চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : ‘জগৎ ও সমাজ যারা গড়ে তুলেছেন, তাঁরা যে সবাই প্রতিভাবান তা নয়। তাঁরা ছিলেন পরিশ্রমী, সহিষ্ণু ও সাধক বলেছিলেন-মোহাম্মদ লুৎফর রহমান।’ এটাই সত্য একজন কর্মঠ দায়িত্বশীল অফিসারই পারেন শ্রম ও সুদক্ষতার মাধ্যমে একটি উপজেলার আমূল পরিবর্তন করতে। তার বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী উপজেলা।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহিনা সুলতানার একের পর এক কার্যকরী উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে বদলে যাচ্ছে পুরো উপজেলার উন্নয়ন ও সামাজিক নানা চিত্র। তিনি ২০২০ সালের ১৬ জুলাই (বৃহস্পতিবার) চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সাক্ষরিত এক আদেশে ইউএনও হিসেবে কর্ণফুলী উপজেলায় পদায়িত হন।

আগামী জুলাই মাসের ৩০ তারিখ উপজেলায় এক বছর পুরণ হবে। তাঁর যোগদানের পর থেকেই উপজেলার বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড নবরূপে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে।

জানা গেছে, শাহিনা সুলতানা দেশে করোনা পেনডেমিক শুরু হওয়ার কয়েক মাস পর কর্ণফুলী উপজেলায় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কভিড-১৯ মোকাবিলায় পুরো উপজেলার তিনি ‘রক্ষাকর্তা’র ভূমিকায় উপনীত হন। রাতে কিংবা দিনে করোনাকালীন সময়ে তিনি মাঠ ছাড়েননি। জীবনের ঝুকি নিয়ে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় একের পর এক উদ্যোগ গ্রহণ করে শুরুতেই তিনি পুরো উপজেলায় তাক লাগিয়ে দেন। যদিও কাজ করতে গিয়ে কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে তাঁকেও হাসপাতালের শয্যা গ্রহণ করতে হয়।

নতুন উপজেলা এখনো গড়ে ওঠেনি অবকাঠামোগত নানা প্রতিষ্ঠান। নেই উপজেলা হাসপাতাল। তবুও সাধারণ মানুষদের রক্ষায় পিছপা হননি তিনি। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের নির্দেশে প্রতিটি হাট-বাজার ও ঘাটে মাস্ক বিতরণ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে লাগাতার অভিযান পরিচালনা করছেন।

এমনকি সরকার ঘোষিত মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে কর্ণফুলী উপজেলার ৫ ইউনিয়নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গড়ে তোলেন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার। সামাজিক দূরত্ব মেনে আয়োজন করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট (অনূর্ধ্ব-১৭) ও নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে উপজেলা চত্বরে দেশীয় পণ্য ও বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষায় নানা অনুষ্ঠান। পাশাপাশি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে উপজেলার প্রকৃত ভূমিহীন পরিবারকে গৃহ নির্মাণ ও ঘর উপহার প্রদান।

এছাড়াও সরকারি খাস জমি ও খাল প্রভাবশালী দখলদার হতে উদ্ধার, সরকারি সড়ক থেকে উচ্ছেদ করে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক প্রশ্বস্তশরণে বৃদ্ধি করেন। এমনকি উপজেলার সকল অফিসে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করে উন্নয়ন তরান্বিত করছেন। যার ফলে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে সকল উন্নয়নমূলক ফাইল তড়িৎ গতিতে হচ্ছে। পাশাপাশি সরকার গৃহিত নানা উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ যথাযথ তদারকি ও মনটরিং করে সঠিক সময়ে সমাপ্ত করে উপজেলাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

উপজেলা অফিসে মুক্তিযোদ্ধা ও নাগরিকদের বসার জন্য দৃষ্টিনন্দন ব্যবস্থাসহ কনফারেন্স রুম আধুনিকায়ণ করেন। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি নিরসনে কয়েকটি ইউনিয়নে বন্ধ থাকা জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম পুনরায় চালু ও সরকারি সেবাকে ডিজিটালাইজড করার নির্দেশনা প্রদান করেন। এমনকি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উপজেলার চাকরিপ্রার্থীরা আবেদন করতে গেলে উপজেলা হিসেবে কর্ণফুলীর নাম অন্তর্ভূক্ত না থাকায় বিপাকে পড়েন। পরে বিষয়টি ইউএনও শাহিনা সুলতানার নজরে আসলে তড়িৎ গতিতে তিনি মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে কর্ণফুলীর নাম সংযুক্ত করেন।

এমন প্রসংশনীয় বহু পদক্ষেপ এখনো চলমান রয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত বিষয় অনুমোদনহীন ও ভেজাল খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং বাজারজাতকরণের বিরুদ্ধে নিয়মিত বাজার মনিটরিং ও ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার কর্মকান্ডগুলো উপজেলার সাধারণ মানুষ স্বচক্ষে দেখে গোটা কর্ণফুলীবাসী উনাকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন। অনেকের দাবি, ইউএনও শাহিনা সুলতানা চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন তথা সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন।

এছাড়াও হাফেজখানা ও এতিমখানার শিশু, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক, শিক্ষার্থীসহ আগুনে পোড়া অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান তিনি। দক্ষতা ও সুনামের সাথে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সুযোগ পেলেই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

খবরের কাগজ কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো অসহায় মানুষের খবর আসলে ছুটে গিয়েছেন তাঁদের বাড়ি বা ডেকে এনেছেন নিজ কার্যালয়ে। যতটা সম্ভব প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নীরবে সহযোগিতা করেছেন প্রচারবিমূখ ইউএনও।

সংশ্লিষ্ট সুত্রেগুলো জানা যায়, উপজেলার চরপাথরঘাটা ও শিকলবাহায় আগুনে পুড়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে তাৎক্ষনিকভাবে সরকারি, ইউনিয়ন পরিষদ ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে সহযোগিতা করেছেন। ৫ ইউনিয়নের কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে সার ও বীজ বিতরণ ব্যবস্থা করেছেন।

ইউএনও’র এসব সাফল্যের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে উপজেলার নানা শ্রেণিপেশার মানুষেরা জানিয়েছেন, সরকারের একজন উচ্চপদস্থ দায়িত্বশীল প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং মানবসেবক হিসেবে ইউএনও শাহিনা সুলতানা ম্যাডাম অসাধারণ একজন ভালো মানুষ। কর্ণফুলীতে উনার আগমনের পর থেকে সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কারণ সরকারের অর্পিত প্রতিটি দায়িত্ব পেশাদারিত্বের সাথে তিনি সঠিক ভাবে পালন করেছেন। যার কারণে উপজেলার প্রতিটি গ্রামে গ্রামে সরকারের বরাদ্দ সূষমভাবে বন্টন হয়েছে এবং মানুষের দুয়ারে সরকারের উন্নয়ন পৌঁছেছে। উনার ভালোবাসা এবং সততায় উপজেলার আপামর জনসাধারণ মুগ্ধ, যা দেশরতœ প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করার সহায়ক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। ফলে ধীরে ধীরে মডেল উপজেলায় রূপ পাচ্ছে কর্ণফুলী।

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহিনা সুলতানা বলেন, ‘আমি কর্মে বিশ্বাসী। এসব আমার রুটিন কাজ। আমার দায়বদ্ধতা থেকেই এ সকল উন্নয়নমূলক কাজ করছি। এসব কাজে স্থানীয় সংসদ সদস্য মাননীয় ভূমিমন্ত্রী মহোদয়সহ সকল জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দরা আমাকে সহযোগিতা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ভালো কাজ করলে সবাই সহযোগিতা করেন। ভবিষ্যতেও যেনো এ ধারা অব্যাহত থাকে।’
তিনি আরো বলেন, ‘কর্ণফুলী উপজেলায় প্রথম নারী ইউএনও হিসেবে যোগদান করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। আমি এই চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেছি। সবার সহযোগিতা নিয়ে আমি আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে চেষ্টা করছি। এই উপজেলা ছেড়ে যাওয়ার সময় যেন সবাই বলতে পারেন তিনি পুরুষের চাইতে কোনো অংশেই কম ছিলেন না।

প্রসঙ্গত, কর্ণফুলীর উপজেলার প্রতিষ্ঠাকাল ২০১৬ সালের ৯ মে। উপজেলার প্রথম নারী ইউএনও শাহিনা সুলতানা। এর আগে চারজন পুরুষ নির্বাহী কর্মকর্তা এই উপজেলায় যোগদান করলেও প্রথমবারের মতো একজন নারী নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ছিলেন একমাত্র তিনি।

চট্টগ্রাম জেলার গুরুত্বপূর্ণ এই উপজেলায় দেশের স্বনামখ্যাত বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান অবস্থিত। প্রায় সময়ই এই উপজেলা হয়ে ভিআইপিরা যাতায়াত করেন। এ কারণে এ উপজেলাকে ‘প্রটোকল এরিয়া’ ও বলা হয়। নারী ইউএনও হিসেবে এই দায়িত্বপালনও শাহিনা সুলতানার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন স্থানীয় অনেকেই।

চাকরি জীবনে এর আগে ইউএনও শাহিনা সুলতানা বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন (২০১০-২০১৫), ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং এন্ড ইভালুশন ডিভিশনে (২০১৫-২০১৬) রুরাল ডেভালাপমেন্ট এন্ড কো-অপারেটিভ ডিভিশন (২০১৮-২০২০) পরবর্তীতে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (সিনিয়র সহকারী সচিব) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

শিক্ষাগত জীবনে তিনি গরীবে নেওয়াজ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, পরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ২৮তম বিসিএস এর কর্মকর্তা ও নিজ জেলা কুমিল্লা।

(জেজে/এসপি/জুন ১৪, ২০২১)