আবীর আহাদ


বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে সবচে' বড়ো গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে, নেতৃত্বে ও তাজউদ্দিনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আর মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানী যাদের সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বে মুক্তিযুদ্ধে আমরা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় লাভ করেছি, ইতিহাসে তারা " বীর মুক্তিযোদ্ধা" নামে পরিচিত। "মুক্তিযোদ্ধা" শব্দটি যুদ্ধের মাঠ থেকে মুখে মুখে প্রচলিত হলেও এর পশ্চাতে একটি আইনী ভিত্তি বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি একান্তই আবশ্যকীয় ছিলো।

সে-নিরিখেই স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই অর্থাত্ ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংজ্ঞা দিয়ে বলেছিলেন, যেটি হলো এমন : 'মুক্তিযোদ্ধা' মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যেকোনো সশস্ত্র বাহিনীর (ফোর্স) সদস্য হিশেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন যেটির মূল ঘোষণা নিম্নরূপ :

(1972) : Freedom Fighters (FF) means any person who had served as member of any force engaged in the War of Liberation.

এ সংজ্ঞাটি সরকারি গেজেট দ্বারা অনুমোদিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সঠিক সংজ্ঞা বলে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। এ মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা দ্বারা কেবলমাত্র 'সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা'ই মুক্তিযোদ্ধা বলে বিবেচিত হবেন। সরকারি গেজেট দ্বারা অনুমোদিত উক্ত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা যা অদ্যাবধি কোনো সরকার স্থগিত বা বাতিল করেছে বলে জানা যায়নি। অপরদিকে উক্ত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা বহাল থাকা অবস্থায়, সেটিকে বাইপাস করে অতীতে বিএনপি-জামায়াত সরকার ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত কোনো প্রকার সংজ্ঞা বা নির্দেশিকা প্রণয়ন না করেই, বলা চলে, গায়ের জোরে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন প্রায় ৪০/৫০ হাজার অমুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকার আলবদর ও আলশামসদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে ফেলে! এ-বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী-এমপি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একাধিকবার এ-অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। তারা ঘোষণাও করেছিলেন যে, তারা ক্ষমতায় এলে এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ করবেন। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা ঐসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ তো দূরের কথা, তারাও বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে বরং ২০১৬ সালে একটি গোঁজামিল সংজ্ঞা প্রণয়ন করে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর মিশন নিয়ে অগ্রসর হয় । তারা বিএনপি আমলের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল তথা জামুকা নামক একটি কর্তৃপক্ষের অনুকরণ করে সেই গোঁজামিল সংজ্ঞায় অর্থের বিনিময়ে, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায়, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এমন সব অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার সর্বনাশা অপকর্মের সুযোগ সৃষ্টি করে এখনো মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার কার্যক্রমে লিপ্ত রয়েছে!

আওয়ামী লীগ সরকারের ২০১৬ সালে প্রণীত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞায় বলা হয়েছে : "যে সমস্ত জনগণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন" তারা মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিগণিত হবেন যেটির মূল ঘোষণা নিম্নরূপ:

(2016) : The people who were involved in the liberation war in response to the call of the Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman in between March 26 and December 16, 1971.

এ সংজ্ঞার বদৌলতে "মুক্তিযোদ্ধা"র বাইরে অন্য যেকোনো ব্যক্তিরাও মুক্তিযোদ্ধা বলে বিবেচিত হবেন যা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চরম অবমূল্যায়ন করার একটি অমার্জনীয় অপরাধ। এ মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার নামে যেটা করা হয়েছে, আসলে তা মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা নয়, মুক্তিকামী জনগণের কথা বলা হয়েছে। এ সংজ্ঞা দিয়ে আসলে যাকে তাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর একটা ফরমুলা বের করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, ফোর্স ও যুদ্ধ জড়িত যেটি ৭২ সালে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার 'ফোর্স' শব্দিটির মধ্যে মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে, কিন্তু ২০১৬ সালে প্রণীত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার মধ্যে ঐ প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, ফোর্স ও যুদ্ধের কথা নেই। সুতরাং এটা মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নয়, এটা মুক্তিকামী জনগণের সংজ্ঞা।

পূর্ববর্তী কোনো একটি সরকারের কোনো একটি গেজেটীয় আদেশ পরবর্তীকালীন কোনো একটি সরকার বহাল রেখে, সেটিকে বাইপাস করে একই প্রসঙ্গে নিশ্চয়ই আরেকটি গেজেট জারি করতে পারেন না! এমনটি করা হলে সেখানে সরকার বা শাসকগোষ্ঠীর সংকীর্ণ ব্যক্তি ও রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থের করার সুযোগ থাকে বলে প্রতীয়মান হয় যা রাষ্ট্রীয় লুকোচুরির সামিল। তাছাড়া একই বিষয়ের ওপরে দু'টি রাষ্ট্রীয় গেজেট আইনসম্মত নয় বলে মনে হয়।

আরেকটি বিষয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সেটি হলো, সরকারের ভেতরে অবস্থানকারী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো একটি অদৃশ্য অপশক্তি বাবা-মেয়ের ( বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা) সরকারকে মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা নিয়ে জনসমক্ষে বিতর্কিত ও হেয়প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে এমন একটি সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি করেছে বলে আমাদের মনে হয়, যা হয়তো বঙ্গবন্ধু-কন্যা খতিয়ে দেখছেন না বা বুঝতে চেষ্টা করছেন না!

পরিতাপের সাথে বলতে হয়, অন্তরালে এমনই খেলা চলছে যে, বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটাটি বাতিল করতে হয় তাঁর কন্যার হাত দিয়ে ! অনুরূপভাবে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাটিও অবমূল্যায়ন বা বাতিল করতে হয় তার কন্যার মাধ্যমে! মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পত্তি বিক্রি করার উদ্যোগ নেয়া হয় বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাত দিয়ে! বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাত দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আর কী কী বাদ দেয়া হবে, কে জানে? মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে এসব কী হচ্ছে, কারা এসব করাচ্ছে, কেনো করছে কেউ কি তা বুঝতে পারছেন না? কেনো এতোসব রাষ্ট্রীয় লুকোচুরি সংঘটিত হচ্ছে তা দেখার কি কেউ নেই?

সুতরাং মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা ও মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যা হচ্ছে তাকে রাষ্ট্রীয় জোচ্চুরিও বলা যেতে পারে। এটা রাষ্ট্রীয় বিভ্রান্তিও বটে। কোনো সভ্য সরকার বা রাষ্ট্র তার জন্মদাতাদের সংজ্ঞা ও মর্যাদাকে অবমূল্যায়ন করার এমন ন্যক্কারজনক অপকর্ম করতে পারে, তা ভাবনার অতীত। জাতীয় মর্যাদা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা ও ভব্যতার স্বার্থে এ লুকোচুরির অবসান একান্ত জরুরি।

এসব লুকোচুরি ও জোচ্চুরির অবসানকল্পে আমরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার দাবিতে আজ বহুদিন ধরে নানা-উপায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছি। বিষয়গুলো নিয়ে ইতিমধ্যেই জাতীয় সচেতনতাও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে চৈতন্যের উদয় ঘটছে না। তারা ব্যক্তি গোষ্ঠী ও দলীয় সংকীর্ণতার বেদীমূল সাজিয়ে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনাকে ধ্বংস করে চলেছে। কিন্তু এর পরিণতি সুখকর হবে না। এসব অপরাধের জবাবদিহিতা একদিন কড়ায়-গণ্ডায় মেটাতে হবে।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।