আবীর আহাদ


১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মাতৃরূপে ভূমিকা পালনকারী ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী নিজের মনের কাছে তিনটি অঙ্গীকার করেছিলেন। সেগুলো হলো, তাঁর ভাষায় ১.হাম মুক্তিবাহিনীকো সহায়তা করেঙ্গে, ২. হাম শরণার্থীকো উনকো স্বোয়াধীন দেশমে ওয়াপাস দেলায়েঙ্গে, আওর ৩. হাম শেখ ছাহাবকো জেলছে ছুটায়েঙ্গে।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করে লণ্ডন গমন করেন। লণ্ডন থেকে ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি দিল্লিতে যাত্রা বিরতি করেন। দিল্লি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে এক বর্ণাঢ্য রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকে প্রদত্ত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় তাঁর সেই মনের তিনটি অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করে আবেগঘন বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন : হাম হামারি তিনো ওয়াদা পূরাণ কিয়া।

আমরা, বাংলাদেশের মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধারা, আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের বন্ধুপ্রতিম জনগণের অকৃত্রিম বদান্যতার প্রতি কি কোনো ওয়াদা বা অঙ্গীকার করেছিলাম ? বঙ্গবন্ধুই সেদিন বলে এসেছিলেন : 'রিক্ত আমি ছিন্ন আমি দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই'

আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমাদের ভালোবাসা শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ কি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নামে ঢাকায় একটি যথোপযুক্ত স্মৃতিস্থাপনা করতে পারি না ? এ উপলব্ধি থেকে আমার উদ্যোগে ২০০৪ সালের বিজয় দিবস উপলক্ষে ঢাকার পল্টনস্থ মুক্তাঙ্গনে তিনদিনব্যাপী মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের একটি অনুষ্ঠান হয় । উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিশেবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি। এখানে উল্লেখ্য যে, তখন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায়। মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চে ভারতের হাইকমিশনারকে আমন্ত্রণ জানানোতে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখা থেকে আমাকে ডেকে একটু মিষ্টি হুমকি দিয়ে বলা হয় যে, সরকার বিষয়টি ভালো চোখে দেখছে না । আমি দৃঢ়ভাবে উত্তর দিয়ে আসি, অনুষ্ঠান হবে এবং বীণা সিক্রিও আসবেন।

আমাদের দৃঢ় অবস্থান বুঝতে পেরে সরকার পররাষ্ট্র সচিবকে দিয়ে বীণা সিক্রিকে অনুষ্ঠানে আসতে নিরুৎসাহিত করেন। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীতে বীণা সিক্রি আমাকে বলেছিলেন : বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব অনুষ্ঠানের দু'দিন আগে তাঁর দপ্তরে আমাকে চায়ের আমন্ত্রণ জানান। নানান কথার ফাঁকে তিনি বলেন, লণ্ডনের স্পিকার্স কর্ণারের মতো আমাদের একটি মুক্তাঙ্গন রয়েছে। সেটি আর ব্যবহৃত হয় না। ফলে সেখানে বারবণিতা ও মটর ড্রাইভাররা আড্ডা মারে। তাস ও মাদকের হাট বসায়। যত্রতত্র মলমূত্র পরিত্যাগ করে। এছাড়া চারপাশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। পুরো অঙ্গনটি দুর্গন্ধময়। ওখানের পাশ দিয়ে গেলেও নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

পররাষ্ট্র সচিবের কথা শেষ না হতেই আমি (বীণা সিক্রি) হেসে বললাম : আমাকে ওখানকার অনুষ্ঠানে যেতে নিরুৎসাহিত করছেন তো ? কিন্তু আমি যাবো। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের যেখানে ডাকবে আমরা সেখানেই যাবো, হোক না সেটা কোনো দুর্গম বা দুর্গন্ধযুক্ত স্থান : না না না----পররাষ্ট্র সচিব মুচকি হেসে নিচু স্বরে বললেন, আপনাকে আমরা কোথাও যেতে নিষেধ করছি না, তবে ওখানকার পরিবেশের কথাটি স্মরণ করিয়ে দিলাম আর কি।

আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সাবেক সেনাপ্রধান মুক্তিযুদ্ধের ৩ নং সেক্টর ও এস-ফোর্স কমান্ডার মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ (অব:) বীরউত্তম, এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার (অব:) বীরউত্তম, কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী, প্রয়াত জননেতা আবদুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত জননেতা আবদুল জলিল, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আআমস আরেফিন সিদ্দিক, ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার সর্বজিত্ চক্রবর্তী, আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক ক্যাপটেন এবি তাজুল ইসলামসহ বহু বীর মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকসহ বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও জনতা উপস্থিত ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে আমরা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে একটি ক্রেস্ট উপহার দেই। আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও মুক্তিযুদ্ধ নিহত মিত্রবাহিনীর সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ তাঁদের জন্যে ঢাকায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানাই। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ক্রেস্ট গ্রহণ করে বীণা সিক্রি অশ্রুসজল চোখে বলেন, আমি ভারতের সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। তিনি ঘোষণা করেন, আমি ভারত সরকারকে প্রতি বছর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও তাদের সন্তানদের জন্য একটি শিক্ষা সহায়তা বৃত্তি প্রদানের সুপারিস করবো। ঠিক পরের বছর থেকে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির প্রচলন করেন যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

বীণা সিক্রির পরামর্শে জেনারেল কে এম সফিউল্লাহকে চেয়ারম্যান, অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভূমিকাকে সদস্য সচিব, কর্নেল শওকত আলী, মাহবুবউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, লেখক আবীর আহাদ, এডভোকেট হাবিবুর রহমান শওকত (প্রয়াত), মো: সালাহউদ্দিন, আবদুস সামাদ পিন্টু, শাজাহান কবীর বীরপ্রতীক ও কাজী আসগর আলীর সমন্বয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা ফাউণ্ডেশন নামক একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। প্রাথমিক দু'বছর এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা নবম শ্রেনী থেকে মাস্টার্স পড়ুয়া মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের ভারত প্রদত্ত শিক্ষা সহায়তা বৃত্তি প্রদান করি। এরপর থেকে ভারতীয় দূতাবাস নিজেরাই এ বৃত্তির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেযা এখনো চলমান রয়েছে।

আমরা মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের অঙ্গীকার অনুযায়ী বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সেই থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর নিহত সদস্যদের স্মরণে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পশ্চি-উত্তর কোণে একটি অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে প্রতি বছর ৬ ডিসেম্বর ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান দিবসে সেখানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করার একটি প্রথার প্রচলন করেছি।

এছাড়া বীণা সিক্রির সুপারিশে সাড়া দিয়ে ভারত সরকার প্রতি বছর বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি করে দলকে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামস্থ ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা প্রদানের কর্মসূচী প্রচলন করেন যা বর্তমানেও চলমান রয়েছে। ২০০৫ সালে প্রথমবারের মতো মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার বীরউত্তমের নেতৃত্বে আমাদের ৬০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়ে সেই রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের গোড়াপত্তন করা হয়। প্রথম সেই দলে আমিও ছিলাম। সত্যি বলতে কি এ উপলক্ষে অধ্যাপক নিমচন্দ্র ভৌমিক ও আমাকে বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হয়।

ভারত সরকারের পক্ষে ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি-ইন-সি জেনারেল অরবিন্দ শর্মার সার্বিক তত্ত্বাবধানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিম বাংলার গভর্নর মহাত্মা গান্ধীর নাতি শ্রী রাম গোপাল গান্ধী। বিশেষ অতিথি ছিলেন কংগ্রেস নেতা (সাবেক রাষ্ট্রপতি) শ্রী প্রণব মুখার্জি। কতিপয় মন্ত্রী এবং বিধান ও লোকসভার সদস্যরাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ভারত সবকিছু নিয়ে '৭১ যেমন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো, সেই ধারাবাহিকতার অংশ হিশেবে এখনো ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান ও তাদের পক্ষে যতোটুকু কল্যাণ করে যাচ্ছেন। এমনকি প্রতি বছর ১০০ মুক্তিযোদ্ধাকে বিনামূল্যে ভারতে চিকিৎসা সেবা প্রদানেরও ব্যবস্থা করেছে। ভারতের এসব বদান্যতা অবশ্যই আমরা পরম কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো। ১৯৭২ সালে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিল্লিতে ভারতবাসীর উদ্দেশে ঐ যে বলে এসেছিলেন : আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই !' আমাদেরও কথা এটাই।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।