আবীর আহাদ


বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পর্বভিত্তিক চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পাশাপাশি বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধা ও সন্তানদের মধ্য থেকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচনের দাবি উঠেছে। বিশেষ করে অতীতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা কমাণ্ডের সাথে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের মধ্যকাররাই এ দাবির উদ্যোক্তা। এ দাবিটিকে এগিয়ে নিতে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদেরও কেউ কেউ বেশ তৎপরতা চালাচ্ছেন। ফলে সংগতকারণে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচনের দাবিটি দিনকে দিন প্রবল হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয় কেনো ও কী কারণে এতোকাল সেই নির্বাচন স্থগিত করে রেখেছেন তা অনেকের কাছেই বোধগম্য ছিলো না। তবে সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা হয়তো এর পেছনের কারসাজিটা বুঝতে পারেন ।

মূলত: মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রের জুয়া ও অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর বিশাল বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে । বছর দুই আগে এক অভিযানে ক্যাসিনো বন্ধ হওয়ার ফলে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রের জুয়াও বন্ধ হয়ে গেছে । অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের কাজ প্রায় সমাপ্ত হওয়ার কারণে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বাণিজ্য প্রকল্পের কাজও গুটিয়ে এসেছে। অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃজনের পশ্চাতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাথে জড়িত অতীতের বিভিন্ন সময়ের মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল, জেলা ও উপজেলা কমাণ্ডের নেতৃবৃন্দ অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। এসব ভুয়ার কারিগর তাদের আয়কৃত অর্থ হালালসহ তাদের দ্বারা সৃষ্ট ভুয়াদের অবস্থান সংহত করার লক্ষ্যে নির্বাচনের জন্য তৎপরতা চালাচ্ছেন।

ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়ন কর্মযজ্ঞের সাথে জড়িত সরকারি পর্যায়ের সংশ্লিষ্টদেরও উদরপূর্তি ঘটেছে। ফলে এখন মুক্তিযোদ্ধা+অমুক্তিযোদ্ধা = মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রকাশ ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন দেয়াই যায়। এই নিরিখে গত বছর মুবিম মন্ত্রী বাহাদুর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর গত জানুয়ারি মাসে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা ইংগিত দিয়েছিলেন। যদিও মুক্তিযোদ্ধারা ফালতুকথা, মিথ্যাচার ও অতিকথনপ্রিয় মন্ত্রী বাহাদুরের কোনো কথার ওপর আস্থা রাখেননি। তারপরও কেনো জানি এবার সবাই একটু নড়েচড়ে বসেছে। পর্দার অন্তরালে, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেউ কেউ প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন নিয়ে তৎপরতা শুরু করে দিয়েছেন! আবার কেউ বিদেশে অবস্থান করেও তার অনুসারীদের নির্বাচনের পক্ষে জনমত সৃষ্টির ইংগীত দিয়ে নির্বাচনের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন । বেশকিছু উৎসাহী পর্যবক্ষেক ইতোমধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচনে বিশেষ করে কারা চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে পারেন, তা নিয়েও আগাম বায়বীয় আভাস-ইংগিত দিয়ে নানান জরিপকর্মও পরিচালনা করেছেন, যদিও চেয়ারম্যান প্রার্থীরা কেউ তাদের প্রার্থিতা সম্পর্কে এখনো মুখ খুলেননি।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিত্বশীল একটি বৃহত্তম সংগঠন তা বলার অপেক্ষা রাখে না । বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পাকা অফিসসহ বিভিন্ন হাট-বাজার ও বিভিন্ন সরকারি স্থাপনার সাথে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একটা অর্থনৈতিক সংযোগ আছে । সরকার বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধা মাসিক ভাতা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বিভিন্ন খাতে যৎকিঞ্চিত আর্থিক সহযোগিতাও করে থাকে, যেমন মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের লেখাপড়া, কন্যা সন্তানদের বিয়েশাদি, মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের দাফন কাফন প্রভৃতি । ফলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে কেন্দ্র করে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের মনেও একটা আগ্রহ রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন নিয়ে সংগতকারণে সংশ্লিষ্টরা বেশ তৎপর হয়ে উঠেছেন।

কিন্তু সবচে' বড়ো প্রশ্ন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন যে হবে, কিন্তু ভোটার কারা ? আমরা জানি, যেখানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দেড় লক্ষের নিচে, সেখানে সরকারি গেজেটে নাম আছে দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো। চূড়ান্ত তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কতো হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। ইতোমধ্যে তিন পর্বে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধা চূড়ান্ত তালিকার গতিপ্রকৃতি দেখে বুঝা যাচ্ছে যে, বিশালসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধা চূড়ান্ত তালিকায় থেকেই যাচ্ছে। অপরদিকে শহীদ ও মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ভোটার তালিকায় নাম না থাকার ফলে জীবিত মুক্তিযোদ্ধা তথা ভোটার সংখ্যা কতোতে দাঁড়াবে তাও আগাম বলা যাচ্ছে না।

আমাদের ধারণা, বিদ্যমান মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় কমবেশি পঁচাশি হাজার অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছে যারা তুলনামূলক একটু কমবয়সী এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল। তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার একটি বিরাট সংখ্যক শহীদ ও মৃত। সে-নিরিখে ভোটারদের মধ্যে হয়তো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বেশিই হবে। অমুক্তিযোদ্ধারা স্বভাবত: প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের রোষানলে থাকার ফলে অমুক্তিযোদ্ধা ভোটাররা তাই ঐক্যবদ্ধ । ফলে অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের অস্তিত্ব রজায় রাখার লক্ষ্যে তারা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে । তারা মনে করে, নির্বাচন হলে তাদের ভুয়াত্বের অপবাদ কেটে যাবে। বিশেষ করে উপজেলা/জেলা পর্যায়ের নির্বাচনে যারা প্রার্থী হবে তারা আর্থিকভাবে থাকবে স্বচ্ছল। অপরদিকে অমুক্তিযোদ্ধা যারা প্রাথী হবে, তাদের পক্ষে অমুক্তিযোদ্ধারাই ভোট দেবে । এর প্রভাবে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যে প্যানেল ভুয়াদের ব্যাপারে নমনীয় থাকবে বা ভুয়ার কারিগরদের প্রাধান্য থাকবে, সেই প্যানেলকে জিতিয়ে আনার লক্ষ্যে অমুক্তিযোদ্ধারা আদাজল খেয়ে নামবে । ফলে নির্বাচনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে যাবে বলে প্রবল শঙ্কা রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাসহ এদের কারিগররাও পার পেয়ে যাবে।

তবে যদি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অতীত নেতাদের দুর্নীতি, ভুয়ামি ও লুটপাটের কথা, তাদের নিজেদের বঞ্চনা ও আত্মমর্যাদার কথা স্মরণসহ অমুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের ক্ষোভকে যথাযথভাবে চেতনায় শানিত করে সত্যিকার অর্থে কোনো মুক্তিযোদ্ধাবান্ধব আদর্শবান সৎ ও সাহসী নেতৃত্ব তথা নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে পারেন, তাহলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ অমুক্তিযোদ্ধারা ঐক্যবদ্ধ হলেও, যেহেতু বেশ ক'টা কেন্দ্রীয় প্যানেল থাকবে, এ অবস্থায় অমুক্তিযোদ্ধা ভোটাররাও বিভিন্ন প্যানেলে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। এ প্রেক্ষিতে ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে একটা চেতনার উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। পাকিস্তানের প্রবল প্রতাপশালী সামরিক শক্তি, বেসামরিক আমলাতন্ত্র, আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক দল, ধনবান বাইশ পরিবারসহ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ও অন্যান্য সমাজশক্তির বিরুদ্ধে বাঙালিরা যেমন করে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের পক্ষে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে সেই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছিলো, তেমনি যদি প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা সর্বপ্রকার ভয় শঙ্কা ও লোভকে পদদলিত করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের মনোনীত নেতৃত্বের পক্ষে নেমে পড়েন, তাহলে তাদের বিজয়কে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না ।

তবে মোদ্দা কথা হলো, মুক্তিযোদ্ধা ভোটার তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধা ভোটার থাকলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন একটা তামাশায় পর্যবসিত হবে। এখানে নৈতিকতা, আদর্শ ও চেতনার প্রশ্ন জড়িত। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধাদের বহাল রেখে কোনো নির্বাচন যেমন সুষ্ঠু হতে পারবে না, তেমনি তাদের নিয়ে নির্বাচন করা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে অমুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেয়া হবে; বৈধতা দেয়া হবে, অমুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টির কারিগররাও স্বস্তি ফিরে পাবে, যা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি চরম অবমাননা।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।