সাইফুল ইসলাম


সংগঠকেরা মনে করতে থাকে যে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের জটিল রাজনীতি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে পুষ্ট করেছে, ফলে সাধারণ মানুষ সাহস হারিয়ে ফেলেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বলার। কেউ কেউ মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা বললেও স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গেই সায় দিয়ে চলছে। এই ব্যর্থতার সবার, দায়দায়িত্ব সবার। এর বিপরীতে, ‘সাধারণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাগাতে একটি প্রচারমূলক আন্দোলন’ গড়ে তোলা প্রযোজন; যে আন্দোলন জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলার সাহস জোগাবে, আত্মবিশ্বাসী হতে শেখাবে। সুযোগ সৃষ্টি করবে মুক্তিযুদ্ধের শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করার। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে কিছু রীতি চালু হবে যা সহজেই পালনীয়। আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ পরিবার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সকল কিছুকে আলোচনায় রাখবে, শ্রদ্ধার চোখে দেখতে সাহায্য করবে, সাহস জোগাবে। ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলার সাহস ফিরে আসবে জনগণের মধ্যে, দূর হবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সৃষ্টি হওয়া সকল বিভ্রান্তি।

এমন কিছু রীতি ইতিমধ্যেই জনগণের মধ্যে থেকেই সংগ্রহ এবং চালু করা গেছে, যা ব্যাপকভাবে প্রসংশিতও হয়েছে। যেমন. ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে গণহত্যা স্থান, যুদ্ধস্থান এবং বিভিন্ন শহিদ মিনারে মোমবাতি জ্বালিয়ে শহিদদের স্মরণ; ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারকে ‘মুক্তিযুদ্ধের অবদান রাখার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ’; বিভিন্ন গণহত্যা ও যুদ্ধস্থানে স্থানীয়ভাবে ‘শহিদ দিবস বা যুদ্ধ দিবস’ হিসেবে পালন।’ আবার কিছু দাবিদাওয়া তোলা গেছে যা প্রচারমূলক, সহজেই আদায়যোগ্য, আবার মুক্তিযুদ্ধের বিকাশেও সহায়ক। যেমন; মুক্তিযোদ্ধা, শহিদের নামে বিভিন্ন সড়ক, স্থাপনার নামকরণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের কাছে দাবি তোলা; ভূমিহীন, গৃহহীন মু্িক্তযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারের মধ্যে ঘরবাড়ি দান এবং খাস জমির ব্যবস্থা করা; এবং একাত্তরের গণহত্যায় নিহতদের শহিদের মর্যাদা দান করা। এ সব রীতি চালু এবং দাবিগুলো করা হচ্ছে দলমতের উর্দ্ধে উঠে স্থানীয় উদ্যোগে। এ রীতি ও দাবিগুলো একা অথবা হাজার হাজার মানুষও করতে পারে।

এই ধরণের কাজ আরো খুঁজে পাওয়া যায় কি-না তার জন্য উন্মুখ থাকে সংগঠকেরা। একদিন দুই সংগঠক কালিয়াহরিপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাটারি চালিত যানের অপেক্ষায় বসে আছেন বাজার স্টেশন স্বাধীনতা স্কোয়ারে। সেখানে একটি বটগাছ ছায়া দিচ্ছে সবাইকে। সেই বটতলায় এসে ক্লান্ত রিক্সা শ্রমিক বা পথচারী ছায়া পাচ্ছেন দু’দণ্ড। কয়েকটি চা-পুড়ির দোকানও বসে গেছে অনায়াসে। বটগাছটির প্রসংসা করতেই উঠে এলো তার জন্ম ইতিহাস, সঙ্গে একটি শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসও। গাছটি লাগিয়েছেন বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা মহির উদ্দিন। তখন পাট শ্রমিকদের আন্দোলন চলছে দেশব্যাপী। সিরাজগঞ্জ কওমী জুট মিলের শ্রমিকরা প্রায় প্রতিদিনই মিছিল করতে এসে সমবেত হতো এখানে। ঠা ঠা রোদের মধ্যে বসে থাকতে হতো, কোনও গাছগাছড়া ছিল না এখানে। শ্রমিকেরাও বিরক্ত হত, হয়তো গাছ লাগানোর কথাও আলোচনা হতো। হঠাৎ একদিন মহির উদ্দিন বলেন, আজ এই মূহুর্তেই একটি বটের চারা লাগাব এখানে। কিছুদিন পরে সেই বটগাছ আমাদের ছায়া দেবে। কেউ কেউ ঠাট্টা করেন, কবে বটগাছ হবে, সেই গাছের আবার ছায়া পাওয়া যাবে! কিন্তু কোনও একজন বটের চারা নিয়ে আসেন, লাগানো হয় সেদিনই। সেই বটগাছ এখন মহীরুহ, ছায়া দিচ্ছে অনেককে। এভাবেই একটি বটবৃক্ষ গল্প বলছে একজন শ্রমিক নেতার, ইতিহাস বলছে একটি শ্রমিক আন্দোলনের। নির্বাক হয়ে জানিয়ে দিচ্ছে একটি সময়, একজন শ্রমিক নেতা, একটি শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস। এমনই বৃক্ষ নিশ্চয়ই কথা বলে বিভিন্ন জনের, বিভিন্ন সময়ের। বিয়য়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করে সংগঠকেরা। ছড়িয়ে পড়ে তা অন্যান্য সংগঠকদের মধ্যে। জণগনের মধ্যে যাচাই শুরু হয় করা। দেখা যায়, গ্রামের মধ্যেও এক একটি গাছ এক একটি ইতিহাস হয়ে আছে। তারা বলেন, অমুক গাছটি বড় বুবু অথবা বাবা-কাকা বা অমুক লাগিয়েছেন অমুক সময়ে। এভাবেই বেঁচে থাকেন বৃক্ষ রোপনকারী। উদ্যোক্তাও।

সিদ্ধান্ত হয় মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদের নামে নামে কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ রোপন করার। কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষের পাতা সবুজ, ফুল লাল হওয়ায় অনেকের কাছেই তা পতাকার প্রতীক মনে হয়। কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেবে মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ পরিবার বা গ্রামবাসী। গাছ লাগানোর জন্য অর্থ জোগান ও পরিচর্যা করবে তারাই। ২০২০ সালের সেপেম্বরে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারের নামে নামে কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি। তা বিপুল সাড়া জাগায় জনগণের মাঝে। পাশাপাশি, কিছু প্রস্তাব আসে কর্মসূচিতে সংযোজনের। জাতীয় নেতাদের নামে কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষরোপনের পাশাপাশি অন্যান্য বৃক্ষের কথাও বলেন অনেকেই। তা-ও সহজেই গৃহিত হয়। তবে-সংগঠকদের কথা, যেখানেই মুক্তিযোদ্ধা বা শহিদ পরিবারের নামে যে বৃক্ষই লাগানো হোক না কেন, তা রক্ষাণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে হয় স্থানীয় কাউকে, যাতে মুক্তিযুদ্ধের নাম-সংশ্লিষ্ট বৃক্ষটি অবশ্যই টিকে থাকে। প্রয়োজনে একই জায়গায় একবার বৃক্ষ লাগিয়ে তা তাজা রাখতে ব্যর্থ হলে তা আবারও লাগাতে হবে। ব্যর্থ হওয়া চলবে না কোনও ক্রমেই। ২০২০ সালে প্রায় আড়াই শ’ গাছ লাগানো সম্ভব হয়। তার মধ্যে প্রায় পোনে দু’শ গাছকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। পরের বছর মরে যাওয়া গাছের স্থানে আবারও গাছ লাগানো হচ্ছে, লাগানো হচ্ছে নতুন গাছও। এ রীতি সফল হওয়ায় সংগঠকদের আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে যায়।

মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদদের নামে নামে বৃক্ষরোপন কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে আরো কিছু ঘটনা ঘটে যা সংগঠকদের উজ্জীবীত করে। তেতুলিয়া-চুনিয়াহাটি এলাকায় প্রায় পঁচিশটি কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ রোপন করা হয়। যে সব পরিবার এলাকা থেকে চলে গেছে তাদের স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ নেন শহিদের সন্তান সাজিদুল ইসলাম পান্না। এ খবর পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয় শহিদ পরিবারগুলোকে। খবর পৌঁছে যায় শহিদ শিব শংকর নিয়োগী ওরফে সুধা নিয়োগীর আত্মীয়-স্বজনের কাছেও। তিনি ছিলেন বনবাড়িয়া প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। গ্রামের মানুষ তার আসল নামটি পর্যন্ত ভুলে গিয়ে শুধু মনে রেখেছিল সুধা নিয়োগী নামটি। শহিদ পরিবারকে ঘিরে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর- শহিদ শিবশংকর নিয়োগী ওরফে সুধা নিযোগীর আসল নাম পাওয়া যায়। প্রায় চল্লিশ বছর আগে ১৯৮০ সালে শহিদ সুধা নিয়োগীর পরিবারের সবাই গেছেন নিজ গ্রাম চুনিয়াহাটি ছেড়ে। তার সন্তান ডা. শিবশংকর নিয়োগী তার শহিদ বাবার বৃক্ষ রোপনের কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকেন শহিদের সন্তান সাজিদুল ইসলাম পান্না ডাক্তারের সঙ্গে।

একদিন হঠাৎ সংগঠকদের কাছে ফোন করেন ডা. আশীষ শংকর নিয়োগী। তিনি আসতে চান নিজ গ্রামে। তিনি জানান যে, তিনি তার একমাত্র মেয়ে রূম্পা নিয়োগীকে যখনই তার গ্রামের কথা, শেশবের কথা, শহিদ বাবার কথা বলেন, তখনই সে বায়না ধরে গ্রামে আসার জন্য। কিন্তু কেন আসবেন গ্রামে তার কারন খুঁজে পাননি বলে আসা হয় না। এবারও তার মেয়ে বায়না ধরেছে, তার শহিদ দাদুর নামে লাগানো কৃষ্ণচুড়া গাছ দেখবেন। তাই তিনি তার স্ত্রী-মেয়ে নিয়ে আসবেন বাবার নামে লাগানো কৃষ্ণচুড়া গাছটি দেখতে। এ কথা শুনে খুশি হন গ্রামের লোকজন। চল্লিশ বছর পর একদিন ঠিক চলে আসেন ডা. আশীষ তার গ্রামে স্ত্রী, সন্তানকে নিয়ে। ফিরে পান তার শৈশব, শৈশবের বন্ধু, ভিটেমাটি। স্ত্রী পান তার শশুরের গ্রাম, যে গ্রাম তিনি কখনো দেখেননি। আর রূম্পা নিয়োগীর কাছে দাদুর গ্রাম স্বপ্নের মতো, রূপকথার মতো। গ্রামের সবাই তাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানান। ঘুরে ঘুরে দেখান তাদের বাড়ি, আঙ্গিণা, পুকুরঘাট সব জঙ্গলে পরিণত হয়ে আছে।

একই ভাবে শিয়ালকোল ইউনিয়নের সারটিয়া গ্রামের শহিদ মেঞ্জের আলীর মেয়ে মেঞ্জেরা বেগম চলে আসেন একদিন। তিনি জন্ম নেওয়ার আগেই মেঞ্জের আলী শহিদ হন। তাকে এবং তার ভাই তোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে তুলে এনে হত্যা করা হয় পাশ্ববর্তী শিয়ালকোল গ্রামে ১৯৭১ সালে। ঘটনার পর তার মাকে চলে যেতে হয় বাবার বাড়ি। তারপরে জন্ম নেন মেঞ্জেরা বেগম। এসব ঘটনা আশাবাদি করে সংগঠকদের, নতুন প্রজন্মকে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও চেতনা রক্ষাকারী কর্মী সংগঠকদের।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক, সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক।