রণেশ মৈত্র


আজ বিজয়া দশমী। না, কাউকে বিজয়ার শুভেচ্ছা, আশীর্বাদ ও প্রণাম জানাতে আদৌ উৎসাহ নেই। বড্ড বিবর্ণ, বড্ড ম্লান, এক রক্তঝরা দুর্গোৎসব (আদৌ কি এবার উৎসব বলে আখ্যায়িত করা যায়?) পেরিয় এলো কয়েকটি দিন ধরে। সমাপ্তি এখনও হয় নি। আমি সকালে পত্রিকাগুলি হাতে পেয়ে লিখতে বসেছি। গতকালই লেখা উচিত ছিল কিন্তু পারি নি। কারণ গতকাল (বৃহস্পতিবার) পাবনাতে ঢাকার পত্রিকাগুলি আসে নি। সংবাদপত্রবাহী গাড়ী সরকারি অগ্রাধিকার তালিকায় পুলিশের কর্তব্য ছিলো যে করেই যত মাইল দীর্ঘই যানজট হোক সংবাদপত্রবাহী গাড়ীগুলিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া। পুলিশ সে দায়ীত্ব পালন করে নি।

কী লিখবো-কীভাবে লিখবো? কেমন উপসংহার টানবো বুঝে উঠতে পারছি না। তবু লিখবো। মনে যা আসে-ঘটনা যেভাবে দেখেছি-তাই স্পষ্টভাষায় লিখবো। বিদ্রোহী কবির ভাষায়, “দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি-তাই যাহা আসে কই মুখে”। পরিস্থিতিটা এমনই যা ভাষায় প্রকাশ করতে কষ্ট হয়।

এই কষ্ট তো হওয়ার কথা ছিল না। ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলো সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি। কিন্তু জনগণকে সাথে নিয়ে তীব্র ও আপোষহীন লড়াই এর মাধ্যমে আমরাই তো বিজয় ছিনিয়ে এনেছি-জনাকয়েক বীর ভাষা-সংগ্রামী আত্মদানও ঘটেছে। তবু কেউ পিছু হটিনি। কী লিখেছে আজকের (১৫ অক্টোবরের) জাতীয় ও বহুল প্রচারিত। প্রবীনতম সংবাদ পত্রগুলি?

সর্বপ্রাচীন পত্রিকাটির প্রতিবেদন দিয়েই শুরু করি। “আবারও ধর্মীয় উস্কানী, সাম্প্রদায়িক হামলা, নিহত ৪” শীর্ষক প্রথম পৃষ্ঠায় চার কলাম ব্যাপী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে দুর্গাপূজার আগে দেশে বেশ কয়েকটি জায়গায় পূজামণ্ডপে হামলা হয়েছে। এ ধরণের ঘটনায় চাঁপুরের হাজীগঞ্জে সংঘর্ষে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় পূজামণ্ডপে বিচ্ছিন্নভাবে আরও একাধিক ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাড়তি পুলিশ, র‌্যাব মোতায়েন ছাড়াও দেশের ২২ জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে হাজী গঞ্জে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছে।

ঘটনার সূত্রপাত

গত বুধবার ১৩ অক্টোবর মহাষ্টমীর দিনে কুমিল্লার একটি পূজা ম-বে প্রতিমার পায়ের কাছে কোরান শরীফ পাওয়া গেছে এমন খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে উসকানি দেয়া হয়। এর পর কুমিল্লার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে। এ নিয়ে কুমিল্লায় দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠি চার্জ, টিয়ারগ্যাস ও গুলি ছোঁড়ে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, কুমিল্লায় হামলার ঘটনার সন্দেহজনক কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। আরও কয়েকজনকে চিহ্নিত করেছে। তাদেরকে গ্রেফতার করতে শীঘ্রই সক্ষম হবে বলে মনে করছি।

হাজীপুর (চাঁদপুর) থেকে জানা গেছে বুধবার (১৩ অক্টোবর) রাত নয়টার দিকে চাাঁদপুরের হাজীগঞ্জ বাজারে লক্ষ্মী নারায়ন জিউর আখড়া মন্দিরে হামালা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ে পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের সংঘর্ষের সময় গোলাগুলিতে ৪ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন পুলিশ সহ ত্রিশজন। পরিস্থিতি সামাল দিতে বুধবার রাত ১১ টার পর থেকে হাজীগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছে।

পেকুয়া (কক্সবাজার)

কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার পূজাম-ব ও হিন্দু বসতিতে হামলা ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৯ জনকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে আইন শৃংখলতা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য।

জানা যায়, পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিশ্বাস পাড়ায় কেন্দ্রীয় পূজামণ্ডবে এ হামলার ঘটনার সূত্রপাত হয়। পরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পেকুয়ার শীলখালি ও মগনামায়ও একই জাতীয় ঘটনা ঘটেছে।

বিস্তারিত না বলে বলা যায় , ঐদিন সন্ধ্যায় বিশ্বাস পাড়ার কেন্দ্রীয় পূজামণ্ডপে এই হামলার ঘটনার সূত্রপাত হয়। পরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পেকুয়ার শীলখালি ও মগনামরা অনুরূপ ঘটনা ঘটে।

