শিতাংশু গুহ


আফগানিস্তানে তালেবানরা সরকার গঠন করেছে। সোজা ভাষায় বললে, তালেবানরা পারেনি, আইএসআই সরকার গঠন করে দিয়েছে। এ সরকারে প্রায় সবাই কমবেশি জঙ্গী। লন্ডনের ‘দি সান’ পত্রিকা বলেছে, তালেবানদের নারকীয় সরকার সন্ত্রাসী ভরপুর, যাঁরা ৯/১১-র ধ্বংসযজ্ঞ, বৃটিশ নাগরিক হত্যাকারী এবং বিবিধ অত্যাচারে জড়িত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজুদ্দীন হাক্কানী এফবিআই’র ‘গ্লোবাল টেরোরিষ্ট’ তালিকার অন্তর্ভুক্ত। নুতন সরকার ‘শরীয়া’ প্রতিষ্ঠা করবে বলেছে; নারীদের খেলাধুলা, বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। অবাক হচ্ছেন? তালেবানদের কাছে কি আপনি ‘পশ্চিমা গণতন্ত্র’ আশা করছিলেন বা নিদেন পক্ষে ‘ভারতীয় গণতন্ত্র’? ওঁরা ইসলামী শাসন চায়, ওঁরা তাই করছে। আফগানিস্তানে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইসলামী শাসনের প্রকৃত চেহারা বা মুঘল আমলের শাসনব্যবস্থার বাস্তব চিত্র।

আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণ ইসরাইলকে নুতন করে ভাবতে শেখাচ্ছে যে, ‘বাঁচতে হলে যুদ্ধ করেই বাঁচতে হবে, প্রয়োজনে একাই লড়াই করতে হবে’। ইসলামী জঙ্গীবাদ বিশ্বকে সেই দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলের মত ভারতের জন্যেও একই কথা প্রযোজ্য। তালেবানরা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে তাঁরা কাশ্মীরে দৃষ্টি দেবে। তাঁরা ভারতীয় মুসলমানদের প্রভাবিত করবে, ইতিমধ্যে সেই আলামত স্পষ্ট। তালেবানদের শত্রু কারা? ইসরাইল, ভারত, আমেরিকা, পশ্চিমা জগৎ বা এক কথায় সভ্য দুনিয়া। সত্য, সুন্দর, সভ্যতা, সংস্কৃতি ধ্বংস করাই ‘তালেবানী সংস্কৃতি’ বা ‘ইসলামী সংস্কৃতি’। অনেকেই বলবেন, তালেবান তো আমেরিকার সৃষ্টি। এঁরা বুঝেও না বোঝার ভাণ করে যে, আমেরিকা কিন্তু হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টানদের দিয়ে কোন জঙ্গী গ্রূপ তৈরী করতে পারেনি?

আমেরিকা বড় শত্রু, এঁকে সহজে ঘায়েল করা যাবেনা, বাইরে থেকে তো নয়ই, তাই ভেতর থেকেই এঁকে আঘাত করার অপচেষ্টা হচ্ছে। ইসরাইল সরাসরি শত্রু। ভারতের ক্ষেত্রে ভেতরে-বাইরে সমান তালে আঘাত হানা হবে? ভারতের ওপর আঘাত আসুক, উপমহাদেশের বেশির ভাগ মুসলমান তা চান, কারণ এঁরা ধর্মীয়ভাবে ‘এন্টি-ভারত’ বা ‘এন্টি হিন্দু-ভারত’। আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই, সামাজিক মাধ্যমে চোখ রাখলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। তাই হয়তো ভারত বন্ধুর খোঁজে নেমেছে, হয়তো পেয়েও গেছে পুরানো বন্ধু রাশিয়াকে? ভারত-রাশিয়া জোট হচ্ছে? জোট হোক বা না হোক, রাশিয়া ভারতের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে, এমুহুর্তে এটি ভালো সংবাদ। বেশিদিনের কথা নয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ঠিক আগখানে ভারত-রাশিয়া চুক্তি নুতন মাত্রা এনে দিয়েছিলো।

পূর্ববর্তী এক নিবন্ধে লিখেছিলাম, আমেরিকা-তালেবান একটি ‘ডিল’ আছে? তালেবানরা কি সিআইএ, ওয়াশিংটন-র নুতন বন্ধু হতে যাচ্ছে? আমেরিকা কি চীনের বিরুদ্ধে তালেবানকে ব্যবহার করবে? পাকিস্তানের ‘ইসলামিক বোমা’-র কথা কি ওয়াশিংটন ভুলে গেছে বলে মনে হয়? একটি থিওরী আছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেন মুখ্যত: ভারত ও মোদীকে বিপদে ফেলতে তড়িঘড়ি আফগানিস্তান ছাড়লেন এবং বহু সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র ইচ্ছে করেই ফেলে এসেছেন, যাতে তালেবানরা ওগুলো ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। চমৎকার থিওরী, তবে বাইডেন যে ‘ব্যর্থ’ আমেরিকানরা তা বুঝে ফেলেছে। ঘটনা যাই হোক, মার্কিন এ পদক্ষেপে ভারত, ইসরাইল বা এমনকি রাশিয়া কিছুটা হলেও বিপাকে তা বলা বাহুল্য। হয়তো তাই রুশ-মার্কিন সমর-কর্মকতারা তড়িৎ দিল্লী ছুটে এসেছেন।

‘মর্নিং শোজ দি ডে’ কথাটা যদি সত্য হয় তবে ‘এ তালেবান আর ৯০’র তালেবান একই’, বা ‘নুতন বোতলে পুরানো মদ’। আপনি গাছ লাগাবেন ‘ভেরেন্ডা’, ফল চাইবেন ‘আপেল’ তা তো হয়না? আফগানিস্তান যদি আগের মতই একটি ‘বিষফোঁড়া’ হয় তাহলে এ সমস্যার সমাধান কি? এটম বোমা মেরে গুড়িয়ে দেয়া? নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও রাশিয়া যেমনি ‘জার্মানী’ ভাগ করে নিয়েছিলো, তেমনি আফগানিস্তানকে ভেঙ্গে সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সাথে মিশিয়ে দেয়া? আমেরিকা বা রাশিয়া ভৌগোলিক কারণে কখনোই পুরো আফগানিস্তানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কিন্তু আফগানিস্তান ভেঙ্গে ৪/৫টি দেশকে দিলে ছোট্ট এলাকা, কম সংখ্যক মানুষ বিধায় তালেবানদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ইতিমধ্যে ‘কাজাকরা’ কাজিকিস্থানের সাথে যেতে আবদার জানাচ্ছে? আফগানিস্তানে বহুবিধ গোষ্ঠীদ্ধন্ধ তো আছেই। পাকিস্তানী সেনা, যুদ্ধ-বিমান যেমনি পাঞ্চির উপত্যকা তালেবানদের পদাবনত করে দিয়েছে, ‘বিশ্ব-শান্তি’-র জন্যে কেজানে হয়তো বৃহৎ শক্তিগুলোকে একদিন তা করতে হতেও পারে?

এ মুহূর্তে পাকিস্তান-আফগানিস্তান-চীন অক্ষ:শক্তি শুধু যে ভারত-আমেরিকা বা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্যে হুমকিস্বরূপ তা নয়, সময়ের ব্যবধানে ‘ইসলামী জঙ্গীবাদ’ চীনের জন্যেও বিপদ ডেকে আনতে পারে। রাশিয়াকে ঠেকাতে আমেরিকা তালেবান সৃষ্টি করেছে, সেটি বুমেরাং হয়েছে। চীনের জন্যেও তালেবান বুমেরাং হতে পারে। চীনের বাড়তি সুবিধা যে, চীন ‘মানবাধিকার’, গণতন্ত্র এসব কেয়ার করেনা, প্রয়োজনে চীন তালেবানদের ‘উইঘুরের মুসলমানদের’ মতই আচরণ করবে। ইসলামী সন্ত্রাসবাদ দমনে চীন-রাশিয়ার ব্যবস্থা আমেরিকার থেকে উত্তম। ভারতের হয়তো ভবিষ্যতে চীন-রাশিয়ার রাস্তা ধরতে হবে, নতুবা ইসরাইলের পথ অনুসরণ ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না? তালেবানরা বাড়াবাড়ি করলে ভারত কি আফগানিস্তান আক্রমন করবে?

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।