দিলীপ চন্দ, ফরিদপুর : সম্প্রতিক সময়ে নানা দুর্যোগে আক্রান্ত দেশের মানুষের আরেকটি ভয়াবহ দুর্যোগের নাম বজ্র পাত। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে বজ্রপাতে যে ভাবে প্রাণ হানি হচ্ছে তাতে করে বিষয়টি এখনই জরুরী ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগি হওয়া প্রয়োজন। যদিও সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। দেশের বন ও বিভিন্ন এলাকার বৃক্ষ উজার করে এক ধরনের মুনাফা লোভীদের কারনে এই দুর্যোগ ক্ষতি বেশি করছে। গত এক সপ্তাহের বজ্রপাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে একদিন ২৩ জন অপর দিন ১৭ জন এবং তার কয়েকদিন পর ৯ জনসহ বজ্র পাতে মৃত্যুর পরিমাণ বেড়েই চলছে। 

এই মৃত্যুর থাবা থেকে জীবন বাঁচাতে আমাদের প্রত্যেক নাগরিককে সচেতন হতে হবে। অপরকে সামাজিক ভাবে সচেতন করতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর নানা মাধ্যমে এ বিষয়ে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে। বজ্র পাত বা মেঘ বৃষ্টির সময় ইলেকট্রিক সামগ্রী টিভি, ফ্রিজ, মুঠো ফোন, মটর যান চলাললে সর্তকতার কথা বলা হচ্ছে। খোলা মাঠে না যাওয়া। কৃষি কাজে বজ্র বৃষ্টির সময় মাঠে না থাকাসহ নানা প্রচারনা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো ফরিদপুরেও প্রতিবছর বজ্র পাতে প্রাণ হানি হয়। বিশেষ করে চর অঞ্চল ও কৃষি মাঠ সংলগ্ন এলাকায়। আবাসিক এলাকাগুলোতেও কোন কোন সময় বজ্রপাত হয়ে থাকে। গত দের দশকে ফরিদপুর অঞ্চলে প্রাচীন বৃক্ষ উজার হয়েছে। একটা বিশেষ রাজনৈতিক চক্র সংশ্লিষ্ট দপ্তর গুলোর কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে কোটেশন ও নিলাম বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গাছপালা খেয়ে ফেলেছে সেই সব দোসরদের বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। আর এই মুহুর্তে কোন বৃক্ষ নিলামে বিক্রি প্রয়োজন নেই। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রাধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে সবুজায়নের আহবান জানিয়ে সকলকে বৃক্ষ রোপন ও প্রকৃতি রক্ষার আহবান জানিয়েছেন।

বজ্র পাত কেন হয়?

দক্ষিণের গরম আর উত্তরের ঠা-া বাতাস থেকে সৃষ্টি হওয়া অস্থিতিশীল আবহাওয়া বজ্র মেঘের কারনে। একটি মেঘ আরেকটি মেঘের সাথে ঘর্ষণ হলে বজ্রপাত হয়। এ সময় উচ্চ বৈদ্যুতিক তরঙ্গ মাটিতে নেমে আসে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ভৌগোলিক অবস্থানের কারনে বজ্রপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। একদিকে বঙ্গোপসাগর অন্য দিকে ভারত মহাসাগর সেখান থেকে উৎপত্তি হওয়া গরম আর আর্দ্র বাতাস এবং উত্তরের পাহাড়ী এলাকা তার কিছু দুরেই হিমালয় পর্বত সেখান থেকে ছুটে আসা ঠান্ডা বাতাস সব কিছুর সংমিশ্রনে বজ্র পাতের পরিবেশ তৈরী হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়লে পঞ্চাশ ভাগ বজ্র পাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এর রাইরে বন উজার ও বড় বড় বৃক্ষ নিধন করাও এর পেছনে দায়ী। প্রাচীন বৃক্ষ বজ্র নিরোধক হিসাবেও কাজ করে বলেও তাদের ধারণা। বজ্র পাতের কারণগুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বৈশিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এর পেছনে রয়েছে। আবহাওয়াবিদ উইং কমান্ডার মোঃ মোমিনুল ইসলাম (অবসর প্রাপ্ত) এর মতে এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাত বেশি হয়ে থাকে। বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে বজ্র পাতের সম্পর্ক রয়েছে। বৈশিক উষ্ণায়ন হলে বায়ুমন্ডল বেশি জলীয়বাষ্প ধারণ করতে পারে তাই বজ্র ঝড় তৈরী হতে পারে। বনায়ন কমে গেলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় কারণ হিসাবে বলা যায়, গ্রীণ হাউস, কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে গাছপালার খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহার করে।

বজ্রপাতের সময়কাল :

বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে আশি লাখ বজ্রপাত সৃষ্টি হয়। ১৯২০ সালের মধ্যে দেশে বজ্রপাত হয়েছে ৩১ লাখ ৩৩ হাজারেও বেশি। দেশে যে পরিমাণ দুর্যোগ হয় তার ২৬ শতাংশ হয় মে মাসে। ঋতু ভিত্তিক বিন্যাসেও বজ্রপাতের পার্থক্য রয়েছে মার্চ থেকে মে মাসে প্রায় ৫৯ শতাংশ আর মৌসুমী বায়ু আসার সময় অর্থ্যৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৬ শতাংশ বজ্রপাত হয়। তবে মোট বজ্রপাতের প্রায় ৭০ শতাংশ জুন থেকে এপ্রিলে হয়ে থাকে। বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করেছে।

বজ্রপাতের সময় জীবন বাঁচাতে করণীয় :

বিভিন্ন সূত্র ও তথ্য মতে বজ্রপাতের সময় জীবন বাঁচাতে সচেতনতার বিকল্প নাই। বজ্র বৃষ্টির সময় বাইরে না থাকা। মাঠে কাজ করতে না যাওয়া। বাড়ির ফ্রিজ, টিভি বন্ধ রাখা। মুঠো ফোনে কথা না বলা। চলন্ত মোটর যানে না যাওয়া। আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বজ্রপাত একটি কমিউনিটি স্বাস্থ্য সমস্যা বজ্র পাতে শরীরে বৈদ্যুতিক শক হয়। এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় হার্ট এবং ব্রেইন। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং অনেকেই অবস হয়ে যেতে পারে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্যারালাইজড হতে পারে। যারা মারা যান তার চেয়ে কয়েকগুন জটিলতায় ভোগেন বেঁচে যাওয়ারা। অন্যদিকে এ বিষয়ে ডা. এম.এ ফায়েজ বলেছেন, কেউ যখন বজ্রপাতে আক্রান্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পরে তাকে বাঁচানোর জন্য প্রাথমিক কিছু বিষয় রয়েছে যদি শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় তাকে সিপিআর চালিয়ে রাখতে হবে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, বজ্রপাতে অনেকেই বধির হয়ে যাওয়াসহ চোখের সমস্যায় পড়েন, মস্তিস্কে রক্ত ক্ষরন হতে পারে। হাড় ভেঙ্গে যাওয়া, মাংস পেসি নষ্ট হওয়া ও কিডনি অকার্যকর হতে পারে।

আসুন আমরা নিজে বাঁচি, অপরকে বাঁচাতে বজ্রপাত সম্পর্কে সচেতন হই। কারনে অকারনে বৃক্ষ নিধন নয় বৃক্ষ রোপন হোক আমাদের ব্রত। আর প্রকৃতিকে ভালবাসি প্রকৃতির স্বাভাবিকতা থেকে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার মাধ্যম সংগ্রহ করি।

(ডিসি/এসপি/জুন ০৯, ২০২১)