সাইফুল ইসলাম


কতিপয় নবীন আর প্রবীণ একত্রিত হতে শুরু করে। বয়সের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে জমে ওঠে তুমুল আড্ডা। সবই চলছে, কিন্তু কেমন যেন ঠিকঠাক মতো চলছে না। দেশের উন্নয়ন, মুক্তিযুদ্ধের চর্চা, প্রগতিশীল রাজনীতি- কোনও কিছুই যেন মনের মতো হচ্ছে না। ওরা যেভাবে চায় তা যেন ঠিক হচ্ছে না। ওরা কেমন চায়? কেন তা হচ্ছে না? নিজেরাই প্রশ্ন করে নিজেদের। সবাই একমত হয় যে মনের মতো করতে চাইলে একটা কিছু করা দরকার। একটা কিছু করতেও চায় ওরা। আবার জমে ওঠে তুমুল আড্ডা, তর্ক-বিতর্ক। কিন্তু মীমাংসায় পৌঁছতে পারে না। -কী করা যায়, কী করা দরকার- সে ব্যাপারে একমত হতে পারে না কেউ। কেউ বলে- সমাজ বিপ্লব ছাড়া এর কোনো সমাধান নেই। কারো মতে- সমাজতন্ত্র, সাম্যাবস্থা ছাড়া কোনো মীমাংসা খুঁজে পাচ্ছি না, আর সেটা করতে হলেও একটি সঠিক রাজনৈতিক দল দরকার, সে দল গড়ে ওঠার তো কোনো লক্ষ্মণও নেই! কেউ বলে- নেতা কোথায়, কার ডাকে এসব হবে? এত্তোবড় একটা স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়ে গেল, তিরিশ লক্ষ মানুষের জীবন, তিন লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারালো, তাই এদেশের মানুষের আক্কেল হলো না; এদেশের মানুষের আর কবে আক্কেল হবে! এদেশ আর ঠিকঠাক মতো চলবে না! তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাও আর এ দেশে জন্মাবে না, তাই কার ডাকে আর দেশ ঠিক হবে? যে ভাবে চলছে সে ভাবেই চলবে। কারও আবার টিপ্পুনি কাটা- আশি মন তেলও জুটবে না, রাধাও নাচবে না, তাই আকাশ-কুসুম ভেবে লাভ নেই। কিন্তু সবাই একটা কিছু করতে চায়। দেশের জন্য, দশের জন্য একটা ভালো কিছু করতে চায়।

তাই, আবার আলোচনা। তুমুল আড্ডা। অবশেষে নানা মত-পথকে সামনে রেখে আড্ডায় সিদ্ধান্ত হয়- বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ। ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করব। আর কোনো বিতর্ক নয়। বিতর্ক চলতে থাকলে আমরা সিদ্ধান্তই নিতে পারব না। দ্বিমত মাথায় থাকুক, আলোচনা করে মীমাংসা করব। এখনই আমরা পথে নামব, কী কাজ করব, কী ভাবে কাজ করব তা-ও কাজে নামলে পথই বলে দেবে। আপাতত সিদ্ধান্ত আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করব। নামলেই পথ বেরিয়ে পড়বে।’ এ ভাবেই নিজেদের মধ্যেকার ধারণাগুলোকে স্পষ্ট না করেই ২০১৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জে গঠিত হয় একটি অনুসন্ধান কমিটি। সংগঠকেরা নানা দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখবে মুক্তিযুদ্ধকে, প্রয়োজনে যার যার দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই। কেউ কারো ওপর চাপিয়ে দেবে না নিজস্ব মতামত। নানা চিন্তার মিথস্ক্রিয়া থেকে একটা পথ বের হবেই।

শুরুটা সাদামাটা কাজ দিয়ে। প্রথম কর্মসূচি ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালন। এই গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বেশ আগে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে। দিবসটি নানা ভাবে পালিতও হয়ে আসছে। তারা পালন করতে চায় একটু ভিন্নভাবে। দিবসটি পালন করতে গিয়ে অভিজ্ঞতা হবে, সে অভিজ্ঞতা অর্জন করে নতুন কর্মসূচি নেওয়া যাবে। সিদ্ধান্ত হয়, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে ওইদিন সন্ধ্যায় যতগুলি গণহত্যা স্থানে যোগাযোগ গড়ে তোলা সম্ভব হবে, ততগুলি স্থানের চারপাশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হবে। গণহত্যা স্থানে স্থানীয় জনগণ মোমবাতি জ্বালিয়ে শহিদদের স্মরণ করবে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে অর্থের যোগান দেবে কে? লোক আনবে কারা? স্থানীয় জনগণই হবে এসব কিছুর জোগানদাতা। কারণ, বর্তমান রাজনীতিতে অর্থের জোগানদাতারা যেহেতু এ নিয়ে বাণিজ্য করতে পারে, তাই সব কর্মকাণ্ড হবে গণনির্ভর, এমনকি কোনও স্বেচ্ছাসেবি সংস্থা নির্ভরও নয়। এ কথায় কেউ কেউ হতাশ হয়। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে কর্মসূচির আগেই চিন্তা করা হয় অর্থের। কিন্তু কিছু সংগঠক লেগে থাকে। যারা লেগে থাকে তারা কয়েকটি গণহত্যা স্থান ও তার আশপাশ এলাকায় শুরু করে সাধারণের সাথে যোগাযোগ। বিপুল সাড়া দেয় শহীদ পরিবারগুলো। বিজয়ের পর এসব শহীদ পরিবারের কোনো কোনো পরিবারকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমবেদনা জানিয়ে তাঁর স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দিয়েছিলেন। সে চিঠি অনেকেই রেখে দিয়েছেন পরম যত্নে। যারা চিঠি পেয়েছিলেন, তাদের সকল পরিবারকে দুই হাজার করে অর্থও দেওয়া হয়। তারপর আর কেউ শহিদ পরিবারের খোঁজ নেয়নি দীর্ঘদিনেও। তারা দাবি তোলে, এসব শহিদ পরিবারকে দেওয়া হোক শহিদের মর্যাদা, যে মর্যাদা রয়েছে শুধু রাজনৈতিক নেতাদের ‘তিরিশ লক্ষ শহিদের বিনিময়ে’ বক্তৃতায়। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী অনুসন্ধান কমিটি স্লোগান তোলে, ‘গণহত্যায় নিহতদের শহিদের মর্যাদা দাও।’ এভাবেই অনুসন্ধান কমিটির কাছে চলে আসে একটি স্লোগানও।

কোনো কোনো গণহত্যা এলাকা থেকে প্রস্তাব করা হয়, সংশ্লিষ্ট এলাকায় সংঘটিত গণহত্যায় নিহতদের তালিকা সংগ্রহ করে তা জনসমক্ষে টাঙ্গিয়ে দেওয়ার। সাধারণ মানুষ নিজেরাই তালিকা সংগ্রহ করে নিজেদের অর্থায়নে ডিজিটাল সাইন করে বাজারে বা তেমাথা চৌরাস্তার মোড়ে লাগিয়ে দেয়। সে ডিজিটাল সাইন দেখে বেরিয়ে আসে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি। তারা প্রশ্ন করে, গণহত্যায় নিহত হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শহিদ হিসেবে চিহ্নিত হবে কি-না? এর জবাব দিতে জনগণের প্রগতিশীল শক্তি এগিয়ে আসে। তারা উত্তর দেয়, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তার দোসরেরা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টানকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। তাই ঘাতকের হাতে যারাই নিহত হয়েছেন, তারাই শহিদ। জনগণের প্রতিবাদে লেজ গুটিয়ে পালায় সাম্প্রদায়িক শক্তি। সিরাজগঞ্জের চুনিয়াহাটি-তেতুলিয়া এলাকায় পাওয়া যায় একটি স্কুলের দেওয়ালে লেখা ১৪ জনের শহিদের তালিকা। কিন্তু সে তালিকায় লেখা মুসলমান ১১ জনের নামের পাশে ‘শহিদ’ এবং অন্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নামে পাশে ব্যবহার করা হয়েছে ‘স্বর্গীয়’ শব্দ। এভাবেই শহিদের তালিকা প্রণয়নেও আনা হয়েছে বিভক্তি। এটি উদ্বোধন করেছেন চার দলীয়জোট সরকারের এক প্রতিমন্ত্রী ২০০৫ সালে। প্রায় এক যুগ পরে সেখানেও বিতর্ক ওঠে এটা নিয়ে। লজ্জা পায় ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। ২০১৮ সালের মার্চের শুরুতেই তারা দ্রুত ওই দেয়াল মুছে নতুন করে শহিদের তালিকা লিখে ফেলে। উদ্যোগ নেয় নতুন চেতনায় ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস এবং ২৬ মার্চ বিজয় দিবস পালনের।

২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যুক্ত হতে শুরু করে সাধারণ মানুষ। বিরূপ সমালোচনাকারীরা স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকে। কেউ অর্থ দেয় শহিদের তালিকার নিয়ন সাইন প্রকাশে, কেউ কায়িক শ্রম দিয়ে সহযোগিতা করে। কেউ মোমবাতি কিনে দেয়, কেউবা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের হাতে গুঁজে দেয় মোমবাতি কেনার এক/দুই শ’ টাকা। এভাবেই এগিয়ে আসে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস। স্বতঃস্ফূর্তভাবে লোকজন চলে আসে গণহত্যা স্থানে। কেউ কেউ মোমবাতি নিয়ে আসে। কর্মসূচি পালনে অর্থের সংস্থান হয়ে যায় এভাবেই। প্রমাণ হয়, যে কোনও কর্মসূচি পালনে অর্থ নয়, উদ্যোগটাই প্রধান। ২৫ মার্চ ২০১৮ সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ পরিবারের সদস্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও সিরাজগঞ্জের অন্তত ১০টি গণহত্যা স্থানে যোগদান করেন শহিদ স্মরণের গণহত্যা স্থানে মোমবাতি প্রজ্জলন অনুষ্ঠানে। অভিজ্ঞতা হয়, মুক্তিযুদ্ধের যে কোনও ডাকে সাড়া দিতে জনগণ এখনো প্রস্তুত। অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয় উদ্যোক্তারা, শক্তি বাড়ে আগামী দিনের পথ চলায়। [চলবে]

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক।