সাইফুল ইসলাম


শহিদ পরিবার সমাবেশের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ হলো যে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে অর্থ, তারকা নেতা, বা নামদামী দল লাগে না- লাগে জনগণের আকাঙ্খা অনুযায়ী কর্মসূচি। এরপর বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে— ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে শহরে শোক র্যালি, ১৬ ডিসেম্বর আগের মতোই মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা, মার্চের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র প্রদর্শনী। মাসে মাসে বিশেষ সভা ডেকে মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, শিক্ষকসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিবর্গকে অবহিতকরণ। এছাড়া, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি তো আছেই। পাশাপাশি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন প্রজন্ম থেকে লেখক সৃষ্টির চেষ্টাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

বুদ্ধিজীবী দিবস সফল করতে আমরা দারস্ত হই স্কুল-কলেজগুলোতে। এতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গণসম্পৃক্তি বাড়বে বলে সংগঠকেরা মনে করেন। শিক্ষকেরা সহজেই রাজী হন শিক্ষার্থীদের নিয়ে শোক র্যালিতে আসতে। কোনও কোনও শিক্ষক বলেন, তারা পাট দিবস, জনসংখ্যা দিবস, ডিম দিবস-এও তো ছেলেমেয়েদের নিয়ে র্যালি করেন। কোনও কোনও সময় ‘মন্ত্রী’দের অভিনন্দন জানাতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টার দাঁড়িয়ে থাকে শিক্ষার্থীরা। মুক্তিযুদ্ধ তো এখন পাঠ্যসূচির অংশ, এসব কর্মসূচিতে অংশ নিলে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হয়ে উঠবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। কিন্তু শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস নিয়ে গণমনে একটি ধারণা গেড়ে বসে আছে। তা হলো, বিজয়ের পূর্ব মূহুর্তে ঢাকায় বসবাসরত যে বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানিসেনা ও দোসরদের হাতে জীবন দিতে হয়, তাদের অনেকেই ‘অনিচ্ছায় বা স্বেচ্ছায়’পাকিস্তান সরকারকে সহযোগিতা করেছেন। এ কারণে দিবসটিকে মফস্বল এলাকায় গুরুত্ব দিতে চান না। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, এই সব ‘দোদুল্যমান’ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করা কি খুবই জরুরি? অথচ সংগঠকেরা খোঁজ নিয়ে দেখেন, ‘৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত স্কুল শিক্ষক, গ্রামীণ চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক- সবাই বুদ্ধিজীবীর তালিকাভূক্ত হওয়ার কথা। তালিকা প্রণয়নে বঙ্গবন্ধু সরকার একটি উদ্যোগও নিয়েছিলেন, কিন্তু রহস্যজনক কারণে সে তালিকা আর সম্পূর্ণ হয়নি। তখন স্থানীয় শহিদ বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে বের করে একটি তালিকা করার উদ্যোগ নেয় সংগঠকেরা। দাবি তোলে, ‘স্থানীয় শহিদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন করো।’ যাই হোক, সিরাজগঞ্জে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় সফলভাবে পালিত হয় শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক কর্মী,শহিদ পরিবার সদস্য র্যালিতে অংশ নেন। বিকেলে আয়োজিত আলোচনা সভায় আলোচনা করেন স্থানীয় শহিদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা। যথারীতি পালিত হয় ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এতে ছাত্রদের সুনাম যেমন ফিরে আসতে থাকে, তেমনি অংশ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানেরও সুনাম করে অনেকে। মনোযোগ দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন এবং আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আলোচক রাখা হয় গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের খোলা চত্বরে হয় এ সভা। শহিদ পরিবারের সদস্যরা তার স্বজন শহিদ হওয়ার ঘটনার পাশাপাশি পরিবারকে শহিদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি করেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের যুদ্ধস্মৃতির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে শহিদ পরিবারকে দেখাশোনা করার কথা ছিল তা দেখতে না পারার ব্যর্থতার কথা বলেন। বলেন, বঙ্গবন্ধুকে অকালে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা। যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম চৌধুরী তার আলোচনার শুরুতেই শহিদ পরিবারের সদস্যদের কাছে করজোরে ক্ষমা প্রার্থনা করেন— স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও শহিদ পরিবারের খোঁজ না নেওয়ার জন্য। শহিদ পরিবারের স্বীকৃতির জন্য যেকোনও আন্দোলনে তাদের সঙ্গে থাকবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। মার্চের প্রথম সপ্তাহেই অনুষ্ঠিত হয় আলোকচিত্র প্রদর্শনী। বাজার স্টেশনের খোলা চত্বরে এ আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। কোনও রাজনৈতিক নেতা বা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে দিয়ে নয়, সবচেয়ে অবহেলিত এক শহিদ পরিবারের সদস্যকে দিয়ে এই আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উদ্বোধক নির্বাচিত হন রেলওয়ে হরিজন কলোনির শহিদ পরিবার সদস্য চম্পা বাসফোর। তার পরিবারের চার সদস্য শহিদ হয়েছেন, এখনো বিভিন্ন মার্কেট, বেসরকারি অফিসে নিয়মিত ঝাড়া–দিয়ে সংসার চালাতে হয় তাকে। এ কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ পরিবার এবং সাধারণের মধ্যে ঐক্য গড়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।

কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি চেষ্টা চলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখায় উদ্বুদ্ধ করার কাজ। বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের বলা হয় তাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো লিখে ফেলার জন্য। কিন্তু সবার কথা ‘লিখতে পারে না।’ এর মধ্যেই লেখার উদ্যোগ নেয় বর্তমান প্রজন্মের হাসান মাহমুদ সোহেল ও ইমরান হোসেন। সোহেলের বাড়ি নীলফামারী জেলার জলঢাকায় আর ইমরানের বাড়ি পাবনার ভাঙ্গুরা এলাকায়। সোহেলের কবি হওয়ার ইচ্ছা আর ইমরানের ইচ্ছা সাংবাদিক হওয়ার। দুজনেই ইসলামিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র। ওরা লেখার চেষ্টা করতে থাকে। এদের মধ্যে কিছুদিন পর সোহেল চলে যায় নিজ এলাকায়। সেখান থেকেই যোগাযোগ রেখে নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। গত বইমেলায় প্রকাশিত হয় হাসান মাহমুদ সোহেলের লেখা জলঢাকার যুদ্ধস্মৃতি গ্রন্থ। গণহত্যা স্থানে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর্মসূচি নীলফামারী জেলার জলঢাকা এলাকায় সংগঠিত, পাশাপিাশি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখির কাজ অব্যাহত রাখে। এমরানও তার এবং সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় গণহত্যা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধস্মৃতি নিয়ে লেখালেখি শুরু করে। সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন পত্রিকায় তা প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত। আহ্বায়ক নিজেও লিখতে থাকেন অবিরাম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখির জন্য প্রযোজন আরো অনেক লেখক, নতুন নতুন লেখক, গণলেখক।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার লেখক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের উদ্ধুদ্ধ করার কাজে মনোযোগ দেয় সংগঠকেরা। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই কবিতা লেখেন। এদের সঙ্গে যৌথ বা বিচ্ছিহ্ন ভাবে বৈঠক শুরু করেন সংগঠকেরা। শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করা হতে থাকে যে, তারা ‘গরু’র রচনা লিখতে পারে কিনা? তারা সহজেই স্বীকার করে যে, এটা পারে। সংগঠকেরা তাদের জানায়, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা গরুর রচনার চেয়েও সহজ। যার যার গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা লিখে ফেলা যায় সহজেই। গ্রামটি কোন ইউনিয়ন, থানা, জেলার মধ্যে? গ্রামে একাত্তরের লোক সংখ্যা কত, কোনও বিদ্যালয় ছিল কিনা? মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ-মূহুর্তে গ্রামে কোনও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল কিনা? যুদ্ধ শুরু হলে গ্রামে পাকিস্তানি সেনা এসেছিল কিনা? গ্রামে গণহত্যা হয়ে থাকলে তার বিবরণ এবং শহিদদের নামের তালিকা তৈরি করা। কেউ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল কিনা, তাদের নাম। এসব প্রশ্নের উত্তর যদি জোগাড় করা যায়, তবে কি গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা কঠিন? এভাবে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা কি খুব কঠিন?

শিক্ষার্থীরা সাহস পায়। অনেকেই প্রশ্নগুলো তাদের খাতায় লিখে নেয়। পরের সপ্তাহেই কেউ কেউ এসে জমা দেয় তাদের গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সংগঠকেরা ভাবেন, এদের মধ্যে থেকে নিশ্চয়ই গড়ে উঠবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ কোন গবেষক।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক।