আবীর আহাদ


রাষ্ট্রক্ষমতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত বেশকিছু মানুষ আছেন যারা মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু দয়াদক্ষিণা দিয়ে তারা অনেক পুণ্যের কাজ করে ফেলেছেন এটাই তো বড়ো সম্মান! আর সম্মান দেয়ার কী আছে? কিসের সাংবিধানিক স্বীকৃতি? তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে চাই, যারা এসব বলেন, ভাবেন, তারাই বা মুক্তিযুদ্ধের সময় কী ভূমিকা রেখেছেন? মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সব সামর্থ্য থাকলেও জীবনের মায়ায় তারা মুক্তিযুদ্ধে যাননি। অনেকে বৌ বা স্বামী নিয়ে নিরুদ্বিগ্নে সংসার করেছেন। পাকি সরকারের হুকুম তালিম করে অনেকে চাকরি করেছেন, মজাসে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। অনেকে পাকিদের সবরকম খেদমতও করেছেন; মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারকে তাদের হাতে ধরিয়েও দিয়েছেন।

দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর তারাই বিভিন্ন সময় অর্থ , রাজনৈতিক শক্তি ও আত্মীয়তার জোরে মুক্তিযোদ্ধাও সেজেছেন। আর আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো অনেকে মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন! যে প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা বানানো হচ্ছে তাতে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা বানানো হতে থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সংজ্ঞা ও সুরক্ষা আইন না থাকার ফলে যত্রতত্র যে-কেউ অর্থের বিনিময়ে, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ১ লক্ষ ৫০ হাজারের নিচে। কিন্তু সরকারি তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কমবেশি ২ লক্ষ ৩৫ পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো। সে হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ৮০/৮৫ হাজারই অমুক্তিযোদ্ধা! এর মধ্যে বিরাট সংখ্যক রাজাকাররাও ঠাঁই পেয়েছে । বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তারা অমুক্তিযোদ্ধাসহ রাজাকারদের যেমন মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগ সরকার একনাগাড়ে আজ বারো/তেরো বছরেও দেদার অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় যাচাই বাছাই হলেও সেই অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় তেমন ভুয়া অপসারণ হচ্ছে না। এ পর্যন্ত প্রকাশিত চারপর্বের তালিকার ধরন দেখে এটা বুঝা যাচ্ছে।

স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংজ্ঞা প্রদান করেন। সেই সংজ্ঞায় বলা হয়েছিলো : "মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি যেকোনো একটি দলের (ফোর্স) অন্তর্ভুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।" এ সংজ্ঞাটি ছিলো সত্যিকার অর্থে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংজ্ঞা। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা মানেনি, তেমনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও মানছে না। কেনো মানছে না, তার কারণ আগেই বর্ণনা করা হয়েছে ।

মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের দাবিতে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে আমরা সর্বপ্রথম একটি আন্দোলনের সূত্রপাত করি। সেই আন্দোলনের প্রয়োজনে আমরা বিভিন্ন সময় সভা, সমাবেশ, আলোচনা সভা, মতবিনিময় সভা, সংবাদ সম্মেলন, অবস্থান কর্মসূচি, পদযাত্রাসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করেছি। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সঠিকভাবে প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি উচ্চতর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশও পেশ করেছি। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার কোনোই প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে না।

আর ইদানিংকালে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সরকারের অবহেলা ও আচরণসহ সারা দেশে সরকারি দলের সমর্থকরা যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারবর্গের ওপর হত্যা হামলা মামলাসহ অত্যাচার করে চলেছে, তাতে সরকারের মধ্যেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জলাঞ্জলি দেয়ার শেষ পরিণতি হিশেবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকমহল অভিমত ব্যক্ত করেছেন! আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে, দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও রাজাকার চেতনাধারীদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে দেশ পরিচালনার যে সর্বনাশা কর্মযজ্ঞে লিপ্ত হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার একটি অপমৃত্যু সংঘটিত হওয়ার সমূহ সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে।

মুক্তিযোদ্ধারা দেশটি স্বাধীন করেছিলো বলেই যারা যা কল্পনাও করেননি তারা তাই হয়েছেন। রাষ্ট্রক্ষমতা খাটিয়ে ঘুষ-কমিশন খেয়ে, ভুয়া প্রকল্প বানিয়ে প্রতারণার আশ্রয়ে অনেকে শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে চলেছেন। অনেকে যে জীবনে বেঁচে থেকে এতসব অর্জন করলেন রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী বিচারপতি স্পিকার মন্ত্রী এমপি সচিব জেনারেল ব্যবসায়ী শিল্পপতিসহ অন্যান্য সবকিছুই হয়েছেন হচ্ছেন ও হবেন এটাও কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দয়ার দান।

তবে একথাও ঠিক, তাদের অনেকেই গালভরা শ্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জয়গান করেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা ও তাদের দাবিদাওয়া সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও একটি কথা বলেন না, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করেন না। এরা আসলে প্রতারক। দ্বিচারী ও বর্ণচোরা । সুবিধাবাদী । মুখোশধারী । মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তাদের অন্তরে বিষ! তারা মনে করে, দরিদ্র ও অশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা হবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতীয় বীর? এটাই তাদের গাত্রদাহ। পরশ্রীকাতরতা। হিংসা। অথচ মুক্তিযুদ্ধের নামে ক্ষমতা এবং ক্ষমতায় থেকে দু'হাতে লুটপাটই তাদের লক্ষ্য।

রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদেরও একটি আদর্শ আছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মুখোশধারীদের আদর্শ বলতে কিছু নেই। পরশ্রীকাতরতায় আক্রান্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান-দলন এবং মুক্তিযুদ্ধের নাম ব্যবহার করে ক্ষমতায় বসে দুর্নীতি-লুটপাট করাই তাদের আদর্শ। মূলত: এরা রাজাকারদের চাইতেও নিকৃষ্ট মনের অধিকারী!

যতোদিন সমাজ ও রাষ্ট্রে এ-ধরনের মুখোশধারী প্রতারক ও বর্ণচোরারা থাকবে, ততোদিন এ-সমাজে, এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা নেই। দেশের উন্নয়নের নামে লুটেরাদের উন্নয়ন হবে। জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন হবে না। নৈতিকতা ও চরিত্রের উন্নয়ন হবে না।

দেশের জনগণ, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত যুবসমাজসহ সমাজশক্তিকে সর্বাগ্রে সংগঠিত হয়ে এই প্রতারক ও বর্ণচোরারাদের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এদেশটি সবার। মুক্তিযোদ্ধারা দেশটি স্বাধীন করে দিয়েছেন, তারা এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, তারা আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে দুর্বল। শুধু তাদের দিকে চেয়ে থাকলে চলবে না। একজীবনে সবকিছু হয় না। তারপরও তো মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে কলম ও সাংগঠনিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন যুবসমাজ ও সমাজশক্তির দায়িত্ব হলো দেশটাকে স্বাধীনতাবিরোধী, মুখোশধারী প্রতারক ও লুটেরাদের কবল থেকে উদ্ধার করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারে পরিচালিত করা ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।