সাইফুল ইসলাম


সেনানিবাসগুলোতে বিদ্রোহ ঘটলেও বুঝতে কষ্ট হয় না যে, এটা পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না, ছিল তাৎক্ষণিক দেশপ্রেম এবং আত্মরক্ষার তাগিদ। তৃণমূল খুঁটে দেখলেও এর প্রমাণ মেলে। বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই তালুকদার লেখক-সংগঠকদের কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সিরাজগঞ্জ শহর দখল হওয়ার সপ্তাহ খানেক পরের ঘটনা। আমরা কয়েকজন বসে আছি কুড়াগাছা হাটখোলায়। এ সময় পশ্চিম দিক থেকে আসতে দেখা যায় ইপিআরের দুই সদস্যকে। তাদের পরণে ইপিআরের পোশাক, কাঁধে চাইনিজ রাইফেল। কিন্তু তাদের হাঁটাচলায় ক্লান্তির ছাপ। আমরা ওদের সঙ্গে দেখা করে যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। ওরা পাকিস্তান সেনা প্রতিরোধ করতে গিয়ে দলছুট হয়ে পড়েছে। আমাদের দুটো লুঙ্গি জোগাড় করে দেওয়ার অনুরোধ জানালো ওরা। দিলাম দুটো লুঙ্গি জোগাড় করে। ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। ওরা রাইফেল কাঁধে নিয়ে যাওয়াকে বিপদজনক মনে করছে। আমাদের কাছে রাইফেল আর গুলি দিয়ে যেতে চাইল, রাস্তায় ফেলে দিতে পারেনি তা ডাকাতের হাতে পড়বে বলে।’ [১০ মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধস্মৃতি- ৩য় খণ্ড] অথচ তখনো আব্দুল হাই তালুকদার চাইনিজ রাইফেল চালাতে জানতেন না, সবেমাত্র চালাতে শিখেছেন থ্রিনটথ্রি রাইফেল। এভাবেই অস্ত্র চলে আসতে থাকে জনগণের হাতে।

এতো গেল দলছুট দুই সৈনিকের কথা। যারা দলবদ্ধ ছিল, তাদেরও দেখা যায় প্রয়োজনীয় রণনীতি রণকৌশল খুঁজে বের করে প্রতিরোধের চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার প্রবণতাই প্রধান। তাইতো তারা ধীরে ধীরে চলে যায় সীমান্ত এলাকায়, প্রধানত ভারতে। এর আগে ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া [হবিগঞ্জ] মিলিত হন বেঙ্গল রেজিমেন্টের কতিপয় কর্মকর্তা। সেখানে কর্নেল ওসমানীকে নিয়ে উপস্থিত হন ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তা। এক চা বাগানের ডাক বাংলোয় অনুষ্ঠিত বৈঠকে কর্নেল ওসমানীকে বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে বেড়িয়ে আসা বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। উপস্থিত সেনা কর্মকর্তারা তাদের বাহিনী নিয়ে চলে যান ভারত সীমান্তে। মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয় ১৭ এপ্রিল। এরপর মুক্তিবাহিনী গঠন করে তার দায়িত্ব দেওয়া হয় কর্নেল এমএজি ওসমানীকে। জুন মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশকে ১১ টি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। একেকটি অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিদ্রোহ করে আসা সেনা কর্মকর্তাদের।

১০ জুলাই সেক্টর অধিনায়কদের সভা বসে। বৈঠকে অধিনায়কদের একটি অংশ প্রস্তাব দেয় কর্নেল ওসমানীকে ‘দেশরক্ষা মন্ত্রী’ পদে উন্নীত করে একটি ‘যুদ্ধ কাউন্সিল’ গঠনের। সাতজন তরুণ অধিনায়কের সমবায়ে গঠিত এই ‘যুদ্ধ কাউন্সিল’এর কাছে মুক্তিযুদ্ধের ব্যবস্থাপনার কথাও এ প্রস্তাবে বলা হয়। প্রস্তাবের মূল কথা দাঁড়ায় প্রধান সেনাপতি থেকে কর্নেল ওসমানীর পদত্যাগ। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পদত্যাগ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর বারংবার অনুরোধে এ প্রস্তাব প্রত্যাহার করতেই প্রথম দিন চলে যায়। এরপর কয়েকদিন ধরে আলোচনায় দেশের ভিতরে ‘গণবাহিনী’ অর্থাৎ এফএফ এবং সীমান্ত এলাকায় ‘মুক্তিফৌজ’ অর্থাৎ নিয়মিত বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই নিয়মিত বাহিনীর মাধ্যমে সীমান্ত এলাকায় কিছু মুক্তাঞ্চল গঠন করে তা সম্প্রদারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সভা থেকেই তিনটি ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব ব্রিগেডের নামকরণ করা হয় জেড ফোর্স, কে ফোর্স ও এস ফোর্স।

বলে নেওয়া ভালো যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে আগত বিদ্রোহী কর্মকর্তাদের ওই বাহিনীতে শেখানো হয়েছিল কনভেনশনাল ওয়ার বা প্রথাগত যুদ্ধ। তারা সেই কৌশলকেই মুক্তিযুদ্ধে প্রয়োগের উদ্যোগ নেয়। মুক্তিযুদ্ধে প্রয়োজনীয় গেরিলা যুদ্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বললেই চলে। এমনকি, গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তত করা এফএফকেও সীমান্তে নিয়মিত যুদ্ধে সহায়তার কাজে লাগানো হয় যা আগেই বলা হয়েছে। এখন দেখা যাক, তিনটি ব্রিগেড কী অবস্থা দাঁড়ায় এবং তা মুক্তিযুদ্ধে কী কাজে লাগানো সম্ভব হয়?

জুলাই মাসে মেঘালয়ের তুরায় ১-৩ ও ৮ ইষ্ট বেঙ্গলের সমন্বয়ে জেড ফোর্স গঠণের উদ্যোগ নেওয়া হয় যার নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন কর্নেল ওসমানী। এসব বেঙ্গলের খণ্ডিত অংশ ভারত সীমান্তে পাড়ি জমাতে পারায় লোকবল [প্রয়োজন ৯১৫] ছিল প্রয়োজনের তূলানায় অনেক কম। এ অবস্থায় ইষ্ট বেঙ্গলের সঙ্গে যুক্ত করা হয় ইপিআর, পুলিশ, আনসার সদস্যদের। তাতেও ঘাটতি পড়ায় ছাত্র-যুবকদের রিক্রুট করে যুক্ত করা হয়। তৃণমূল থেকে জানা যায়, সিরাজগঞ্জেরই সাহার উদ্দিন, আব্দুল মান্নান তালুকদার, নজরুল ইসলাম ননী, হযরত আলী খাজা, হারুণর রশীদসহ শতাধিক তরুণ যুক্ত হন এই ফোর্সে। এরা প্রধানত গেরিলা যুদ্ধের মানসিকতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। তাদের দিয়ে নিয়মিত যুদ্ধ করানোয় মাঝেমধ্যেই ওই বাহিনীতে ক্ষোভ দেখা দিত। একটি ব্যাটেলিয়ান পরিচালনার জন্য ১৫/১৬ জন অফিসারের প্রয়োজন, সেখানেও ঘাটতি ছিল। সে ঘাটতি পূরণের জন্য তিন মাসের একটি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, কিন্তু সেখানেও ঘাটতি। কেননা জেড ফোর্স গঠনের পর অপর দুই সেক্টর থেকে কে ফোর্স ও এস ফোর্স গঠনের চাপ আসতে থাকে। এজন্যও ভারতের দিকেই হাত বাড়াতে হয়।

যাই হোক, খালেদ মোশারফকে ১০ ইষ্ট বেঙ্গল এবং ১১ ইষ্ট বেঙ্গল পূর্ণগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এজন ১৫ নভেম্বরের মধ্যে ১০ ইবির জন্য ৭শ’ এবং ১১ইবির জন্য ৭শ’ জনকে হাজির করা যায়। ৯ ইষ্ট বেঙ্গলের দায়িত্ব খালেদ মোশারফের ওপর। ২০ নভেম্বর এজন্য হাজির হয় ৩শ’ যুবক যার অধিকাংশই আনাড়ি। ফলে এইসব ফোর্স মুক্তিযুদ্ধে কতটুকু কাজে লেগেছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। তারচেয়েও বড় কথা, সেপ্টেম্বর মাসের শেষে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী তার অপারেশন প্ল্যান পাল্টে ফেলেন। তাতে বলা হয়—‘যে কাজের জন্য ব্রিগেড গঠন করা হয়েছিল, তা অর্জনের ক্ষেত্রে এ যাবত ব্রিগেডকে ব্যবহার করা যায় নি এবং অদূর ভবিষ্যতেও করা যাবে বলে মনে হয় না।’ নতুন পরিকল্পনায় ওসমানী বলেন, ‘বর্তমান যেহেতু ব্রিগেড ও ব্যাটেলিয়ানের উপযোগিতা অতি নগণ্য, সেহেতু নিয়মিত বাহিনীকে বরং কোম্পানি/প্লাটুনে বিভক্ত করে দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা তৎপরতা জন্য নিয়োগ করা উচিত।’ এই ছিল ফোর্সের অবস্থা।

বিভিন্ন সেক্টরে অবস্থানরত সৈনিকেরা তাদের সামর্থ নিয়ে সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল। তারা মূলত সীমান্ত বাংলাদেশের ১৫ মাইলের ভিতরে অবস্থানরত পাকসেনাদের ক্যাম্পে হামলা চালাতো। তারপর আবার ফিরে যেতো সীমান্তবর্তী নিজস্ব ক্যাম্পে। এই আক্রমনে তারা তাদের সঙ্গে থাকা এফএফকে কাজে লাগাতো। সহযোগিতা নিত বিএসএফ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর। সেক্টর দফতরের আরো একটি কাজ এফএফকে ভিতরে পাঠানো। তবে এ কাজে প্রধানত সেক্টর কমান্ডার দফতর থেকে আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা করা হতো। অনেক ক্ষেত্রে ভিতর থেকে এফএফ সদস্যরা যোগযোগ না করলে তাদের সঙ্গে সেক্টর হেড কোয়ার্টারের কোনও যোগযোগই থাকতো না। যোগাযোগের কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবনেরও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যে দু’একটি সেক্টরের এমন উদ্যোগ পাওয়া যায় তা-ও ছিল সেক্টর কমান্ডারের ব্যক্তিগত ইচ্ছানুযায়ী।

২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠন করা হয়। ওই দিনই ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মিলে গঠন করা হয় যৌথ বাহিনী। চূড়ান্ত স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়া তখন হয়ে ওঠে সময়ের ব্যাপার। বাংলাদেশের ১১ টি সেক্টর ভেঙে বিজয়ের সুবিধার্থে বাংলাদেশকে ৪টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এটি প্রধানত ভারতীয় বাহিনীর আক্রমন পরিকল্পনা। যৌথ বাহিনী শুরু করে চূড়ান্ত আক্রমন। সে আক্রমনে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনা মুক্ত হয় বাংলাদেশ।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক, আহ্বায়ক- সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি।