নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


আমাদের সমাজে দিনদিন ব্যাপকভাবে বেড়ে চলছে পারিবারিক অসহিষ্ণুতা। আর এর কুফল সমাজ ব্যবস্থায় আঘাত হানছে চরমভাবে। এর মূল কারন পারিবারিক বিভেদ যেটা আমাদের ভাবিয়ে তোলছে। সবচেয়ে বড় কথা সমাজ ও পরিবারের প্রতি আমাদের যে দায়বদ্ধতা সে জায়গায় ব্যাপক ফাটল ধরেছে। এবং এই ফাটলটা দিন দিন বেড়েই চলছে। আমাদের শিক্ষার মূল জায়গা হলো আমাদের পরিবার। পরিবার একটি চিরস্থায়ী সামাজিক সংগঠন। আর একটি পরিবারের মাঝে সবচেয়ে আশার বিষয় থাকে পারিবারিক বন্ধন।

পারিবারিক বন্ধন হলো পরিবারের সকল সদস্যদের মধ্যে তৈরি হওয়া আবেগীয় সম্পর্ক। পারস্পরিক বিশ্বাস, স্নেহ, ভালোবাসা, সম্মান, আস্থা ইত্যাদি পারিবারিক বন্ধনের ভিত্তি। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় না হলে পরিবারের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ে যার ফলে সমাজ ব্যবস্থা দুর্বল হয় এবং তৈরি হয় সামাজিক অস্থিরতা। মানবজাতির বিকাশ লাভের সাথে সাথে সমাজের অগ্রগতি ও পরিবারের রুপ এবং কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। এর পরে রয়েছে সামাজিক অবস্থান। মানুষ সামাজিক জীব।

প্রাচীনকাল থেকেইে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে আসছে। সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করাই মানুষের ধর্ম। সমাজ মূলত একটি সংগঠন বিশেষ। যান্ত্রিক সভ্যতার অগ্রগতি, শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার বর্তমান সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এর ফলে সমাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় অনুশাসন প্রভৃতির মাঝেও এ পরিবর্তন ঘটেছে। আর পরিবার দ্বারা সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই পরিবারের এ পরিবর্তনের ফলে সমাজে ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়েছে। সমাজের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ঘটেছে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে। তাই একথা বলা যায় সুষ্ঠু পারিবারিক জীবনই সমাজ রাষ্ট্রের মূলভিত্তি। পরিবার এবং সমাজব্যবস্থার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় একটি সুশীল সমাজ আমরা পেয়ে থাকি। আর তার সাথে জড়িত থাকে শিক্ষা।

পরিবার এবং সমাজ ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত আমাদের সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের বিপরীত দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেই সাথে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রক্রিয়াটাও তাল মেলাচ্ছে। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের অবদান অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই কিন্তু এই সুযোগ আমরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে কিরুপ ব্যবহার করছি ? পারিবারিক ও সামাজিক যে শাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে তা আমরা ক্রমান্বয়ে হারিয়ে ফেলছি। যার ফলে সমাজ ব্যবস্থায় এই বিশৃংখলা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা নিজেদের এতই ব্যস্ত করে তোলছি যে সামাজিকভাবে ব্যয় করার জন্য একটু সময়ও রাখছি না। সম্প্রতি কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করে লেখার প্রয়োজনীয়তা আলোকপাত করা যেতে পারে।

বাংলা চলচ্চিত্রের খ্যাতনামা নায়িকা ও সাবেক সংসদ সদস্য কবরী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মারা যাওয়ার পর তার একটি সাক্ষাৎকারের একটু অংশ ভাইরাল হয়। তিনি এরকম বলেছিলেন যে, জীবনে ভালো একজন বন্ধু পেলাম না, ভালো একজন স্বামী পেলাম না, সন্তানরাও যে যার মতো! কারো সাথে বসে এক কাপ চা খাবো, মনের কথা খুলে বলব- তা পেলাম না।“ বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর” লেখক, খ্যাতনামা কলামিস্ট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক তারেক শামসুর রাহমানের লাশ নিজের বাসা থেকে দরজা ভেঙ্গে উদ্ধার করা হয়েছে। বাসায় তিনি ছিলেন একা। স্ত্রী ও কন্যা আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। অসুস্থ্য ও মৃত্যুর সময় কেউ ছিল না পাশে এবং মারা যাওয়ার বিষয়টি কেউ জানেনি কিছু।এ

ক করোনা রোগী সুইসাইড নোট লিখে মুগদা হাসপাতাল থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি লিখে গেছেন, নিজের একাকিত্বের কথা। টাকা ছিল কিন্তু আত্মীয় -স্বজন, বন্ধু ছিল না কাছে। পরিবারও আত্মীয়দের সবাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশে! একাকীত্ব সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন বলে লিখে গেছেন। এর প্রত্যেকটি বিষয়ই হৃদয়স্পর্শী যা সমাজ ও পরিবারকে কঠোরভাবে আঘাত করেছে। তিনটি ঘটনা উল্লেখ করার পর অস্বীকার করার কোন সুযোগ থাকে না যে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে একাকিত্ব হওয়ার প্রবণতা। কিন্তু কেন একাকিত্ব ? কেবলই ভালো থাকার আশা নাকি সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করার একটি প্রক্রিয়া।

