রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : ‘তুই একটা নষ্টা মেয়ে, তোকে শাস্তি পেতে হবে’ এই ফতোয়া দিয়ে পরপর ৫১টি বেত্রাঘাত খাওয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টা পর ক্ষোভে মানে ও দুঃখে আত্মহননের পথ বেছে নিলেন এক সন্তানের মা গৃহবধূ রোকেয়া খাতুন(২৫)। এর আগে রোকেয়াকে তওবা করান মওলানা আবুল খায়ের নামের স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম। 

মর্মান্তিক এই ঘটনাটি ঘটে গত ১০ জুন সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বৈকারি ইউনিয়নের মৃগীডাঙা গ্রামে রোকেয়ার শ্বশুর বাড়িতেই। পরদিন ১১ জুন ঘরের আড়ায় ওড়নায় ফাঁস ঝুলিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন রোকেয়া।

শনিবার দুপুরে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে ফতোয়া দিয়ে ৫১ বেত্রাঘাত করে আত্মহননের পথে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ এনে হতভাগ্য বাবা একই ইউনিয়নের কাথন্ডা গ্রামের মফিজুল ইসলাম এই অভিযোগ করেন। তিনি ফতোয়া দিয়ে তার মেয়েকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়ার সাথে জড়িত এরশাদ, সাইফুল ইসলাম, এরশাদের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ও মওলানা আবুল খায়েরের বিচার দাবি করেছেন।

মফিজুল ইসলাম জানান, ৭-৮ বছর আগে তার মেয়ে রোকেয়া খাতুনের সাথে বিয়ে হয় মৃগীডাঙা গ্রামের আবু জাফরের ছেলে সাদ্দাম হোসেনের। তাদের ঘরে সামিয়া নামের ৬ বছরের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। রোকেয়ার বাবা মফিজুল ইসলাম বলেন, সাদ্দামের বোনজামাই মৃগীডাঙা গ্রামের শহীদুল ইসলামের ছেলে ইস্রাফিলের কুনজর পড়ে রোকেয়ার ওপর। বিভিন্ন সময় সে তাকে কুপ্রস্তাব দিয়ে উত্যক্ত করতে থাকে। এরই মধ্যে গত ৬ জুন শ্বশুরবাড়ি থেকে হঠাত নিখোঁজ হয়ে যায় তার মেয়ে রোকেয়া। খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, সাদ্দামের বোনজামাই ইস্রাফিল ও ইস্রাফিলের বোনজামাই একই গ্রামের ওয়াজেদ আলীর ছেলে এরশাদের সহায়তায় রোকেয়াকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গেছে।

খোঁজাখুজির এক পর্যায়ে ৯ জুন তারিখে এরশাদ রোকেয়াকে নিয়ে ফের ফিরে আসে এবং তাকে রোকেয়ার শ্বশুর বাড়িতে রেখে দেয়। এসব ঘটনা জেনেও রোকেয়ার স্বামী সাদ্দাম হোসেন, তারশ্বশুরআবু জাফর এবং শাশুড়ি সহ পরিবারের লোকজন রোকেয়াকে গ্রহন করে আবারও সাদ্দামের সংসার করার পক্ষে মতামত প্রকাশ করেন। এর একদিন পর এরশাদ তারশ্বশুর শহীদুল ইসলাম ও এলাকার হাজী সাইফুল ইসলাম রোকেয়াদের বাড়িতে আসেন। সেখানে এসে তারা রোকেয়াকে নষ্টা মেয়ে বলে আখ্যায়িত করেন। নানাভাবে বকাবকি ও হুমকিধামকি দিতে থাকেন। বলেন, সে তিনদিন ঘরের বাইরে ছিল। তাকে ঘরে তুলতে হলে ফতোয়া নিতে হবে। এক পর্যায়ে ওই তিনজনই ফতোয়া দেন যে, রোকেয়াকে তওবা করতে হবে এবং ৫১টি বেত্রাঘাত গ্রহন করতে হবে। তা না হওয়া পর্যন্ত তাকে এই বাড়িতে থাকতে দেওয়া হবে না এমনকি তাকে গ্রামছাড়া করা হবে। তাদের হুমকি ও চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত রোকেয়ার স্বামী সাদ্দাম ওশ্বশুর শাশুড়ি তাদের এই ফতোয়া মেনে নিতে বাধ্য হন বলে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন মফিজুল ইসলাম।

এদিকে ফতোয়া অনুযায়ী এলাকার মৃগীডাঙা গ্রামের মসজিদের ইমাম মওলানা আবুল খায়ের রোকেয়াকে তওবা করান। এসময় রোকেয়ার বাবা সেখানে উপস্থিত থেকে বাড়ি চলে যান। এর কিছুক্ষণ পর হাজী সাইফুল বেত নিয়ে এসে রোকেয়াকে আঘাত করতে শুরু করে। সাইফুলের হাত থেকে বেতটি কেড়ে নিয়ে এরশাদ নিজেই রোকেয়াকে এক এক করে ৫১টি বেত্রাঘাত করে। বিকট শব্দে কান্নাকাটি এবং চিৎকার করে বেত্রাঘাতে গুরুতর আহত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন গৃহবধূ রোকেয়া। এ অবস্থায় সাইফুল, এরশাদ ও শহীদুল ফের তাকে নষ্টা মেয়ে বলে গালিগালাজ করে ফিরে যায়। কান্নাকাটি ও তীব্র যন্ত্রনার মধ্যে রাত কাটানোর পর ১১ জুন সকালেই রোকেয়া খাতুনকে তার নিজ ঘরের আড়ায় ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়।

সাতক্ষীরা সদর থানায় খবর দেওয়ার পর পুলিশের এসআই স্বপন কুমার মন্ডলের উপস্থিতিতে রোকেয়ার লাশের সুরতহাল রিপোর্ট হয়। ময়নাতদন্ত শেষে তাকে দাফন করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে, সাতক্ষীরা সদর থানার উপপরিদর্শক স্বপন কুমার মন্ডল জানান, ময়নাতদন্তের পরও তিনি রোকেয়াদের বাড়িতে যেয়ে ফতোয়ার বিষয়টি তদন্ত করেছেন। আত্মহননের পেছনে এই ফতোয়া এবং বেত্রাঘাতের সাথে জড়িতরা রয়েছেন কিনা সেটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপরদিকে মেয়েকে হারিয়ে বাবা মফিজুল ইসলাম অত্যন্ত কাতর হয়ে আত্মহননে প্ররোচনাকারীদের বিচার দাবি করেছেন।

(আরকে/এসপি/জুন ১২, ২০২১)