বাগেরহাট প্রতিনিধি : একটি স্লুইস গেইটের কারণে মোংলার পাঁচটি গ্রামের প্রায় ৫ হাজার একর জমিতে ধান ও মাছ চাষ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় প্রায় ২০ হাজার পরিবার। স্লুইস গেইটটির অব্যবস্থাপনায় জোয়ারের পানি নদী থেকে খালে ঢুকতে না পারায় খালের পানি কোনভাবেই ফসলি জমিতে উঠছেনা। তাই গেল বর্ষায় জমিতে লাগানো ধান এখন পানির অভাবে রোদে পুড়ে মারা যাচ্ছে। জমিতে পানি না থাকায় মাছ চাষও করতে পারছেননা চাষীরা। কিছু কিছু ঘেরে সামান্য পানি থাকলেও রোদে তাপে সেগুলোতে মাছ মরে যাচ্ছে। আর এমন দুর্ভোগ চলে আসছে দীর্ঘ প্রায় ৮টি বছর ধরে। বছরে বছরে খুলনা সিটি মেয়র, স্থানীয় এমপি ও উপমন্ত্রী, প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের কাছে বার বার লিখিত আবেদনসহ আকুতি মিনতি জানিয়ে আসছেন ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামবাসীরা। কিন্তু সেই আবেদন-নিবেদন ও আকুতি কোন কাজেই আসছেনা। তাদের এ দু:খ দুর্দশা দেখার যেন কেউই নেই। 

মোংলা পোর্ট পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড ও উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে কাইনমারী খাল। খালটি পৌর শহর ছাড়াও উপজেলার চিলা ও চাঁদপাই ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত। এই খালের জোয়ার-ভাটার পানির উপরই নির্ভর করে উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়নের মালগাজী, কাইনমারী, শাহজালাল পাড়া, ব্রাক্ষণমাঠ ও চিলা ইউনিয়নের হলদিবুনিয়া গ্রামের প্রায় ৫ হাজার একর ফসলি জমির চাষাবাদ। কিন্তু দীর্ঘ আট বছর পূর্বে পৌর শহরে ঝড়-জ্বলোচ্ছাসের প্লাবন রোধে কাইনমারী খালের মুখে স্লুইস গেইট নির্মাণ করে পৌর কর্তৃপক্ষ। সেই থেকেই পানির অভাবে চাষাবাদের ক্ষতিতে পড়েন এই ৫টি গ্রামের ২০ হাজার কৃষি জমি পরিবার। শুরুতেই তারা স্লুইস গেইটের ক্ষতির মুখে পড়লে তারা ছুটে যান পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে। কর্তৃপক্ষ তাদেরকে পানির সমস্যা হবেনা, জমিতে তিন ফসল করার পানি স্লুইস গেইট দিয়ে সরবরাহ করা হবে বলে আশ্বাস দেন।

সর্বশেষ গত ২১ আগস্ট গ্রামবাসী স্লুইস গেইট সব সময় খোলা রাখার দাবীতে খুলনা সিটি মেয়র, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উপমন্ত্রী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন। যখনই গ্রামবাসী স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দারস্থ হন তখন এক দুইদিন স্লুইস গেইটি খুলে রেখে আবারো তা বন্ধ রাখা হয়। স্লুইট গেইট দিয়ে জোয়ারের পানি পৌর শহর প্লাবিত হওয়ার আশংকায়ই মুলত গেইটি বন্ধ রাখা হয় বলে অভিযোগ গ্রামবাসীর। শহর তলানোর অজুহাতে স্লুইস গেইট বন্ধ রেখে হাজার হাজার একর কৃষি জমি ধ্বংস করা হচ্ছে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো। ফসলি জমিতে ঠিক মত পানি পাওয়া ও জোয়ারের সময় স্লুইস গেইটি খোলা রাখার দাবীতে মালগাজী এলাকায় রবিবার সকালে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন জমির মালিক শত শত নারী-পুরুষ।

মোংলার মালগাজী, কাইনমারী ও শাহজালাল পাড়াসহ ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, যে জমিতে এখন অন্তত হাটু সমান তা না হলেও হাতখানেক পানি থাকার কথা সেখানে এক ফোটাও পানি নেই। জমিতে পাতো অর্থাৎ ধানের চারা রোপন করতে গেলে সাধারণ ৯ ইঞ্চি পানির প্রয়োজন। সেই পানি না থাকায় জমি চষতেও পারছেন না চাষীরা। অপরদিকে গেল বর্ষায় কেউ কেউ পাতো লাগাতে পারলেও এখন পানির অভাবে আর রোদের তাপে তা পুড়ে বিবর্ণ হয়ে মারা যাচ্ছে। দেখা গেছে একরের পর এক খালি জমি পড়ে রয়েছে। আবার একরের পর এক জমির ফসল পুড়ে মারা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও বৃষ্টির সামান্য পানি থাকলেও তা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। পানি শুকিয়ে ঘেরগুলোতে মারা যাচ্ছে কাকড়া ও চিংড়ি মাছ।

বৃষ্টির পানিতে জমি চাষাবাদ করে ফসল রোপন ও ঘেরে মাছ ছাড়েন স্থানীয় জমি এবং ঘের মালিকেরা। কিন্তু এখন চাষের ভরা মৌসুমে খাল দিয়ে জোয়ারের পানি বিলে না উঠায় ধান ও মাছ চাষ দুইটিই চরম হুমকিতে পড়েছে। দুই চারদিনে বিলে পানি না উঠলে রোপনকৃত ধান ও ঘেরে ছাড়া মাছ সবই মরে যাবে বলে জানিয়েছেন তারা। পানির চাহিদা মিটাতে কেউ কেউ খালের সাথে শ্যালো মেশিন দিয়ে জমিতে পানি দিচ্ছেন। সমুদ্র উপকূলের মোংলায় শ্যালো মেশিন দিয়ে জমিতে পানি দেয়াটার চিত্র প্রকৃতির সাথে যেন এক ধরণের রশিকতা। পানিতে তলানো উপকূলের মানুষ জোয়ারের পানির অভাবে মেশিন দিয়ে জমিতে পানি দেয়ার চিত্রটি আবার বিলাসিতার পরিচয় বহন করছে।

চাঁদপাই গ্রামের হাবিব মোল্লা বলেন, আমাদের কাইনমারী খালে একটি স্লুইস গেইট আছে, যেটি নিয়ন্ত্রণ করে পৌরসভা। স্লুইস গেইটির কারণে আমাদের জমিতে এই ৮ বছর ধান ও মাছ পাইনা। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীর, ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, খুলনা সিটি মেয়র ও উপমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে জানানোর পরেও আমরা এর কোন প্রতিকার পাইনি। কয়েকদিন আগে যখন বৃষ্টি ছিল তখন আমরা ধান লাগিয়েছি, এখন বৃষ্টি কমে গেছে তাই জমি শুকিয়ে ফেটে গেছে। তাই এই গেইটটির কারণে আমরা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্থ।

মালগাজী গ্রামের সৌল দাস বলেন, আমাদের বিলের অবস্থা খুব খারাপ। খালের জোয়ারের পানি আমরা পাইনা। মেশিন দিয়ে পানি দিয়ে জমিতে ধান চাষ করতে হচ্ছে। মেশিনের পানি দিয়েও ঠিক মত ফসল ফলাতে পারছিনা। গেইটি খুলে দিলে জোয়ারের পানিতে আমরা ফসল ফলাতে পারতাম।

একই গ্রামের হাসি মন্ডল বলেন, স্লুইস গেইটের কারণে জোয়ারের পানি আমাদের জমিতে উঠছেনা, ঘের-ভেড়ীতেও মাছ হচ্ছেনা। আমরা একদম নি:স্ব হয়ে গেছি স্লুইস গেইটের কারণে। আমাদের আকুল আবেদন-নিবেদন এই যে, আমরা যেন গেইটি খোলা পাই, তাহলে আমরা ধান ও মাছ চাষ করতে পারবো। গত বছরও আমরা কোন ধান পাইনি, এ বছরও অনেক কষ্ট করে ধান লাগিয়েছি। স্লুুইস গেইন এভাবে বন্ধ থাকলে আমাদের মরা ছাড়া কোন পথ থাকবেনা।

আমাদের এলাকার এমপি, চেয়ারম্যান সবাইকে বলেছি কোন কিছু হয়নি। এক বিঘা জমি চষতে গেলে ১৫শ করে টাকা লাগে, তারপর কৃষানকে দিতে হয় ৬শ করে। কিভাবে আমরা জমি চাষ করবো, বেঁচো থাকবো।
মোংলা পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আ. রহমান বলেন, স্লুইস গেইটি সব সময় খোলা রাখা হয়। মুলত পলি পড়ে খাল ও ফসলী জমি উচু হয়ে যাওয়ার কারণে জোয়ারের পানি উঠছেনা। খালটি সংস্কাকেরর জন্য একটি প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে আশা করছি পানি সমস্যা থাকবেনা।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার কমলেশ মজুমদার বলেন, এ নিয়ে প্রথমে যখন আমার কাছে অভিযোগ আসে তখন আমি সাথে সাথে সেটি পৌর কর্তৃপক্ষকে বলি। তখন গেইট খুলে দিয়ে পানির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে এটির স্থায়ী সমাধানের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পৌর কর্তৃপক্ষের কিছু কাজ করতে হবে। এ বিষয়টি নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পারদর্শী যারা রয়েছেন তাদের মাধ্যমে তদন্ত করে দেখি যাতে জনগণের দুর্ভোগ লাঘব হয়। তারা যাতে মাছ ও ধান চাষ করতে পারে তার সুব্যবস্থার জন্য কি করা যায় তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো। জোয়ারের সময় যেন পৌর কর্তৃপক্ষ গেইটটি খোলা রাখে সেই ব্যবস্থাও নিচ্ছি।

(এসএকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২১)