উল্লেখিত তিনটি বিষয় যখন মিডিয়াতে আসে ক্ষণিক সময়ের জন্য কিছুটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তা আবার হারিয়ে যায়। এসব ঘটনা হারিয়ে গেলেও এই লেখাগুলো সমাজ এবং রাষ্ট্রকে যে ম্যাসেজ দিয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু অনেক জটিল ও এর ফলাফল আমাদের জন্য ভয়ানক বার্তা দিচ্ছে। জীবনের এসব ক্ষতবিক্ষত বিষয়গুলো রাষ্ট্রের পক্ষে আইনের মাধ্যমে সমাধান করা কি আদৌ সম্ভব ? এক সময় বৃদ্ধাশ্রমের কথা শুনলেই আতকে উঠতো মানুষ কিন্তু এখন আর সে অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত ভালো ও বড় হওয়ার আশায় মানুষ পরিবারের বন্ধন ছিন্ন করছে । কিন্তু আমরা অর্থনৈতিকভাবে বড় হলেও হারিয়ে ফেলছি মানবিকতার জায়গাটুকু। যারা ফলে তৈরি হচ্ছে বন্ধন ছিন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া। বিষয়গুলো ক্ষণিক সময়ের জন্য নাড়া দিলেও কিছু সময় পর সে অবস্থায় চলে যাচ্ছে।

একসময় চিঠির মাধ্যমে একজনের খবর আরেকজনের খবর নিলেও এখন মোবালেই হ্যালো বলার পর্যন্ত সময় হচ্ছে না। প্রশ্ন হলো এ কি শুধু সময়ের অভাব নাকি অন্য কোন বিষয় জড়িয়ে আছে এর সাথে। একটু যাচাই বাছাই করলে দেখা যাবে এর সাথে কেবল সময়ই জড়িত নয়। আমরা আমাদের প্রজন্মকে মানবিকতার শিক্ষাটুকু দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। যে উদ্দেশ্যে পরিবার গঠিত হয়ে থাকে তার প্রকৃত উদ্দেশ্যে তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছি কেবলমাত্র ভবিষৎত প্রজন্মকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বি হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছি। সবাই তার সন্তানকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পরও যে ভালো মানুষ হতে হবে বা সামাজিকভাবে বসবাস করতে হবে এ শিক্ষা দিচ্ছি না আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে।

পারিবারিক মূল্যবোধের জায়গাটা আর্থিকভাবে মূল্যায়ণ করছি অনেক ক্ষেত্রেই। মানুষকে মাপার প্রধান হাতিয়ার এখন অর্থ যা আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ভাবছি। এর সুফল যেমন রয়েছে তেমনি এ অর্থ রোজগারের সাথে মানবিকতা যোগ না হওয়ার কারণে সব বিনষ্ট হচ্ছে। প্রতিদান না পেয়ে ভালো কিছু করার আগ্রহটা হারিয়ে ফেলছে অনেকেই। সমাজকর্মীরাও রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক মূল্যায়ণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি সামাজিকভাবে জেগে থাকা মানুষগুলো আজ সমাজের চোখে অকর্মন্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। একসময় মানুষের উপকার করা রাজনৈতিক নেতাদের প্রধান হাতিয়ার ছিলো এবং এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনে জায়গা করে নিতো রাজনৈতিক নেতারা ।

মানুষের উপকার করাই ছিলো তাদের প্রধান ব্রত। কালোক্রমে চেয়ার দখল এবং শাসকের ভূমিকায় পরিণত হয়েছে রাজনীতি। সবচেয়ে বড় কথা হলো পারিবারিক এবং সামাজিক মূল্যবোধের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যে সব সিলেবাস অন্তর্ভূক্ত ছিল তা অদৃশ্য কালো থাবায় হারিয়ে গেছে। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যে অর্জন করতে পেরেছিলাম সেটাও আজ মলিন। শিক্ষা কেবলমাত্র সার্টিফিকেটে আটকে যাচ্ছে। যার ফলে নম্বর পাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালন করতে হলে সামাজিক বিধি নিষেধ কঠোরভাবে মানার বিকল্প নেই। কারন সেখান থেকেই মানুষের শিষ্টাচার তৈরি হয়। যেসব মানুষের মাঝে শিষ্টার থাকে না তারা সমাজের জন্য ক্ষতি বয়ে আনে যা আমরা প্রতিনিয়ন লক্ষ্য করছি।

আর দিনকে দিন যখন ক্ষতির পাল্লাটা ভারী হয় তখন সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। পরিবার এবং সমাজের এ পরিবর্তনের যুগে পরিবার ও সমাজের মূল ভিত্তিটা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরকে ফল ভোগ করতে হবে। আর এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন পরিবার ও সমাজের মূল ভিত্তি শক্ত করা। দায়িত্ব কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সরকারের নয়। এ সংশোধনের দায়িত্ব পরিবার , সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর মূল ধারায় থেকে সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।


লেখক :শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।