সাইফুল ইসলাম


‘১০ মুুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধস্মৃতি’ নামের গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা উপলক্ষে। বইটি প্রকাশের পর শুরু হয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সংগঠকদের অনেকে মনে করতে থাকেন, একটি ভালো কাজ হচ্ছে এটি। এই রকম ‘১০ মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধস্মৃতি’ যদি একেক জেলায় ৫টি খ- প্রকাশ করা যায়, তবে গুটিকয়েক মুক্তিযোদ্ধার ওপর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্ভরশীল হয়ে থাকবে না। আর পরিকল্পিত ভাবে ১০ খ- প্রকাশ করতে পারলে তো কথাই নেই, তখন এই গ্রন্থগুলিতে উঠে আসবে এক একটি জেলার মুক্তিযুদ্ধের বিস্তারিত ইতিহাস। কেউ কেউ আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, পরিকল্পিত ভাবে ১০ খ- প্রকাশে কোন গ্রামে কতজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কোন গ্রামে কী কী ঘটেছে- তা-ও উঠে আসবে সহজেই। শুধু এক মুক্তিযোদ্ধার বিবরণীর সঙ্গে আরেক মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্য মিলিয়ে নিতে হবে গবেষকদের। এ কাজে যারা ইতিমধ্যেই অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে তাদের মধ্যেও। তারা বর্তমান গবেষণা পদ্ধতিরও সমালোচনা করেন। তারা বলেন যে, অনেক গবেষক আছেন, যারা ঢাকা থেকে প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে দিয়ে থাকেন। সে প্রশ্নপত্রের উত্তর সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকায়। তা সংকলন করে নিজের নামে ছাপিয়ে দিয়ে এক একেক জন হয়ে উঠছেন বিশাল গবেষক। তারা মূলত মুক্তিযুদ্ধের নামে জনগণের পকেটের পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছেন, বাঁধাগ্রস্থ করছেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষণাকে। যে গবেষণার সঙ্গে জনগণের কোনও সম্পর্ক নেই, সে ধরণের গবেষণা গ্রন্থকে ‘কাগজের অপচয়’ বলে মনে করেন নতুন আগ্রহীরা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ ধরণের গন্থকে সমালোচনা করাও কর্তব্য মনে করেন সংগঠকেরা।

‘যুদ্ধস্মৃতি’ প্রথম খ- প্রকাশিত হয়েছে, দ্বিতীয় খ- প্রকাশের প্রস্তুতি চলতে থাকে। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে আরো অনুলিখন ছাপা হতে থাকে ‘মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধস্মৃতি’ শিরোনামে। কিন্তু এ কাজটি যাদের ‘বাড়া ভাত কেড়ে নিচ্ছে’ তাদের অনেকেই বিষয়টিকে সমালোচনার দৃষ্ঠিতে দেখতে শুরু করেন। বিপদ দেখলে অথবা শত্রুর দেখা পেলে যেমন সাবধান হতে হয় তেমনি আরো সাবধাণ হতে হয় লেখক-সংগঠকদের। সমালোচনার মুখে পড়ে সচেতন, শিক্ষিত এবং আরো কৌশলী হতে হয় সংগঠকদের।

অনুসন্ধান কমিটির সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন বানুকে জনৈক মুক্তিযোদ্ধা ঠাট্টাচ্ছলে জিজ্ঞেস করেন- ‘তোমরা না-কি মুক্তিযোদ্ধার নতুন গেজেট প্রকাশ করছো? তাতে কি আমার নামটা আছে।’ গত পঞ্চাশ বছরের রাজনীতি এই মুক্তিযোদ্ধাকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা থেকে গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত করেছে। তিনি মন্ত্রি কোঠায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন। ফলে যাচাই-বাছাইয়ের তালে পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভালো সম্পর্ক রাখতেই হয়্ তার সঙ্গে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা কমিটিতেও রাখা হয় তাকে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় লেখক-সংগঠকদের মধ্যে। এক লেখক-সংগঠক তাকে জিজ্ঞেস না করেও তার যুদ্ধ-বৃত্তান্ত সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু হয় অনুসন্ধান। তারই এক সহযোদ্ধার কাছে জানা যায়, তারা গ্রামের তিন জন রৌমারীতে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু শারিরীক সমস্যার কারণে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে নেওয়া হয় না। তখন তিনজনই ফিরে আসেন নিজ এলাকায়, চেষ্টা করতে থাকেন স্থানীয় কোনও মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপে যোগদানের।

এদিকে, ইসমাইল গ্রুপ কাজীপুরের বড়ইতলা যুদ্ধের পর সংশ্লিষ্ট তিন মুক্তিযোদ্ধার গ্রামে আশ্রয় নেন বলে জানান, ওই গ্রুপের অন্যতম সদস্য ছোনগাছা ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আনিসুর রহমান। বীর মুক্তিযোদ্ধা আনিসুর রহমানের সাক্ষাৎকার অনুলিখন করে প্রকাশ করা হয় স্থানীয় পত্রিকায়। সেখান থেকে জানা যায়, ওই তিন মুক্তিযোদ্ধা সেদিনই ইসমাইল গ্রুপভূক্ত হন। অনেক আগে থেকেই তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের চেষ্টা করলেও তারা গ্রুপ ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পান বড়তলা যুদ্ধের দিন অর্থাৎ ১৪ নভেম্বরে। তখন জলের মতো পরিস্কার হয়ে যায় তার যুদ্ধ-বৃত্ত্বান্ত। বুঝতে কষ্ট হয়না যে, তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তার গ্রামেরও কেউ কেউ কেন সন্দেহ প্রকাশ করেন। যে কয়েকদিন তারা সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন, তখন তারা গ্রামের আশেপাশে থাকায় গ্রামবাসী তাকে এলাকায়ই দেখেছেন। সে কারণে অথবা বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা পদবীর ‘ঠাটবাট, সুযোগ-সুবিধা’র কারণে ঈর্ষা করেও তাদের ‘ভুয়া’ বলছেন। সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা স্বল্প সময়ের ‘যুদ্ধস্মৃতি’ নিয়ে লুকোচুরি খেলেন বলেও সৃষ্টি হচ্ছে এই জটিলতা।

জনৈক মুক্তিযোদ্ধার একটি প্রশ্ন বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয় লেখক-সংগঠকদের। প্রশ্নটি হলো- যে সব যুদ্ধস্মৃতি লেখা হচ্ছে তাতে স্বাধীনতা বিরোধীদের নাম উঠে আসছে না কেন? তবে কি মুক্তিযুদ্ধ অনুসন্ধান কমিটির কর্মীরা স্বাধীনতা বিরোধীদের কৃতকর্ম গোপন করে তাদের পক্ষে কাজ করছে? এর আগেই এ ধরণের প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কিন্তু এবার যিনি এ প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি একাত্তরের আগে থেকেই প্রভাবশালী ছাত্রনেতা, অনেক বড় মুক্তিযোদ্ধা, এখনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাই তার প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুয়োগ নেই। তাছাড়া নিজেদের মধ্যেও প্রশ্ন জাগে, কেন মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা বিরোধীদের কথা বলতে পারছেন না বা বলেন না। এটাকি শুধু পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক জটিলতা? নাকি আত্মীয়তা, ভীতি বা অন্য কোনও কারণ আছে? ইতিমধ্যে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধস্মৃতিগুলো তন্নতন্ন করে পাঠ করা হয়। নতুন যে সব লেখা হচ্ছে তাতেও মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করা হয় এ বিষয়ে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে থেকে স্বাধীনতা বিরোধীদের তেমন তথ্য সংগ্রহ করা দুরাশাই থেকে যায়। তাদের কাছে যে সব স্বাধীনতা বিরোধীদের কথা পাওয়া যায়, তা থেকে বোঝা যায় যে যুদ্ধকালীন সময়ে অনেককে আত্মসপর্যণ করিয়ে বিচার করা হয়েছে। কারো শাস্তি হয়েছে, কেউবা আত্মসমর্পণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থেকে গেছে। অর্থাৎ তারাও পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন। ফলে তাদের কাছে স্বাধীনতা বিরোধীরা হয় শত্রুতে পরিণত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে অথবা মু্িক্তযোদ্ধায় পরিণত হয়েছে। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণে স্বাধীনতা বিরোধীদের কথা প্রায় নেই-ই বলা চলে।

পাশাপাশি লেখা চলছে ‘শহিদ পরিবার’ ও ‘সাধারণের চোখে মুক্তিযুদ্ধ।’ প্রথম দিকে, এ দুটিতে স্বাধীনতা বিরোধীদের নাম পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়তো। লক্ষ্য করা যায়, সে সময়ে স্বাধীনতা বিরোধী- যারা পরবর্তীতে প্রভাবশালী সামাজিক অথবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন, তাদের ভয়েই নাম বলেন না। কিন্তু ধীরে ধীরে স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীদের নাম উঠে আসতে থাকে। অবাক করা ঘটনা তখন ঘটে তখন যখন একেবারেই সাধারণ মানুষের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করা যায়। তিনি তার সরলতা থেকে অকপটে বলে দেন, কে লুকিয়ে থেকেছে, আর কে পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়েছে। কে দিনে রাজাকারদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে আর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছ্।ে এতে খুব সহজেই স্বাধীনতা বিরোধীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। বোঝাও সহজ হয়, কেন মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা বিরোধীদের চিহ্নিত করতে অক্ষম। এখানেই শহিদ পরিবার ও স্বাধারণের চোখে মুক্তিযুদ্ধ লেখার অপরিহার্য়তা বেড়ে যায়। লেখক-সংগঠকদের মনে হতে থাকে, শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সঠিকতায় দাঁড় করাতে সাধারণের চোখে মুক্তিযুদ্ধ এবং শহিদ পরিবারের লেখাটিও অপরিহার্য। শহিদ, সাধারণ এবং মুক্তিযোদ্ধা এমনকি ওই সময়ে যারা পাকিস্তানি প্রশাসনকে সহযোগিতা করেছেন, তাদের বা তাদের আত্মীয়-স্বজনের সাক্ষাৎকার গ্রহণও প্রয়োজনীয় মু্িক্তযুদ্ধের ইতিহাসের জন্য।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক, আহ্বায়ক- সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি।