রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের ভূমিহীন জনপদ ইসমাইলপুরের ভূমিহীন রোকেয়া খাতুনের মেয়ের বসতঘর ও রান্না ঘর ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার পর বিষয়টি সাংবাদিকদের জানানোয় মামলা দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। রবিবার বিকেল থেকে হরিনগর ভূমি অফিসের বরখাস্তকৃত সহকারি তহশীলদার দোবশীষ মুখার্জী কয়েকবার হুমকি দেওয়ার পর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ভূমিহীনদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।

সোমবার সকালে সরেজমিনে শ্যামনগরের ইসমাইলপুর ভূমিহীন পল্লীতে গেলে মোঃ নূর ইসলাম, মোঃ শামসুর রহমান, ফরিদা খাতুন ও নজরুল ইসলাম সহ কয়েকজন জানান, তারাসহ ২৯০টি ভূমিহীন দীর্ঘ ২৫/৩০ বছর যাবৎ এ গ্রামের সরকারি খাস জমিতে বসবাস করে আসছেন। প্রতি বছর ডিসিআর নেওয়ার জন্য আবেদন করেন তারা। ডিসিআর দেওয়ার কথা বলে তহশীলদারজ ও তার লোকজন ভুমিহীনদের কাছ থেকে মাথা পিছু দু’ থেকে ৩০০ টাকা করে নিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত ডিসিআর হয় না। তবে মুজিব বর্ষ উপলক্ষ্যে তাদের গ্রামে ১৫৬টি ঘর দেওয়া হয়েছে। যদিও অধিকাংশই অন্য জায়গার বাসিন্দা। অনেকেই বিত্তশালী। এক সপ্তাহ আগে বরখাস্ত হওয়া হরিনগরের সহকারি তহশীলদার দেবাশীষ মুখার্জী এসে তাদের বাড়ি বাড়ি ছোট আকারের একটি করে লাল পতাকা পুতে দিয়ে চলে যান।

জানতে চাইলে উচ্ছেদ করা হবে বলে তাদের কাছে টাকা চাওয়া হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুজার গিফারির গৃহকর্মী হয়েও সিবি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত মনিবের পাশে থেকে সেবা শ্রুশ্রসা করতে রাজী না হওয়ায় পরিকল্পিতভাবে রোববার সকালে কোন অগ্রিম নোটিশ ছাড়াই নকীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী ও বরখাস্ত হওয়া সহকারি তহশীলদার দোবশীষের নেতৃত্বে ১০/১২ জন রোকেয়ার মেয়ের বসত ঘর ও রান্না ঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। প্রতিবাদ করায় তাদের ঘরও ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।

স্থানীয়রা জানান, নকীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের পাশে বাড়ি দেবাশীষ মুখার্জীর। তিনি এলকায় মাদকাসক্ত হিসেবে চিহ্নিত। এলাকার বহুল আলোচিত চণ্ডিপুরের তপন গাইনের স্ত্রীর সঙ্গে তার ও হায়বাদপুর গ্রামের বাচা নামের এক সুদখোরকে অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। এর জের ধরে বাচার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা সুদ দেওয়ার নাম করে নিয়ে তপন গাইনের স্ত্রী ও তিনি ভাগবাটোয়ারা করে নেন। এ টাকা চাওয়াকে কেন্দ্র করে বাচাকে ২০১২ সালে সদর ইউনিয়নের পাটনীপুকুর নামক স্থানে হত্যা করা হয় বলে নিহতের স্বজনদের অভিযোগ।

এ হত্যা মামলায় দেবাশীষ জেল হাজতে যাওয়ার পর থেকে তিনি এখন বরখাস্ত। এরপরও নকীপুর তহশীল অফিসের পাশে তার বাড়ি হওয়ায় প্রভাব খাটিয়ে কাউকে খাস জমি দেওয়ার নামে চাঁদা আদায় ও টাকা না দিলে উচ্ছেদ করার হুমকি দেন দেবাশীষ। একপর্যায়ে ইসমাইলপুরে বসবাসরত ২৯০টি বাড়ির অধিকাংশ বাড়িতে এক সপ্তাহ আগে লাল ফ্লাগ টাঙিয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করার হুমকি দেন দেবাশীষ। এমনকি একটি মহল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও দেবাশীষকে বাঁচাতে রোকেয়া ও তার মেয়ের বিরুদ্ধে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।

ভূমিহীন বিধবা রোকেয়া খাতুন বলেন, তার ২২ বছরের পুরাতন ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়ার বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে মুখ খোলায় দেবাশীষ নায়েব তাকে মামলা দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। সোমবার সকাল ১১টার দিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে তিনজন তদন্তে এলে ঘটনার বিস্তারিত জানিয়েছেন তিনি।

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা ভূমিহীন সমিতির একাংশের সভাপতি আব্দুস সাত্তার বলেন, কোন নোটিশ ছাড়াই রোকেয়ার বাড়িঘর ভাঙচুর করা অমানবিক। এ ছাড়া পূর্ণবাসনের ব্যবস্থা না করে ইসমাইলপুরের ২৯০টি পরিবারকে উচ্ছেদের যে কোন প্রচেষ্টা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিহত করা হবে।

এ ব্যাপারে দোবশীষ মুখার্জী নিজের মাদকাসক্তির বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, সোমবার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, একটি হত্যা মামলার আসামী হওয়ায় তিনি ২০১২ সাল থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। তবে বর্তমানে তিনি ডেপুটেশনে নকীপুর অফিসে কাজ করেন। উর্দ্ধতন কর্মকর্তার নির্দেশে ইসমাইলপুরের ভূমিহীন জনপদে বসবাসরত দু’ শতাধিক বাড়িতে তিনি লাল পতাকা পুঁতে এসেছেন। একইভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘর পাওয়ার পরও পাশের খাস জমিতে ঘরবাড়ি রাখায় তা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তবে হুমকি দেওয়া ও কোন প্রকার টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

তবে রোকেয়াকে উচ্ছেদের ঘটনায় শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলেন, তাকে বসবাসের জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় একটি ঘর বরাদ্দ দেওযা হয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি সরকারের খাস জমির একাংশ দখল করে থাকায় সেখানকার ঘরটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। খাসজমি উদ্ধারে চলমান প্রক্রিয়া হিসাবে পর্যায়ক্রমে আরও ঘর প্রয়োজনে উচ্ছেদ করা হবে।

(আরকে/এসপি/জুলাই ২৬, ২০২১)