অ্যাডভোকেট সুনীল সরকার


বিপ্লবী মহানায়ক মাষ্টার দা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ১৯৩০-৩৪ সালে সংগঠিত যুব বিদ্রোহ নিয়ে কিছু মিথ্যা তথ্য ইতিহাস বিকৃতির শামীল । এটা অমার্জনীয় অপরাধও বটে । কিছু কিছু ঐতিহাসিক নামধারি ব্যক্তি বলে আসছেন যে, এ বিদ্রোহে বা সূর্য সেনের বিপ্লবী দলে শুধু হিন্দুরা অংশ নেয় । মুসলমানরা তাঁর দলে ছিল না । কথাটি মোটেও সত্য নয়।

চট্টগ্রাম বিদ্রোহের মুসলিম বিপ্লবী সম্পর্কে ইতিহাসের পাতা উল্টালেই এ তথ্য পাওয়া যায় । 'বিপ্লবী মহানায়ক সূর্যসেন ও চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ১৯৩০-৩৪'- শীর্ষক পুস্তিকাটি মাষ্টারদা'র জন্ম শতবর্ষে পুনঃ মুদ্রিত হয় । যার একটি কপি আমার সংগ্রহে আছে ।

বিপ্লব তীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থা, শহীদ সূর্য সেন ভবন, ৪৩২, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, যোধপুর পার্ক, কলিকাতা ৭০০০৪৫ এর পক্ষে সংস্থার যুগ্ন সম্পাদক, শ্রী অর্ধেন্দু গুহ কর্তৃক ১৯৯৩ সালে তৃতীয় সংস্করণটি প্রকাশিত হয় । গণেষ ঘোষ কর্তৃক সম্পাদিত উক্ত পুস্তিকায় চট্টগ্রাম বিদ্রোহের কাহিনী সম্বলিত এই স্মরণিকা ও আত্মদানকারী শহীদের সঞ্চিত তালিকা প্রকাশিত হয়। উক্ত পুস্তিকার ১১৭ পৃষ্ঠায় চট্টগ্রাম বিদ্রোহের সূর্যসেন সারথী ২ জন মুসলিম বিপ্লবীর পরিচয় পাওয়া যায়। এর মধ্যে একজন মীর আহম্মদ চৌধুরী জন্ম যার ১৯১৫ এবং আবদুল সাত্তার জন্ম ১৯১৭ সম্পর্কে আলোচনা আছে।

আবদুল সাত্তার ১৯৭৯ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান । তিনি আমার খুবই ঘনিষ্ট ছিলেন, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আমার সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল । তাঁর পিতা মরহুম ইয়াকুব আলী, চট্টগ্রামের রাউজান পাহাড়তলী এলাকায় তাঁর জন্ম। তিনি ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম বিদ্রোহের পর বিপ্লবী দলে যোগ দেন। বিপ্লবীদের আশ্রয় দান এবং বিপ্লবী সংগঠনের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১৯৩৪ সালের ৯ই অক্টোবর তিনি গ্রেপ্তার হন।

বিনা বিচারে বিভিন্ন জেল ও বন্দী শিবিরে আটক থাকার পর ১৯৩৮ সালের ১৮ই জুন মুক্তি পান। মুক্তির পর তিনি চট্টগ্রামের কৃষক সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন । মৃত্যুর পূর্বে পর্যন্ত চট্টগ্রামের কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের একজন বিশেষ ও জনপ্রিয় নেতা ছিলেন । অপরজন মীর আহমদ চট্টগ্রাম বিদ্রোহের পর বিপ্লবীদের সংস্পর্শে এসে পাঠ্যাবস্থায় মাস্টারদার বিপ্লবী দলে যোগে দেন।

অল্পদিনের মধ্যেই মাস্টারদার সংস্পর্শে এসে দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সময়ে অনেক মুসলিমকে বিপ্লবী দলের সদস্যভূক্ত করেন। আত্মগোপনকালে মাস্টারদা সূর্য সেন ও নির্মল সেনকে তার বাড়ীতে বহুবার আশ্রয় দেন। তিনি নিজের বৃদ্ধা মাতাকে বিপ্লবীদের একজন একান্ত অনুরাগী করে তুলেছিলেন। মীর আহম্মদের অবর্তমানেও তার বৃদ্ধা মাতা ঘোরতর দুর্দিনেও বিপ্লবীদের আশ্রয় দিয়েছেন । ঐ বিপ্লবীর ১৯৭৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয় ।

প্রকৃত মুক্তিসংগ্রামীদের অবদান জাতি কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করে । কিন্তু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মতো কিছু ভুয়া বিপ্লবীর নাম ও শুনা যায় । মাষ্টার দা সূর্য সেনের বিপ্লবী দলে ছিল না এমন অনেক ভূয়া বিপ্লবীর নামও এদেশে শুনা যায় । বিনোদ চৌধুরী নামের একজন বিপ্লবীর নাম নকল করে জনৈক শতবর্ষীকে বাংলাদেশে ভূয়া বিপ্লবী বানানো হয় । যার সাথে বিপ্লবী সূর্য সেনের কোনদিন দেখাও হয়নি । আমি আমার ৮৩ বছর বয়সে এ সত্যটি আবার প্রকাশ করে গেলাম । ইতিহাস কথা বলবেই। সত্য কখনো ধামাচাপা দেয়া যায় না । মিডিয়ায় গোয়েবলসীয় প্রচারণার মাধ্যমে এ ধরণের অপকর্ম সংগঠিত হয়।

আলোচিত পুস্তকের ১১৯ পৃষ্ঠায় চট্টগ্রাম বিদ্রোহের বিভিন্ন সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের অর্থাৎ ১৮ ই এপ্রিল ১৯৩০ রাত ১০ টায় পুলিশ হেড কোয়াটার অস্ত্রাগারে প্রথম আক্রমণে অংশগ্রহণকারী ৭৩ জন বিপ্লবীর তালিকা পাওয়া যায় ।

উক্ত তালিকার ৭ নং ব্যক্তি জনৈক বিনোদ চৌধুরীর নাম রয়েছে । ১২০ পৃষ্ঠায় ২২ শে এপ্রিল ১৯৩০ জালালাবাদ যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী ৫২ জন বিপ্লবী তালিকা পাওয়া যায় । উক্ত তালিকায় ১৯ নং এ বিনোদ চৌধুরী নাম উল্লেখ আছে ।

উক্ত বিনোদ চৌধুরী সীতাকুণ্ড এলাকার বাসিন্দা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর সদরঘাট লায়ন সিনেমার পার্শ্বে তাঁর বাসা ছিল। আমি এ ব্যাপারে গত ২৪ শে জুন ২০১০ সনে স্থানীয় মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করলেও অদ্যাবধি কেউই আমার চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে পারেননি ।

ঐ অনুষ্ঠানে নগর পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সহ বহু গণ্যমাণ্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন । সংবাদটি স্থানীয় দৈনিক আজাদীর প্রথম পৃষ্ঠায় গুরুত্বের সাথে ছাপা হয় । ইতিহাস বিকৃতিকারীদের ইতিহাস কখনো ক্ষমা করে না । ইতিহাসের ধর্ম হলো ইতিহাসের সত্য কোন না কোন সময় প্রকাশ করে দেয়া ।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, প্রবীণ মানবাধিকার কর্মী ও মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি।