এমদাদুল হক স্বপন, ঝালকাঠি : ঝালকাঠির ভীমরুলী ভাসমান বাজারে শত শত নৌকায় দূরদূরান্তের বাগান থেকে সরাসরি পেয়ারা এনে বিক্রি করা হয়। কদিন পড়েই এই বাজারে শুরু হবে বাংলার আপেল খ্যাত পেয়ারা বেঁচাকেনা। ভাসমান নৌকায় বসে ক্রেতা বিক্রেতাদের সাথে দরদাম করে পেয়ারা উঠানো হবে কিনারায়। এছাড়াও পাইকাররা তাদের কেনা বাগানের পেয়ারা নৌকায় এনে এখান থেকে সড়ক পথে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠায়। এভাবে এলাকার পেয়ারা ছাড়াও বিভিন্ন সবজীও নৌকায় কেনা বেচা হয় এ বাজারে। এ কারনেই ভীমরুলীর বাজরটি ভাসমান বাজার হিসাবে পরিচিত পর্যটকসহ দক্ষিণাঞ্চলে।

মহামারি করোনার কারনে দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন চলমান থাকায় চলতি বছর ঝালকাঠির ভাসমান পেয়ারা বাজার না জমার সম্ভাবনাই বেশি। বড় ধরনের ক্ষতির আশংকায় চাষী ও পাইকারদের ঘুম নেই। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো আগে ভাগে বাগান কিনে রাখায় করোনার প্রভাবে লোকসানের আশঙ্কা করছে পাইকাররা। যে সব চাষিরা বাগান বিক্রি করেনি তারা বলছে এবার পেয়ারা বাগানেই পঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি। ঝালকাঠির বাউকাঠি, ভিমরুলী, শতদশকাঠী, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাফুরকাঠী, জগদীশপুর গ্রামের কৃষকদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরিশালের ৫১ গ্রামে পেয়ারার চাষ হয়। তিন জেলার হাজার হাজার মানুষের কাছে পেয়ারা আর্থিক সংকট লাঘব ও জীবিকার অবলম্বন। এই আষাঢ়-শ্রাবনের ভরা বর্ষায় এসব এলাকার নদী-খাল জুড়ে পেয়ারার সমারোহ। দেরিতে ফুল থেকে ফল আসায় আষাঢ়ের শেষের দিকেই পরিপক্ক হয়ে পেয়ারা বিক্রি শুরু হবে বলে জানায় চাষিরা। তাই বিক্রি মৌসুমের আগেই এবার লকডাউন শুরু হওয়ায় পাইকার ও চাষীরা মারাত্মক দুঃশ্চিন্তায় পড়েছে। কারন সড়ক পথে পেয়ারা পরিবহন করতে না পারায় প্রতিবারের মতো এবার পাইকাররা আসবে না। অপরদিকে ঝালকাঠির ভাসমান পেয়ারা হাট দেখতে দেশ বিদেশের পর্যটকরা এসে এখান থেকে প্রচুর টাকার পেয়ার কিনে নিয়ে যেত। করোনার কারনে এবার তা হচ্ছেনা বলে জানিয়েছে চাষিরা।

পেয়ারা চাষিদের সাথে কথা বলে জানাযায়, বরিশাল জেলার বানারীপাড়া, ঝালকাঠী জেলার ঝালকাঠী সদর ও পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠী ঘিরেই মূলত পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ। বরিশাল জেলার বানারীপাড়ার ১২ গ্রামে ৯৩৭ হেক্টর, ঝালকাঠী জেলার ১৩ গ্রামে ৩৫০ হেক্টর, পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠীর ২৬ গ্রামের ৬৪৫ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়।

এসব এলাকার মধ্যে ঝালকাঠীর কীর্তিপাশা, ভিমরুলী, শতদশকাঠী, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাফুরকাঠী, জগদীশপুর, মীরাকাঠী, শাখাগাছি, হিমানন্দকাঠী, আদাকাঠী, রামপুর, শিমুলেশ্বর গ্রামের বৃহৎ অংশজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে যুগ যুগ ধরে পেয়ারার চাষ হচ্ছে। পেয়ারার চাষ, ব্যবসা ও বাজারজাত করতে রয়েছে কয়েক হাজার মৌসুমী পাইকার এবং শ্রমিক। এ সময় ঝালকাঠির অন্তত ২০ টি স্থানে পেয়ারার মৌসুমী মোকামের সৃষ্টি হয়। প্রতিটি মোকামের মৌসুমে প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ হাজার মণ পেয়ারা কেনা-বেচা হয়ে থাকে।

জ্যৈষ্ঠের শেষ থেকে ভাদ্রের শেষ এই তিন মাস পেয়ারার মৌসুম। তবে ভরা মৌসুম শ্রাবণ মাসজুড়ে। এরপর ক্রমশ কমতে থাকে পেয়ারার ফলন। চৈত্র বৈশাখের মধ্যেই পেয়ারা চাষিরা বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সাধারণত ছোট ছোট খাল, নালা দিয়ে বাগানগুলো মূলভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। চাষিরা মৃতপ্রায় গাছের ডাল কেটে, মাটি আলগা করে পেয়ারা গাছের আলাদা যত্ন নেয়।

বাগানের চতুর্দিকে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নালার মাটি পেয়ারা গাছের গোড়ায় দেয়া হয়। চাষীরা জানান, পেয়ারা গাছে তেমন কোন সার বা আলাদা করে কিছু দেবার প্রয়োজন নেই। শুধু পরিচর্যাই যথেষ্ট। সারাবছর তেমন কোন কিছু করার দরকার হয় না। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসেই পেয়ারা গাছে ফুল আসতে শুরু করে। তবে বৃষ্টি শুরু না হলে পেয়ারা পরিপক্ক হয় না। জমি ভালো হলে হেক্টর প্রতি ১২ থেকে ১৪ মেট্রিক টন পেয়ারার উৎপাদন হয়।

বাউকাঠির চাষি হরিপদ জানান, প্রতি বছর এমন সময় পাইকাররা গাছ থেকে পেয়ারা পাড়ার প্রস্তুতি নিত। এবছর তাদের কোন তৎপরতা দেখিনা। আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। পাইকাররা বাগানের পেয়ারা না নিলে অর্ধেক পরিমান টাকা ফেরত দিতে হবে।

কীর্তিপাশার পেয়ারা চাষি অমল কৃষ্ণ বলেন, সামনে পেয়ারা বিক্রির মৌসুম। কিন্তু এবার সড়ক পথ বন্ধ থাকায় পাইকাররা দুঃশ্চিন্তায় আছে। তবে আমরা যারা বাগান বিক্রি করিনি একটু বাড়তি দামের আশায় তারা আরো বেশি চিন্তায় আছি। কারন পাইকাররা না কিনলে কাদের কাছে বিক্রি করব। প্রতি বছর এই ভাষমান বাজারে কোটি কোটি টাকার বেঁচাকেনা হয়। হিমানন্দকাঠি এলাকার পাইকার সোবাহান মৃধা জানালেন এবার করোনার কারনে আমরা বাগান কিনে বেকায়দায় পরেছি। কারন কিছু দিন পরেই পেয়ারা বিক্রি শুরু হবে। সড়ক পথ বন্ধ থাকায় এসব পেয়ারা কিভাবে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠাব তাই ভাবছি। এবার লাখ লাখ টাকার লোকসান গুনতে হবে পাইকারদের।

(এস/এসপি/জুলাই ১১, ২০২১)