আবীর আহাদ


মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে এখনো অনেক সৎ মেধাবী ও ত্যাগী মানুষ রয়েছে। এসব মানুষ থাকতে, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার পরিপন্থী হয়ে এদেশে বসবাস করার সব রকম যোগ্যতা হারিয়েছে, সেসব চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, রাজাকারের বাচ্চা, সুবিধাবাদী ও হাইব্রিডদের দলে ও প্রশাসনে রাখার কী প্রয়োজন তা মোটেও বোধগম্য নয়। তারা দেশটার রাজনৈতিক আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক ও মনোজগতকে অন্তঃসারশূন্য করে দিয়েছে যা ক্ষমতার রঙিন চশমা পরে দেখলে বুঝা যাবে না।

আজ সমাজ ও দেশে সম্প্রীতি, সহমর্মিতা, মানবিক মর্যাদা ও মূল্যবোধের চরমতম অবক্ষয় ঘটেছে। সমাজে ভক্তি শ্রদ্ধা স্নেহমমতায় চিড় ধরেছে। কারো প্রতি কারো আস্থা নেই। বিশ্বাস নেই। পরমতসহিষ্ণুতা, সহনশীলতা ও সৌজন্যবোধ লোপ পাচ্ছে। এসব কিছুর মূলে রয়েছে অবাধ ও অনৈতিক অর্থনৈতিক লিপ্সা ও অব্যবস্থা। রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ক্ষমতার যে অবস্থানে যিনি রয়েছেন, তিনি যেন ধরাকে সরাজ্ঞান করে সেটির একচ্ছত্র মালিক-মোক্তার হিশেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। দেশের মধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে এতো এতো সাগরসম দুর্নীতি ও লুটপাট হয়ে যাচ্ছে, দু'চারটে চুনোপুঁটি ছাড়া রাঘব বোয়ালদের কিছুই হচ্ছে না! সীমাহীন ব্যাঙ্ক ও শেয়ার বাজার লুট, ভুয়া প্রকল্পের নামে অর্থ আত্মসাত, কমিশন ও ঘুষের সাথে যেসব রাঘব বোয়াল জড়িত তারা বলা চলে ধরাছোঁয়ার উর্দ্ধে! তাদেরকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে আশ্রয় প্রশ্রয় ও নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় বলতে হয়, সবকিছু ফ্রিস্টাইল, চাটার দল চেটেপুটে খাচ্ছে!

দেশের জনগণ একবাক্যে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চান। সরকার সেই উন্নয়নে দায়বদ্ধ। আর কিছু উন্নয়ন করে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলার কোনো মানে নেই। কেউ নিজের পকেট থেকে অর্থ ব্যয় করে উন্নয়ন করছেন না। রাষ্ট্রের উন্নয়ন হয় এদেশের খেটে খাওয়া কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের কষ্টার্জিত অর্থে। কিন্তু উন্নয়নের নামে ১ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় ১০ কোটি দেখানো হবে, ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় ১ হাজার কোটি দেখানো হবে, ২০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় ৫০ হাজারে ঠেকানো হবে, ৭০০ টাকার বালিশ ৭ হাজার টাকায় ক্রয় দেখানো হবে এরকম শত শত প্রকল্পের নামে হরিলুট হয়ে কতিপয় ক্ষমতাবানের অভাবিত ব্যক্তিগত উন্নয়ন হবে তা তো হতে পারে না! বিশ্ব অর্থনীতির একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ধনিক বৃদ্ধির পরিমাণ নাকি বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করেছে! দেশের মধ্যে ধনী-গরিবের বৈষম্য সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এর কারণই হলো সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট। আর সরকারের প্রশ্রয়ে ও পৃষ্ঠপোষকতায় এসব দুর্নীতি ও লুটপাটে দেশের একটি অতি ক্ষুদ্র শ্রেণী জড়িত। দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুটপাট করে এসব লোক সুইস ব্যাংক, পানামা ব্যাঙ্ক, আমেরিকা, কানাডা, সিঙ্গাপুর, দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে এবং করে যাচ্ছে বলে প্রায়শই খবর বেরুচ্ছে! সে-বিষয়ে দুদকসহ সরকারের যেনো কোনো মাথাব্যথা নেই!

রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে সমাজের বুকে যারা খুনখারাবি সন্ত্রাস অত্যাচার মাদক ও অনাচারের বন্যা বইয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেসবেরও তেমন প্রতিকার নেই। দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের সীমাহীন লুঠতরাজের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একশ্রেণীর ধর্মীয় আলেম, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামী, হেফাজত ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনসহ কতিপয় নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি ইসলামী সংগঠন দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদের বল্গাহীন উস্কানি দিয়ে দেশে গৃহযুদ্ধের ডামাডোল সৃষ্টি করছে। তাদের খপ্পরে পড়ে নতুন প্রজন্মের এক বিরাট অংশের মধ্যে দেশপ্রেমহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। কেউ কেউ দেশের সার্বিক অরাজকতা ও সরকারের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের রক্তের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত আমাদের মহান জাতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে অপপ্রচার করে সেটি পরিবর্তনের দু:সাহসও দেখাচ্ছে! কেউ কেউ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কটাক্ষ করে প্রকারান্তরে স্বাধীনতার বেদীমূল ধরে টান মারছে! মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের বেশিরভাগ সরকারি চাকরি চলে গেছে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার পরিবারের খপ্পরে। সরকারের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী লোকজন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টির সরকারের অনুসৃত পথ অনুসরণ করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী লীগ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা প্রকৃত আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে দূরে সরিয়ে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে রাজাকার ও দুর্নীতিবাজ পরিবারের সদস্যদের সরকারের চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়ে তাদেরকে আরো পরিপুষ্ট করে দিয়েছে!

স্বাধীনতার সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বের অবদানসহ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার তাদের ক্ষতিগ্রস্ততা কাটানোর জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে মুক্তিযোদ্ধা কোটাটি তাদের জন্য উপহার দিয়েছিলেন, সেটি অনেকেরই কাছে সহ্য হলো না! আর কী আশ্চর্য, আওয়ামী লীগ সরকার অপপ্রচারকারীদের সাথে সুর মিলিয়ে সেটি বাতিল করে মূলত: তারা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, যা খুবই দু:খজনক। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় তথা সাংবিধানিক স্বীকৃতি আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও দেয়া হলো না! তাদের অবদানকে বলা চলে অস্বীকার করে তাদেরকে তাদের বীরত্বে সৃষ্ট মর্যাদাপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে জাতীয় ভিক্ষুক বানিয়ে মানবেতর জীবনে নিক্ষেপ করা হয়েছে! বঙ্গবন্ধুর ৭২ সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন জগাখিচুড়ি সংজ্ঞায় অমুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার আয়োজন করা হয়েছে। যার ফলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা সর্বসাকুল্যে দেড় লক্ষের স্থলে ইতোমধ্যে দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে! জামুকা নামক এক দানবের হাতে এখনো প্রায় প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধা পয়দা হয়েই চলেছে! এই অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার পশ্চাতে রয়েছে বিভিন্ন সময়ের ক্ষমতাসীন একশ্রেণীর লোকের অবাধ বাণিজ্যিক লিপ্সা। এ প্রক্রিয়ায় অপরাধের মূল বীজ নিহিত রয়েছে সরকারের নীতিমালার মধ্যে। সেই সুযোগ গ্রহণ করে অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে যে-সে বীর মুক্তিযোদ্ধা বনে যাচ্ছে! বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা তালিকার সিংহভাগই হলো অমুক্তিযোদ্ধা, যাদের মধ্যে বহু রাজাকারও ঠাঁই পেয়েছে!

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বপ্রদানকারী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের আজ কী অবস্থা! বলা চলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এখন প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের হাতে নেই! আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত নেতৃত্বের সিংহভাগ এখন অ-আওয়ামী লীগারসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী দুর্নীতিবাজ লুটেরা, সমাজবিরোধী, জামায়াত-শিবির, জাতীয় পার্টি, বিএনপি-ফ্রিডম পার্টি তথা সুবিধাবাদী-হাইব্রিড-কাউয়াদের হাতে চলে গেছে। বিশেষ করে বিগত ১২/১৩ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগের এমপিদের মধ্যে প্রায় ৮০/৮৫ ভাগ এমপিরা এসেছেন আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে। এ প্রক্রিয়ার খোদ জন্মদাতা হলো খোদ আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড! বিপুল অর্থের বিনিময়ে এসব হাইব্রিডরা দল ও সরকারের সর্বত্রে ঠাই করে নিয়েছে! এসব এমপি-নেতাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আওয়ামী চরিত্র বলতে কিছু নেই। তারা তাদের নির্বাচনী এলাকায় তাদের আত্মীয়স্বজন ও মতাবলম্বীদের দিয়ে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনকে সাজিয়ে এমপি-লীগ সৃষ্টি করেছেন। তাই বলা চলে, তৃণমূলে আওয়ামী লীগ বলতে কিছু নেই, আছে এমপি-লীগ!

এখানে একটি উপজেলার একটি তথ্য দেই। চোদ্দটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত উপজেলাটির ৯৮ ভাগ জনগণ ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থক। বিএনপি-জাতীয় পার্টির আমলেও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এ উপজেলার সবক'টি চেয়ারম্যান পদ আওয়ামী লীগ সমর্থকরা পেতো। কিন্তু বিগত দশ বছরে দলীয় প্রতীকে দু'টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এ উপজেলার চোদ্দটি ইউনিয়নের মধ্যে তেরোটি ইউনিয়নের নৌকৌপ্রার্থী চেয়ারম্যান হয়েছেন অতীতের বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি থেকে আগত অর্থশালী হাইব্রিডরা। লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, স্থানীয় এমপি সাহেব ঐসব দলছুটদের কাছ থেকে ৪০/৫০ লক্ষ টাকা নিয়ে তাদের নৌকো উপহার দিয়ে চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। প্রকৃত আওয়ামী লীগাররা তো এমপিকে টাকা দিতে পারেনি বা দেয়নি, ফলে তারা দলীয় মনোনয়ন পায়নি! এখন আবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এসেছে। একই দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রক্রিয়ায় পর্দার অন্তরালে চলছে মনোনয়ন বাণিজ্যের কারসাজি। এই হলো আওয়ামী লীগের তৃণমূলের একটি চিত্র। একইভাবে সারা দেশে প্রায় প্রতিটি উপজেলা/থানাগুলো ঐ নীতিহীন এমপিদের কবলে পড়ে স্থানীয়ভাবে যাবতীয় উন্নয়নের নামে এমপির বশংবদগোষ্ঠী সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, অনাচার, মাদকব্যবসা, সন্ত্রাসসহ এমপি-রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন। তৃণমূলে আওয়ামী লীগ বলতে এখন ঐ এমপি-লীগ দৃশ্যমান আওয়ামী লীগ নয়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক ইউনিয়ন পর্যায়ে বিস্তৃত করার ফলে তৃণমূলে আন্ত:দলীয় রাজনৈতিক কোন্দল মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

ঐতিহাসিকভাবে যে আওয়ামী লীগ দলটির নেতা ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান মেধাবী রাজনীতিক গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদ এবং হাল আমলে নেতৃত্বে আছেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা যে দলের হাতে দেশের স্বাধীনতা ও জনগণের সার্বিক আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির চাবিকাঠি, সেই দলটি আজ সময়ের গতিপথে পথ হারিয়ে ফেলেছে তা ভাবনারও অতীত ! ক্ষমতার রঙিন চোখ দিয়ে নয়, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও জনগণের নাড়ির স্পন্দন চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধি করে এগোতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, দেশের দৃশ্যমান অগ্রগতিই শেষ কথা নয়, তাদের শাসনের ফলে সমাজ দেশ ও জাতির মনোজগতে অগ্রগতি ঘটছে কিনা সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

লেখক :মুক্তিযোদ্ধা লেখক গবেষক, চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।