স্টাফ রিপোর্টার : কারও ব্যক্তিগত বিষয় মিডিয়ায় সগৌরবে প্রচার করা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, কেউ যদি ফোনে আড়িপাতে এবং রেকর্ড করে তাহলে সেটা চিহ্নিত করার বিষয় আছে। এছাড়া তৃতীয় পক্ষের যদি কেউ রেকর্ড করে মিডিয়ায় দেয়, আর মিডিয়া সেটা প্রচার করে, সেক্ষেত্রে মিডিয়ারও একটা ভূমিকা থাকা দরকার। সগৌরবে প্রচার করা উচিত না।

এরপরে ফোনে আড়িপাতা বন্ধে ও ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনার তদন্ত চেয়ে করা রিটের বিষয়ে আদেশের জন্য আগামী রবিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দিন ঠিক করেন হাইকোর্ট।

সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবীর করা এই রিটের শুনানি নিয়ে সোমবার (১৩ সেপ্টেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মুস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল বেঞ্চ এমন মন্তব্য করার পরে আদেশের জন্য এই দিন ঠিক করেন।

আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। তার সঙ্গে ছিলেন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার। রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। আর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খোন্দকার রেজা-ই-রাকিব।

আদালতে শুনানির শুরুতেই রিটকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় কারও ফোনালাপ রেকর্ড করায় আপত্তি নেই। কিন্তু এর বাইরে যেকোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত ফোনালাপ রেকর্ড ও ফাঁস করার আইনগত অধিকার কারও নেই, আমাদের বক্তব্য এখানে। তাই ফোনালাপ ফাঁস বন্ধে রুল জারির আবেদন করছি। আর যেসব ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, সেসব ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে বিটিআরসি যেন তদন্ত করে সেই নির্দেশনা চাচ্ছি।

এরপরে আড়িপাতা রোধে করা রিটের বিরোধিতা করে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, যারা রিট আবেদন করেছেন, তারা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হননি। তারা আইনজীবী। একারণে তাদের এই রিট আবেদন করার আইনগত এখতিয়ার নেই।

তিনি বলেন, কারও ফোনালাপ ফাঁস হলে তিনি বিটিআরসি আইন অনুযায়ী প্রতিকার চেয়ে ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় আইনেই মামলা করতে পারেন। ক্ষতিপূরণ চাওয়ার সুযোগ আছে। প্রতিকার পাওয়ার সুনির্দিষ্ট আইন থাকায় জনস্বার্থে রিট আবেদন করার সুযোগ নেই।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা আরও বলেন, এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত কেউ কী বিটিআরসি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গিয়ে বলেছে যে, তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন হচ্ছে? কিংবা এধরনের অভিযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কেউ কি ব্যর্থ হয়েছেন? সেরকম হলে রিট নিয়ে আসতে পারতো। এক্ষেত্রে তো তেমনটা হয়নি।

বিটিআরসির আইনজীবী ব্যারিস্টার খোন্দকার রেজা-ই-রাকিব অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, আইনে যদি সুযোগ না থাকতো তবেই সংবিধান অনুযায়ী এই রিট আবেদন করার সুযোগ থাকতো। যেহেতু আইনে সুনির্দিষ্ট বিধান আছে, তাই রিট আবেদন করার সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হন তবে তিনি বিটিআরসির কাছে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করতে পারেন। এখানে রিট আবেদনকারী কেউই সেটা করেননি। তাই রিট আবেদন চলতে পারে না। এ সময় তিনি ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে বিভিন্ন কনটেন্ট সরানোর বিষয়ে বিটিআরসির সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, অন্য একটি বেঞ্চ (হাইকোর্ট) ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে কনটেন্ট সরানোর নির্দেশ দেন। আপিল বিভাগ থেকেও প্রধান বিচারপতি সংক্রান্ত একটি পোস্ট সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতি সংক্রান্ত পোস্টটি সরানো গেছে। বাকিগুলোতে আমরা কিছু করতে পারিনি। সেখানে আমাদের হাত নেই। আপত্তিকর কিছু সরানোর বিষয়ে আমাদের কারও সক্ষমতা নেই। ফেসবুক বা ইউটিউব কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হয়। তাদের বলতে হয়। এরপর তারা যদি সরাতে চায় তবেই কেবল সেটা সম্ভব। এখানে বিটিআরসি নিজে নিজে কিছুই করতে পারে না।

তখন অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, দেশে আইনের শাসন রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য একজন আইনজীবী আইনি কাঠামোর মধ্যে সব করতে পারেন। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আইনে যখন একজন আইনজীবী শপথ নেন, এই শপথ অনুযায়ী একজন আইনজীবী দেশের স্বার্থে রিট আবেদন করতে পারেন।

তিনি বলেন, বার কাউন্সিল আইন অনুযায়ী আইনগত প্রতিকার পাইয়ে দেওয়া দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা একজন আইনজীবীর শপথের অংশ। এখানে অ্যাটর্নি জেনারেল নিজেই বার কাউন্সিলের অংশ। সে কারণে একজন আইনজীবী রিট আবেদন করার অধিকার রাখেন।

শিশির মনির বলেন, বিটিআরসির আইনে ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আছে সত্য। কিন্তু এই রিট আবেদন করার আগে বিটিআরসিসহ সংশ্লিষ্টদের লিগ্যাল (আইনি) নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত এর কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এ কারণে রিট আবেদন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারের তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে যেকোনো নাগরিকের ফোনালাপ রেকর্ড করার সুযোগ আছে। এটা নিয়ে আমাদের কোনো কথা নেই। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় ফোনালাপ রেকর্ড করুক তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু যেকোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত ফোনালাপ রেকর্ড ও ফাঁস করার আইনগত অধিকার কারও নেই। আমাদের বক্তব্য এখানেই। সংবিধান অনুযায়ী ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষায় বিটিআরসিকে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের বক্তব্য বিটিআরসি আইনের ৩০(চ) ধারা অনুযায়ী ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার আগেই বিটিআরসি ব্যবস্থা নিতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে ফোনালাপ, ক্রিকেটার নাসির, ছাত্রলীগ নেতার ফোনালাপ, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও নূর হোসেনসহ যেসব ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে তার কিছু নজীর তুলে ধরে এই আইনজীবী বলেন, এটা ফাঁস হওয়ার আগেই বিটিআরসি ব্যবস্থা নিতে পারতো। এখনো পারে। কারণ মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ, পর্যবেক্ষণ করার আইনগত ব্যবস্থা বিটিআরসির আছে। সেই ব্যবস্থায় ফোনালাপ ফাঁসও বন্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে বিটিআরসি। একারণে ফোনালাপ ফাঁস বন্ধে রুল জারির আবেদন করছি। একইসঙ্গে এরইমধ্যে যেসব ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, সেসব ঘটনা সঙ্গে কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে বিটিআরসি যেন তদন্ত করে সেই নির্দেশনা চাচ্ছি।

সব পক্ষের শুনানির শেষ হওয়ার পর হাইকোর্ট সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন, কেউ যদি ফোনে আড়িপাতে, কেউ যদি রেকর্ড করে এটা চিহ্নিত করার বিষয় আছে। তৃতীয় পক্ষ যদি কেউ রেকর্ড করে বিভিন্ন মিডিয়ায় দেয়, আর মিডিয়া যদি সেটা প্রচার করে, এক্ষেত্রে কিন্তু মিডিয়ারও একটা ভূমিকা আছে।

সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আদালত বলেন, সম্প্রতি আমি একটা মিডিয়ার প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে কিছু কিছু রিপোর্টিংয়ের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই রিপোর্টগুলো এত বেশি হাইলাইট করে প্রচার করার কী আছে, জানতে চাইলাম। শেষমেশ উনাদের কাছ (সাংবাদিকদের) থেকে যে বক্তব্যটা পেলাম সেটা হলো, কিছু কিছু খবর প্রচার হওয়ার পর যখন তারা (গণমাধ্যম) এটা ফেসবুক বা ইউটিউবে দেয় তখন এটাতে লাইক পড়ে, শেয়ার হয়। এতে নাকি লাখ লাখ টাকা আয় হয়। এ বিষয়টা কিন্তু অনেক সময় এ ধরনের নিউজগুলো (অডিও-ভিডিও ফাঁসের) প্রচারের পেছনে কাজ করে। আজকাল নানা ধরনের টিভি হয়েছে, এসবের লাইসেন্সও নাই, ঘরে ঘরে অনলাইন টিভি।

‘এই সমস্যাগুলো কিন্তু আছে। যখন এ ধরনের নিউজ মিডিয়ায় পাবলিকলি চলে যায় তখন কিন্তু এসব খবরগুলো ব্যক্তিকে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিন্তু কারা করে এটা আমরা জানি না। দুইপক্ষের এক পক্ষ করেও দিতে পারে, তৃতীয়পক্ষ করতে পারে। তৃতীয় পক্ষের কী লাভ, আমার মনে হয় বিটিআরসিকে এটা দেখা দরকার।’

অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের জবাবে আদালত বলেন, ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে আড়িপাতা যেমন ঠিক না, তেমনি মিডিয়া সগৌরবে যেভাবে প্রচার করে এটাও কিন্তু ঠিক না। রিসেন্টলি জাপানি এক নারী হাইকোর্টে আসেন যেন তার কনটেন্টগুলো অপসারণ করতে বিটিআরসিকে আদালত নির্দেশ দেন। জাপানি ওই নারী এখন কোথাও গেলে রাস্তায় লোকজন তাকিয়ে থাকেন।

আদালত আরও বলেন, প্রশ্ন হচ্ছে এগুলো যখন মিডিয়ায় চলে যায়, দুইদিন-তিনদিন ধরে চলে তখন আর এটা... এসব বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকা দরকার। আমরা এ বিষয়ে আরও আইন দেখি। রোববার (১৯ সেপ্টেম্বর) আদেশের জন্য দিন রাখলাম।

(ওএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২১)