যেখান দিয়ে মূল প্রবেশ পথ সেখানে খুব সুন্দরভাবে কারুকাজ করে গড়ে তোলা হয়েছে একটি সুউচ্চ তোড়ন। দুর থেকে যে কেউ ভাববে এই তোড়নটিই দরগাহের মূল অংশ। আসলে এটি একটি প্রবেশ তোড়ন বা মূল দরগাহের প্রবেশ দেয়াল মাত্র। এই সুউচ্চ জায়গাটির ঠিক মাঝামাঝি অবস্থিত একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট সাদা শ্বেতপাথরের মাজার। আর এই মাজারের ভিতরেই খুব যত্নের সাথে সংরক্ষিত আছে সেই পাথরটি। আগের দিনের কাঠের যে খড়ম আছে সেই খড়মের মতোই দেখতে সেই পাথরটি। এখন থেকে প্রায় ত্রিশ পয়ত্রিশ বছর আগে দর্শনার্থীগণ এটি খুব সহজেই এটি দেখতে পারতো, এই পাথরে চুমো খেতে পারতো। কিন্তু এখন আর আগের মতো এত সহজে পাথরটিকে দর্শনার্থী ভক্তদের সামনে নিয়ে আসা হয় না। এটা এখন একটি কাঁচের বাক্সের ভিতর রাখা আছে এবং কিছু বিশেষ দিনেই এটা বাক্স থেকে বের করে দেখানো হয়। এই পাথরটি একটি গোলাপজল মিশ্রিত পানির মধ্যে চুবিয়ে সেই পানি ছোট একটি কাঁসের গ্লাসে করে ভক্তদের পান করতে দেয়া হয়। এই মাজারে সাথেই একটি কবরে মাঝখান দিয়ে বের হয়েছে একটি বিশাল কাঠ গোলাপের গাছ। যা এই মাজারটি কদর্য ও মহিমা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

স্থানীয় সত্তরোর্ধ বয়সের বৃদ্ধ আহমদ আলী প্রধান জানান, তিনি তার দাদা ও দাদার সঙ্গীয়দের মুখে শুনেছেন এক সাধক মক্কায় হজ্ব করতে গেলে সেখানে তিনি এক উচ্চ মাপের এক সাধকের কাছ থেকে এই পাথরটি উপহার হিসেবে পান। আমৃত্যু এই পাথরটিকে তিনি তার বুকে আগলে রাখেন এবং এখানেই মারা যান। তাই রসুলের প্রতি সম্মান জানাতে এবং সাধকের এই ভালবাসাকে কেন্দ্র করে এখানে এই মাজারটি গড়ে উঠে। তবে কদম রসুল দরগাহ বিষয়ে ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলে জানা যায়, বিভিন্ন মুসলিম ইতিহাসে কথিত আছে, মেরাজের রাতে যখন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বোরাকে উঠছিলেন তখন বেশকিছু পাথরে নবীজির পায়ের ছাপ পড়ে।

এই ছাপ পড়া পাথরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত পাথরটি রয়েছে জেরুজালেমে। ইস্তাম্বুল, কায়রো এবং দামেস্কতেও এর কিছু পাথর রয়েছে। আমাদের বাংলাদেশেও এমন আরো দুটি পাথর রয়েছে জানা যায়, যার একটি আছে চট্টগ্রামে আর অপরটি রয়েছে নবীগঞ্জ কদম রসুল দরগায়। ইতিহাসবিদদের মতে মাসুম খান কাবুলী নামে একজন আফগান সেনাপ্রধান যিনি খাঁর বন্ধু ছিলেন তিনি ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে এই নিদর্শনটি একজন আরব সওদাগর-এর নিকট থেকে অর্থের বিনিময় ক্রয় করেন। তারও অনেক পরে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে গোলাম নবী নামে ঢাকার একজন জমিদার নবীগঞ্জের একটি উঁচু স্থানে একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট দরগা নির্মাণ করে সেখানে পবিত্র পাথরটি স্থাপন করেন এবং গোলাম নবীর ছেলে গোলাম মুহাম্মদ কদম রসুল দরগার প্রধান ফটকটি নির্মাণ করেন।

কথিত আছে এই স্থানটি দর্শন করেন সুবাদার ইসলাম খান, মুঘল সম্রাট শাহজাহানসহ আরো অনেক আমির-ওমরা। সুলতান শুজা এই দরগার জন্য ৮০ বিঘা জমি দান করেন। পরে ঈসা খাঁর প্রপৌত্র দেওয়ান মনোয়ার খান এখানে একটি ইমারত তৈরি করেন। কিন্তু সেই ইমারতও কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। বন্দরের নবীগঞ্জ এলাকাতে এই কদম রসুল দরগাহটি বিশাল জায়গা নিয়ে প্রায় ৬০ ফুট উঁচু মাটির টিলায় এটির অবস্থান। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) কদম মোবারক (পদচিহ্ন) সংবলিত এই কালো পাথরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ইতিহাস খ্যাত এ দরগাহ শরীফ কদম রসূল দরগাহ। যেখানে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ এখানে আসে নবীজীকের সম্মান প্রদর্শন করার জন্য। ১২ রবিউল আউয়াল উপলক্ষে এই কদম রসুল দরগাহকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় আচারসহ বিরাট মেলার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আলোকসজ্জাসহ নানা রঙে রঙিন হয়ে উঠে এই দরগাহের ভবনসহ আশপাশের এলাকা। এই দরগাহের ভিতর ও বাহিরে আরো একাধিক কবর ও মাজার রচিত হয়ে এই ধর্মীয় আবেগের স্থানটিকে যেন আরো বৈচিত করে তুলেছে, পাশাপাশি বন্দর তথা নারায়ণগঞ্জ জেলাকে ইতিহাসের পাতায় করেছে সমৃদ্ধ।

(এবি/এসপি/জুন ০৮, ২০২১)