আরও জানা যায়, এসময় দুর্বৃত্তরা পুলিশকে লক্ষ করে গুলি ছোঁড়ে। ঐ ঘটনায় ৬টি পূজামণ্ডপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে পুলিশ, বিজিবি টহল দিচ্ছে। এক পর্য্যায়ে হামলাকারীরা পালিয়ে যাওয়ার সময় হামলাকারীরা গেটের কিছু অংশ ভাঙচুর করলেও মন্দিরের তেমন একটা ক্ষতি করতে পারে নি। বুধবার সন্ধ্যায় একদল দুর্বৃত্ত মিছিল সহকারে পেকুয়া সদরের বিশ্বাসপাড়ায় পূজামণ্ডপে হামলার চেষ্টা চালায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলাকারীরা গুলি ছোঁড়ে।

এছাড়া শীলখালি ইউনিয়নের শীলপাড়া পূজাম-পে হামলা চালিয়ে প্রতিবার ভাঙচুর সহ তছনছ করা হয়েছে। হামলাকারীরা পেঁকুয়া সদর শীলপাড়ায় হিন্দুদের বসতবাড়ী লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছোঁড়ে। এসময় ঐ বাড়ীগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এছাড়া শিলখালী ইউনিয়নের শীলপাড়া ইউনিয়নের হিন্দুদের বাড়ীর আসবাপত্র লুটপাট করা হয়।

বাগেরহাট

বাগেরহাট থেকে জানা যায়, বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলায় বুধবার গভীর রাতে আকস্মিক ঝটিকা মিছিল করেছে কিছু লোক। এলাকায় বিশৃংখলা সৃষ্টির লক্ষ্যে রাতের আঁধারে মিছিল বের করা হলে পুলিশ ঐ রাতেই ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। আটককৃতরা এখন পর্য্যন্ত মুক্তি পায় নি এ ঘটনায় শরণখোলা পুলিশ একটি মামলা দায়ের করেছে।
কুড়িগ্রাম

কুড়িগ্রামের উলিপুরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও আইনশৃংখলার অবনতি প্রতিরোধে দুই প্লাটন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বুধবার গভীর রাত থেকে উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে টহল দেওয়া সত্বেও উলিপুরের তিনটি মন্দির ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার এমপি. অভিযোগ করেন, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি উলিপুরের পরিবেশ বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় এমন ঘটনা ঘটলো।

নেফরা

নেফরা দুর্গামন্দিরের সভাপতি নৃপেন রায় জানান, রাত এগারটার দিকে প্রায় ৫০০/৭০০ প্রতিমা ও পাশের বাড়ী ঘর ভাঙচুর করে। এরপর খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দেয়।

সিলেট

কুমিল্লার ঘটনার জের হিসেবে সিলেটের জকিগঞ্জের কালীগঞ্জে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায়৩০০/৪০০ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

পাবনা

পাবনা জেলার বেড়াতেও অনুরূপ ঘটনা পরশু দিন ঘটেছে। তথ্য সংগ্রহে জেলা নেতৃবৃন্দ সেখানে গেছেন। এলে বিস্তারিত জানা যাবে।

ঘটনাবলীর নিশ্চয়ই এখানেই শেষ নয়-এটি শুরুও নয়। দশকের পর দশক ধরে এ জাতীয়, এর চেয়েও ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটছে কিন্তু বিচার নেই-মামলা নেই-মামলা হলেও চার্জশীট নেই। জামিনও পেতে লাগে মাত্র তিন থেকে সাতদিন। তারপর ফাইন্যাল রিপোর্ট।

তাহলে উপায়?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা বৃহস্পতিবার বলেছেন, কুমিল্লার সাম্প্রদায়িক ঘটনায় কাউকে ছাড় নয়। একথা সত্য হোক। কিন্তু অভিজ্ঞতা করুণ। আরও বহুজায়গায় কুমিল্লার মত অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। সেগুলি? যেগুলি ঘটবে সেগুলির? অতীতে যেগুলি ঘটেছে সেগুলির?

অসাম্প্রদায়িক মুসলিম বন্ধুদের প্রতি না। সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে মুসলিম শব্দটি উচ্চারণ করি নি। করেছি ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে।

এ কথা সকলেই মানবেন,পাকিস্তানে এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক হাজার হাজার মুসলমান তার বিরুদ্ধে বিশাল বিশাল প্রতিবাদ মিছিল করেছেন। দাঙ্গা থামাতে জীবন দিয়েছেন এমন মুসলিমও ছিলেন।

আজ হিন্দু মুসলমানের মিলিত রক্তস্রোতে দেশটি স্বাধীন হয়েছে। সংবিধানে বিতর্কিতভাবে হলেও ধর্মনিরপেক্ষতা লেখা আছে। তবু একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে।

কিন্তু কোটি কোটি অসাম্প্রদায়িক মুসলমান বন্ধু রীতিমত চুপচাপ। রাজপথে মাঝে মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংখ্যালঘুদের কোন কোন সংগঠনকে মিছিল করতে দেখা যায়। এঁরা অনেকেই সরকারের কাছ থেকে সুবিধাভোগী। লোক দেখানো হলেও তবু তাঁরা মাঝে মধ্যে মাঠে বা রাস্তায় নামেন। তার কোন প্রতিক্রিয়া আদৌ হয় না বৃহত্তর জন গোষ্ঠীর মধ্যে।
আবার যে আইনী ব্যবস্থার কথা সরকার ও আমরা বলে থাকি, তাঁরা যেন মনে রাখে আইন দ্বারা সব হয় না। আইনীপথে মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতাও হয় নি। যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা জানাই।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক।