এম. আব্দুল হাকিম আহমেদ


১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাঙালী জাতির হৃদয়ের কান্না, বাঙালী জাতির নিরন্তর রক্তক্ষরণের দিন। পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতাকে হার মানিয়ে মানব ইতিহাসের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ড ঘটেছিল এই দিনে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের কালো রাতে খুনি মোশতাক-জিয়ার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় খুনি সর্দার ফারুক-রশিদের নেতৃত্বে ঘাতকেরা প্রায় একই সময় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায়, ঢাকার মন্ত্রিপাড়ায় মিন্টু রোডে তার ভগ্নীপতি মন্ত্রী সভার সদস্য আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও ধানমন্ডির আরেকটি বাসায় তার ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক যুবনেতা ফজলুল হক মনির বাস ভবনে হামলা চালায়। ঘাতকেরা বাঙালী জাতির পিতাকেই শুধু হত্যা করেনি, হত্যা করেছে একটা পুরো জাতিকে, বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্খার প্রতীক, ভবিষ্যতের চলার পাথেয় জাতির কান্ডারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তারা শুধু এ কাজটি করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা একের পর এক নারকীয় হত্যাকান্ডে মেতে উঠে। এ যেন মানুষ হত্যার মহোৎসব। তারা হত্যা করে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে। হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, ২য় পুত্র শেখ জামাল, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভ্রাতা শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্র বধু সুলতানা কামাল, পারভীন জামাল রোজী, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শিশু রাসেল, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্য আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর অতি¯েœহের পুত্রতুল্যভাগ্নে ও আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি, শেখ মনির সন্তান সম্ভবা স্ত্রী বেগম আরজু মনি, সেরনিয়াবাতের কিশোরী কন্যা বেবী সেরনিয়াবাত, শিশু পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, শিশু পৌত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভ্রাতুষপুত্র শহীদ সেরনিয়াবাত, আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর খালাতো ভাই আব্দুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্ণেল জামিল উদ্দিন আহম্মেদ, পুলিশের এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহাবুবুল হক ও ১৫ই আগস্ট খুনীদের গোলায় নিহত মোহম্মদপুরের বস্তিঘরের নিরীহ রিজিয়া বেগম, রাশেদা বেগম, সাবেরা বেগম, আনোয়ারা বেগম, আনোয়ারা বেগম-২, সয়ফুল বিবি, হাবীবুর রহমান, আবদুল্লা, রফিকুল, শাহাবুদ্দিন ও আমিনুদ্দিন। আগস্ট বড় দুঃখ বেদনার মাস, স্বজন হারানোর মাস। ১৫ই আগস্ট বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষ ও বিশ্বের বিবেকবান মানুষ চোখের অশ্রু ঝরায়।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট মানব সভ্যতার বীভৎস, পৈশাচিক নির্মম হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তৎকালীন আবাসিক পি এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মামলার বাদি প্রয়াত আ.ফ.ম. মহিতুল ইসলাম সরকারী কাজে ঝিনাইদহ সার্কিট হাউসে অবস্থান কালে আমরা আওয়ামী লীগের তরুন কর্মীরা তার সঙ্গে সাক্ষাত করে ১৫ই আগস্ট লৌহমর্ষক বঙ্গবন্ধু সহ অন্যান্যদের হত্যাকান্ডের কাহিনী শুনেছিলাম এবং আমি লিপিবদ্ধ করেছিলাম। সেখান থেকে কিছু অংশ উদ্বৃত করলাম, ‘ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে নিচে নেমে এসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এর পরপরই মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন তাদের সৈন্যসহ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসে। আজিজ পাশা তার সৈন্যদের নিয়ে দোতলায় চলে যায়। তারা বঙ্গবন্ধুর ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে।

এক পর্যায়ে তারা দরজায় গুলি করে। তখন বেগম মুজিব দরজা খুলে দেয় এবং ঘরের মধ্যে যারা আছে তাদের না মারার জন্য অনুরোধ করেন। ঘাতকরা বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিয়ে আসতে থাকে। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেই বেগম মুজিব কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেলো।’ বেগম মুজিব নিচে নামতে অস্বীকৃতি জানান। ঘাতকরা শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে যায়। আর বেগম মুজিবকে তার ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। বেগম মুজিবসহ বঙ্গবন্ধুর ঘরে আগে থেকেই অবস্থান নেওয়া শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন। বেগম মুজিবের নিথর দেহটি ঘরের দরজায় পড়ে থাকে। বাঁদিকে পড়ে থাকে শেখ জামালের মৃতদেহ। রোজী জামালের মুখে গুলি লাগে। আর রক্তক্ষরণে বিবর্ণ হয়ে যায় সুলতানা কামালের মুখ। শেখ নাসের, শেখ রাসেল আর রমাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের সবাইকে লাইনে দাঁড় করানো হয়।

এ সময় শেখ নাসের ঘাতকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি তো রাজনীতি করি না। কোনোরকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই।’ এরপর তারা শেখ নাসেরকে বলে, ‘ঠিক আছে, আপনাকে কিছু বলব না। আপনি ওই ঘরে গিয়ে বসেন।’ এই বলে তাকে অফিসের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমে নিয়ে গুলি করে। এরপর শেখ নাসের ‘পানি, পানি’ বলে গোঙাতে থাকেন। তখন শেখ নাসেরের ওপর আরেকবার গুলিবর্ষণ করা হয়। লাইনে দাঁড়িয়ে শেখ রাসেল প্রথমে রমাকে ও পরে মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?’ মহিতুল জবাব দেন, ‘না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না।’ এ সময় শেখ রাসেল তাঁর মায়ের কাছে যেতে চাইলে আজিজ পাশা মহিতুলের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিয়ে যায়। এ সম্পর্কে মহিতুল বলেন, রাসেলকে ঘাতকরা কেড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় সে চিৎকার করে কান্নাকাটি করছিল। এরপর তাকে নিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। ঘাতক আজিজ পাশার কথামতো এক হাবিলদার সভ্যতার সব বিধি লঙ্ঘন করে এই নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। গুলিতে রাসেলের চোখ বের হয়ে যায়। আর মাথার পেছনের অংশ থেঁতলে যায়। রাসেলের দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামালের পাশে। পুরো ঘরের মেঝেতে মোটা রক্তের আস্তর পড়ে গিয়েছিল। এর মাঝেই ঘাতকের দল লুটপাট চালায়। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন তার দুই মেয়ে ছিলেন না। বড়ো মেয়ে শেখ হাসিনা তার ছোটো বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে স্বামী বিশিষ্ট পরমানু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান।”

বঙ্গবন্ধু হত্যা কয়েকজন চাকরিচ্যুত ও চাকরিরত সেনা সদস্যদেরকে নিছক বা আকস্মিক কোনো কর্মকান্ড নয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের পতনের লক্ষ্যে, জাসদ, ইসলামের লেবাসধারী পাকিস্তানপন্থী বিভিন্ন দল এবং চীনপন্থী উগ্র বামপন্থী দল-উপদল গুলো দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করতে থাকে।

এহেন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার দেশীয় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকারীদের তৈরী করা প্রেক্ষাপটের সুযোগে স্বাধীনতা বিরোধী আন্তজার্তিক চক্রের সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রেই দেশীয় ঘাতক বেইমান মোশতাক-জিয়া-রশিদ-ফারুক-ডালিম চক্রের মাধ্যমে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুসহ তার স্বজন ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছিল। একাত্তরের পরাজিত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এই নৃশংস হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার আদর্শ, মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অগ্রগতিকে স্তব্দ করে দেয়া। প্রগতির চাকাকে স্তব্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্থানী ভাবধারার তাবেদার রাষ্ট্রে পরিনত করার এক গভীর চক্রান্ত থেকেই সংগঠিত হয়েছিল জাতির জনকের এই নৃসংশ হত্যাকান্ড। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, খুনি, রাজাকার-আল বদরদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন ও ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে ধর্মের নামে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে জিয়াউর রহমান যে বিষবৃক্ষের বীজ রোপণ করেছিল পরবর্তীতে এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশে উগ্রসাম্প্রদায়িক শক্তির নানামুখী উত্থান তারই ধারাবাহিকতা।

পচাঁত্তরের ১৫ই আগস্টের ঘাতকেরা বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতীয়বাদ নির্মূল করার সূদুর প্রসারী লক্ষ্য নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে যে চরম নিষ্ঠুরতা, নীচতা, বিশ্বাসঘাতকতা দেখিয়েছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল, যার প্রতিতুলনা বিশ্বে খুজে পাওয়া যাবে না। এ যেন কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনাকেও হার মানিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রে নিহতের তালিকায় অন্তঃসত্ত্বা বা নববিবাহিত তরুণী অথবা দুগ্ধপোষ্য শিশুরা ছিল না, যেমন দিল পচাঁত্তরের আগস্ট হত্যাকান্ডে নিহতদের মধ্যে।

১৫ই আগস্ট বাঙালী জাতির নিরন্তর রক্তক্ষরণের আরও একটি নাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ শিশুপুত্র শেখ রাসেল। আগস্ট এলে আমাদের চোখে ভেসে উঠে শেখ রাসেল, সুকান্ত বাবু, বেবী, আরিফ, রিন্টু মোহম্মদপুরের বস্তি ঘরের নাসিমার কচি কোমল মুখ। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৮ই অক্টোবর। শেখ রাসেলের জন্মক্ষণ সম্পর্কে তার বড় বোন আজকের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ‘স্মৃতি বড় মধুর স্মৃতি বড় বেদনার’ নামক স্মৃতি চারণ মূলক নিবন্ধে লিখেছেন, “১৯৬৪ সালের অক্টোবরে রাসেলের জন্ম। তখনও বাড়ির দোতলা হয়নি, নিচতলাটি হয়েছে। উত্তর-পূর্ব কোণে আমার ঘরেই রাসেলের জন্ম হয়। মনে আছে আমাদের সে কী উত্তেজনা! আমি, কামাল, জামাল, রেহানা, খোকা কাকা- অপেক্ষা করে আছি। বড় ফুফু, মেজ ফুফু তখন আমাদের বাসায়। আব্বা তখন ব্যস্ত নির্বাচনী প্রচার কাজে। আইয়ুবের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী করা হয়েছে সর্বদলীয়ভাবে। বাসায় আমাদের একা ফেলে মা হাসপাতালে যেতে রাজি না। তাছাড়া এখনকার মতো এত ক্লিনিকের ব্যবস্থা তখন ছিল না। এসব ক্ষেত্রে ঘরে থাকারই রেওয়াজ ছিল। ডাক্তার-নার্স সব এসেছে। রেহানা ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোট্ট মানুষটি আর কত জাগবে। জামালের চোখ ঘুমে ঢুলফুল, তবুও জেগে আছে কষ্ঠ করে নতুন মানুষের আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। এদিকে ভাই না বোন! ভাইদের চিন্তা আর একটি ভাই হলে তাদের খেলার সাথী বাড়বে, বোন হলে আমাদের লাভ। আমার কথা শুনবে, সুন্দর সুন্দর ফ্রক পরানো যাবে, চুল বাঁধা যাবে, সাজাবো, ফটো তুলব, অনেক রকম করে ফটো তুলব। অনেক কল্পনা মাঝে মাঝে তর্ক, সে সঙ্গে গভীর উদ্বেগ নিয়ে আমরা প্রতি মূহূর্তে কাটাচ্ছি। এর মধ্যে মেঝ ফুফু এসে খবর দিলেন ভাই হয়েছে। সব তর্ক ভুলে গিয়ে আমরা খুশিতে লাফাতে শুরু করলাম। ক্যামেরা নিয়ে ছুটলাম। বড় ফুফু রাসেলকে আমার কোলে তুলে দিলেন। কি নরম তুলতুলে। চুমু খেতে গেলাম, ফুফু বকা দিলেন। মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল, ঘাড় পর্যন্ত একদম ভিজা। আমি ওড়না নিয়ে ওর চুল মুছতে শুরু করলাম। কামাল, জামাল সবাই ওকে ঘিরে দারুণ হইচই।” ১৯৭৫ সালে শেখ রাসেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলো। শেখ রাসেলের প্রকৃত নাম ছিল শেখ রিসাল উদ্দিন। ডাকনাম রাসেল। বঙ্গবন্ধু বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামে নামটি রাখেন। রাসেল মাত্র ১০ বছর ১০ মাস বেঁচে ছিল। মাঝেমধ্যে সে গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায় গেছে। সে একবার জাপান গেছে বাবার সঙ্গে। রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যও ভ্রমণ করেছে। বাড়ির প্রাঙ্গণ, বাড়ির সামনের রাস্তা ও ফুফুদের বাসাই ছিল তার বিচরণ ভূমি। একাত্তরে ছিল মায়ের সঙ্গে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি। একাত্তরের মিত্রমাতা ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে বেড়াতে এলে মা-বাবার সঙ্গে বিমানবন্দরে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল রাসেল। রাসেলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল প্রতিবেশী আদিল, ইমরান ও ফুফাতো ভাই আরিফ সেরনিয়াবাত। সাইকেল তার প্রিয় ছিল। সে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলত প্রাঙ্গণে। গল্প শুনত বড়দের কাছে। বাড়ির ছোট ছেলে হিসেবে রাসেল ছিল সবার আদরের। মুক্তিযুদ্ধকালীন দীর্ঘ ৯ মাস পিতার অদর্শন তাকে এমনি ভাবপ্রবণ করে রাখে যে, পরে সবসময় পিতার কাছে কাছে থাকতে জেদ ধরতো। স্নেহের আদরের ছোট ভাই শেখ রাসেলের প্রতি বোন শেখ রেহানার ছিল অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালোবাসা। ১৯৭৫ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বড় বোন শেখ হাসিনার সাথে জার্মানিতে যাওয়ার সময় বিমান বন্দরে বিমানে উঠার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত শেখ রাসেল শেখ রেহানাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। জার্মানিতে যেয়ে শেখ রেহানা তার অতি আদরের রাসেলকে চিঠি লিখেন।

০৩.০৮.১৯৭৫ ট্রিবার্গ

“রাসুমণি

আজকে আমরা ঞৎরনবৎম গিয়েছিলাম। এটা জার্মানির সবচেয়ে বড় ঝরনা। অনেক উপরে উঠেছিলাম। এদের ভাষায় বলে ডধংংবৎভধষষব। আজকে ব্লাক ফরেস্ট গিয়েছিলাম। ...পড়াশুনা করো। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করবে। মা’র কথা শুনবে। তোমার জন্য খেলনা কিনব। লন্ডনের চেয়ে এখানে অনেক দাম। ছোট্ট ছোট্ট গাড়িগুলো প্রায় দুই পাউন্ড দাম। তুমি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া ও পড়াশুনা করো।

ইতি রেহানা আপা।”

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও শেখ রাসেলের প্রতি ছিল অপরিসীম পিতৃ¯েœহ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার কারাগারের দিন পুঞ্জি ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামক গ্রন্থে অনেক জায়গায় তার কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেল সম্পর্কে লিখেছেন। উল্লেখিত গ্রন্থে ২৪৯ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘৮ই ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, “আব্বা বালি চলো”। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, “তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।” ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’ ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে অন্যত্র (পৃষ্ঠা নং-২৩৪) বঙ্গবন্ধু শেখ রাসেল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘রাসেল একবার আমার কোলে, একবার তার মার কোলে, একবার টেবিলের উপরে উঠে বসে। আবার মাঝে মাঝে আপন মনেই এদিক ওদিক হাঁটাচলা করে। বড় দুষ্ট হয়েছে, রেহানাকে খুব মারে। রেহানা বলল, ‘আব্বা দেখেন আমার মুখখানা কি করেছে রাসেল মেরে।’ আমি ওকে বললাম, ‘তুমি রেহানাকে মার?’ রাসেল বলল, ‘হ্যাঁ মারি।’ বললাম, ‘না আব্বা আর মেরো না।’ উত্তর দিল, ‘মারবো।’ কথা একটাও মুখে রাখে না।’

শেখ রাসেল বিশ্বের অধিকারহারা, নির্যাতিত, নিপীড়িত শিশুদের প্রতীক ও প্রতিনিধি। যখনই অবোধ শিশু-বলি দেখি, তখনই রাসেলের কচি মুখখানা ভেসে ওঠে। মানুষরূপী রক্তখেকো হায়েনাদের হাত কাঁপেনি ১৫ই আগস্টে নিরাপরাধ শিশু রাসেলকে হত্যা করতে। শেখ রাসেলকে নিয়ে ‘শেখ রাসেল এক ফুলকুঁড়ি’ নামক একটি টেলিফিল্ম তৈরি করা হয়েছে। এটির কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেন বিটিভি’র প্রাক্তন উপ-মহাপরিচালক বাহার উদ্দিন খেলন। এতে রাসেলের কিশোর চরিত্রে অভিনয় করে শিশুশিল্পী আরিয়ান। এ টেলিফিল্মটি প্রযোজনা করেন মাহফুজার রহমান। ফিল্মটি নির্মাণে বিষয়বস্তু সংগ্রহ করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং মিজানুর রহমান মিজান রচিত গ্রন্থ থেকে। এটি হৃদয় বিদারক জীবনভিত্তিক ছায়াচিত্র, যা বাঙালি ও বাংলাদেশের শিশুর কান্না ঝরায়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানব সভ্যতার নিকৃষ্ঠতম শিশু হত্যার অমানবিক হৃদয় বিদারক দৃশ্যপট শেখ রাসেলের নারকীয় হত্যাকান্ড ও মৃত্যুর আগ মুহূর্তে নিষ্পাপ রাসেলের আর্তি- ‘আমাকে মারবে না তো ভাইয়া’ বুকের মাঝে শোকের নদী বইয়ে দেয়। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও গবেষক এমরান চৌধুরী ‘১৫ই আগস্ট নিরন্তর রক্ষকরণের দিন’ নামক নিবন্ধে শেখ রাসেলের অমানবিক হত্যা ও পৈশাচিক খুনিদের নিকট শেখ রাসেলের বেঁচে থাকার আকুতির বিষয়টি ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে। “বত্রিশ নম্বর রোডের বাড়িতে যখন এ নারকীয় তান্ডব চলছিল, তখন দশ বছর দশ মাসের একটি শিশু থরথর করে ভয়ে কাঁপছিল। তাঁর নাম শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধু পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য। একটা নয় দুইটা নয়, দু’চার, দশটাও নয় দুই নরাধম পিশাচের চেয়েও ভয়ংকর আক্রোশে স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে বঙ্গবন্ধুর বিশাল মাপের বুকটা ঝাঁঝরা করে দেয়। এ বীভৎস চিত্র দেখে ছোটো শিশুটি বুক চাপড়িয়ে আহাজারিরত মায়ের হাত ধরে বিড়াল ছানার মতো মুখ লুকোবার জন্য মায়ের আঁচল খুজছিল। সেই মুহূর্তে খুনিরা তার সামনেই তার প্রিয় মাকে হত্যা করে। নিজের চোখের সামনে বাবা-মায়ের স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে ঝাঁঝরা মুখ ছোটো শিশুটির মনে কী ধরনের রেখাপাত করেছিল তা ভাববার বিষয়। বাপ-মা হারা শিশুটিকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একজন পুলিশ অফিসার অনেক অনুনয় করেছিল। বিনিময়ে তারও ভাগ্যে জুটেছিল ব্রাশ ফায়ার। মাকে হারিয়ে মায়ের ক্ষতবিক্ষত শরীরের ওপর লুটিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদছিল রাসেল। জল্লাদেরা তাঁকে টেনে হিঁচড়ে মা’র কাছ থেকে আলাদা করলে রাসেলের মুখে করুণ আকুতি ঝড়ে পড়ল, ‘আমাকে মেরো না, আমি কোনো অন্যায় করি নি।’ কিন্তু ঘাতকের কর্ণকুহরে জাতির পিতার এ মাসুম শিশুটির আবেদন পৌঁছালো না। কারণ তারাতো মানুষ ছিল না- ছিল পিশাচ। এরপর রাসেল এক দৌড়ে বড় ভাবি সুলতানা কামালের কাছে আশ্রয় নেয়। সুলতানার পাশে ছিলেন ছোট ভাবি রোজী। তাঁরা দু’জনই মাসুম শিশুটির বুকে আগলে রেখে তাকে রক্ষার প্রাণান্তকর প্রয়াস চালান। কিন্তু ঘাতকেরা কাউকেই ছাড়বে না। এক এক করে সবাইকে সরিয়ে দেবে এ পৃথিবী থেকে। তার পরক্ষণেই তারা বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূকে একত্রে হত্যা করে। একের পর এক মৃত্যুর মিছিল আর বিভীষিকায় হতবিহ্বল রাসেল এবার ঠাঁই খুঁজে বেড়ায় বাড়ির কাজের লোকজনের কাছে। বাড়ির লোকজনকে জড়িয়ে কান্নারত রাসেলকে টেনে অন্যত্র নিয়ে যায় একজন মেজর। দশ বছর দশ মাসের একটা শিশুর প্রাণ বধের জন্য উপরে তুলে একটা আছাড় অথবা বন্দুকের একটা সজোরে গুঁতো কিংবা বেয়নেটের একটা খোঁচাই তো যথেষ্ট। কিন্তু না, তারা এ অবুঝ শিশুটিকে এত বেশি ভয় পাচ্ছিল, যদি না শিশুটি কোনোরকমে বেঁচে যায় যায় তাহলে তো তাদের সাত-পুরুষের ভিটেয় ঘুঘু চড়বে। তাই তারা মরিয়া হয়ে উঠে বাংলাদেশের ভাবীকালের শিশু নিধনে। তারা এ কচি প্রাণটার ওপর (যে প্রাণ মৃত্যুর মিছিলে আগেই একাকার হয়ে গেছে) একটা, দুইটা নয়, বেশ কয়টা গুলি চালায়। মুহূর্তে দশ বছর দশ মাসের নিষ্পাপ শিশুটি জান্নাতের সিঁড়ি বেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসে পৌঁছে যায়। কী দোষ ছিল এ মাসুম শিশুটির। কী দোষ ছিল বাংলার বুকে তার প্রিয়তম পিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। একটি স্বাধীন ভূখন্ড, একটি লাল-সবুজের পতাকা, একটি আলাদা পরিচয়, একটি জাতীয় সংগীত ও সর্বোপরি একটি সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার পুরস্কার কি এই বুলেট? পুত্রের সামনে পিতাকে অমানবিক ও বর্বরোচিত কায়দায় হত্যা। একজন মানুষের প্রাণস্পন্দন থামিয়ে দিতে কয়টা গুলি প্রয়োজন? আজ বড়ো প্রয়োজন এসব নিয়ে ভাববার, আজকের প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড নিয়ে যতই বিচার-বিশ্লেষণ করবে তাতে করে খুব সহজে স্বাধীনতার আসল শত্রুর মুখোশ আমাদের চোখের সামনে স্বচ্ছ আয়নার মতো প্রতিভাত হবে।” শেখ রাসেল নিষ্পাপ, নির্মল একটি শিশুর নাম, শেখ রাসেল অধিকারহারা শিশুদের প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শিশু রাসেল ১৫ই আগস্ট বাঙালী জাতির নিরন্তর রক্তক্ষরণের আরোও একটি নাম।

লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ।