রঘুনাথ খাঁ ,সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোলের ‘অটো পয়েন্ট’ এর কর্মচারি শফিকুল ইসলাম চয়নের কাছ থেকে মালিক ইটাগাছার সুব্রত বিশ্বাসের দু’টি চেক এক লাখ টাকার বিনিময়ে হাতিয়ে নিয়ে তা ভিন্নখাতে ব্যবহার করার অভিযোগে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের সহকারি ইনসট্রাক্টর ইয়াছিন আলীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা সদর থানার পুলিশ পরিদর্শক ফরিদ আহম্মেদ এর তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে সমনা পেয়েও আদালতে হাজির না হওয়ায় মুখ্য বিচারিক হাকিম হুমায়ুন কবীর ওই তিন আসামীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন।

মামলা ও ঘটনার বিবরনে জানা যায়, শহরের কামাননগরের আমিনুর রহমান বকুলের মাধ্যমে ইটাগাছার বৈদ্যনাথ বিশ্বাসের ছেলে পলাশপোলের অটো পয়েন্টের স্বত্বাধিকারী সুব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সদর ইউআরসি ও আশাশুনি উপজেলার বড়দল গ্রামের মৃত আবু বক্কর ছিদ্দিকের ছেলে ইয়াছিন আলীর। বর্তমানে পেশাগত কারণে শহরের মুনজিতপুরের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য জয়নাল আবেদিনের বাড়ির ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করেন ইয়াছিন।

২০১৯ সালে পূবালী ব্যাংকের সাতক্ষীরা শাখায় ৩৫ লাখ টাকা সিসি লোন নিয়ে মর্ডগেজ রাখা বাড়ি ছাড়িয়ে নিয়ে ৪৮ লাখ টাকায় বিক্রির জন্য মৌখিক চুক্তিবদ্ধ হয়ে সদর ইউআরসি’র সহকারি ইনসট্রাক্টর ইয়াছিন আলীর কাছ থেকে কয়েকদফায় ১৩ লাখ টাকা নেন সুব্রত বিশ্বাস। চুক্তি অনুযায়ি বাড়ি কিনতে না পেরে সুব্রত বিশ্বাসের কাছ থেকে ১৩ লাখ টাকার একটি চেক নেন ইয়াছিন আলী। জালিয়াতির মাধ্যমে ১৩ লাখ কে ২৩ লাখ বানিয়ে পুলিশের সহায়তায় টাকা আদায় করার চেষ্টা করলে সুব্রত ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ সদর থানায় ১৩৯৬ নং সাধারণ ডায়েরী করেন।

একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতা স্য়াীদ উদ্দিনের মধ্যস্ততায় ২০১৯ সালের ১৫ মে দু’ দফায় ১৩ লাখ টাকা পরিশোধ করলেও চেক ফেরৎ পাননি সুব্রত।ইয়াছিন আলী ওই চেক ব্যবহার করে আদালতে স্রুবত বিম্বাসের বিরুদ্ধে মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে ওই বছরের ২৯ মে মামলা দায়ের করেন। একইভাবে শরিফুল ইসলাম চয়নের কাছ থেকে সংগ্রহ করা একটি চেক তার স্বজন খুলনার লবনচোরার জিয়াউল হকের মাধ্যমে বাড়ি বিক্রির জন্য নেওয়া টাকা ফেরৎ হিসেবে ৫০ লাখ টাকার চেক দেখিয়ে সুব্রত এর বিরুদ্ধে খুলনা মহানগর মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে সিআর-৫৮৪/১৯ মামলা করান ইয়াছিন। বর্তমানে খুলনা মহানগর যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালতে অভিযোগ গঠণের জন্য(সেশন-১০০৬/২০) আগামি ১৮ অক্টোবর দিন ধার্য আছে।

এদিকে ইয়াছিন আলী ও জিয়ারুল হক এর মামলা ও বাড়িসহ জমি বিক্রয়ের নামে কোটি টাকার উর্দ্ধে ভারতে পালিয়ে গেছে সুব্রত শিরোনামে গত বছরেরর ৮ ফেব্র“য়ারি কাফেলা ও সুপ্রভাত পত্রিকায় প্রকাশিত এমন খবর দেখে প্রতিবাদ ও সংবাদ সস্মেলন করেন সুব্রত। একপর্যায়ে তার দোকান কর্মচারি শফিকুল ইসলাম চয়নকে খুঁজে বের করেন সুব্রত। একপর্যায়ে আমিনুল ইসলাম বকুলের মাধ্যমে এক লাখ টাকার বিনিময়ে মালিক সুব্রত’র চলতি হিসাব ১৯২৩ এর সিএস১০০-এ-০৬৮৩২৫৩ চেকসহ আরো দু’টি চেক চুরি করে ইয়াছিন আলীর কাছে দেওয়া ও মালিকের ছয় লাখ ৭৫ হাজার টাকা আত্মসাত করা ও তা গত বছরের ৮ ফেব্র“য়ারি ফিরিয়ে দেবেন মর্মে গত বছরের ৮ জানুয়ারি তিনজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে একটি অঙ্গীকার নামা করে দেন শফিকুল ইসলাম চয়ন। অঙ্গীকার অনুযায়ী কাজ না করায় সুব্রত বিশ্বাস বাদি হয়ে গত বছরের ৬ অক্টোবর সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে পৃথক চারটি মামলা দায়ের করেন।

এরমধ্যে ইয়াছিন আলীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত জালিয়াতির মামলাটি(সিআর-২২৭/২০) সিআইডির উপপরিদর্শক মামুন হোসেনের কাছে তদন্তাধিন। কর্মচারি শরিফুল ইসলাম চয়ন, কামাননগরের আমিনুল ইসলাম বকুল ও সহকারি ইনসট্রাক্টর ইয়াছিন আলীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সিআর-৬৩৭/২০ নং প্রতারণার মামলাটি সদর থানার পুলিশ পরিদর্শক ফরিদ আহম্মেদ অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে মুখ্য বিচারিক হাকিম গত ২৫ ফেব্র“য়ারি সমন জারির নির্দেশ দেন। সমন পেয়েও গত ১২ অক্টোবর আদালতে না হাজির হওয়ায় বিচারক ইয়াছিনসহ তিন জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন।

এ ছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সিল ও মালিকের সাক্ষর জালিয়াতি করে চলতি হিসাব ১৯২৩ এর সিএস১০০-এ-০৬৮৩২৫৩ নং চুরি করা একটি চেক এ ৫০ লাখ টাকা লিখে জিয়ারুল হককে দিয়ে খুলনায় মামলা করানোর ঘটনায় সুব্রত বিশ্বাস সাতক্ষীরা মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে সিআর- ২৩০/২০ নং মামলা করেন। মামলায় ইয়াছিন আলী, জিয়াউল হক ও শরিফুল ইসলাম চয়নকে আসামী করা হয়। মামলার সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক পারুল খাতুন চেক চুরি ও জালিয়াতির অভিযোগ সত্য বলে গত ১১ এপ্রিল আদালতে প্রতিদেন দাখিল করেন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ধার্য দিনে পারুল খাতুনের জমা দেওয়া প্রতিবেদনের নীচের লাইনে সাদা কালি দিয়ে ঘসা মাজা করা হয়েছে এমন দেখে আগামি ১৭ অক্টোবর ধার্য দিনের মধ্যে তদন্তকারি কর্মকর্তাকে নতুন করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
এ ছাড়া যথাযথ সাক্ষর ও সিল যাঁচাই না করে ১৩ লাখ টাকার স্থলে ২৩ লাখ টাকা বসিয়ে চেক ডিজঅনারের অভিযোগে গত ১৪ মার্চ সুব্রত বাদি হয়ে পূবালী ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখার দু’ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আসমাইল ও সাকলাইনকে আসামী করে একই আদালতে মামলা(সিআর-২৪৪/২০) দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তভার সাতক্ষীরা পৌরসভার মেয়রের উপর অর্পণ করা হলেও গত ১২ অক্টোবর পর্যন্ত কোন তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে পাঠানো হয়নি।

এদিকে সুব্রত বিশ্বাসের দায়ের করা প্রতারনার মামলায় পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের সাপেক্ষে আদালতের সমন জারির নির্দেশ ও জালিয়াতির মামলায় সিআইডি’র তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে সমন জারি হতে যাচ্ছে এমন খবরে আসামীর সঙ্গে বাদির আপোষ হয়ে গেছে এমন কাল্পনিক কথা উল্লেখ করে গত ১২ সেপ্টেম্বর ইয়াছিন আলী তার দায়েরকৃত ১৩ লাখ টাকার স্থলে ২৩ লাখ টাকা ডিজঅনারের মামলাটি( সিআর-২৪৯/১৯ বদলীকৃত সেশন ১১৪৬/২০) প্রত্যাহার করে নেন। একই ভাবে ইয়াছিন আলীসহ ছয়জন আশাশুনির বড়দল গ্রামের সবুর মালীর বিরুদ্ধে আশাশুনি সহকারি জজ আদালতে দলিল জালিয়াতির মামলা করেন। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে গত ১২ সেপ্টেম্বর ইয়াছিন আলী বিবাদীপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা হয়ে গেছে মর্মে দাবি কলে এক আবেদন করে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। অপর পাঁচ বাদির কোন আবেদন না থাকায় আদালত ওই মামলা খারিজ করেননি।

এ ছাড়া বড়দল গ্রামের এক নারীকে ভাল চাকুরি দেওয়ার নাম করে দেশে ফিরিয়ে এনে গত বছরের গত বছরের ২৬ অক্টোবর রাতে বাদির বাড়িতে যেয়ে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন ইয়াছিন আলী। এ ঘটনায় ওই নারী বাদি হয়ে গত ২৯ অক্টোবর সাতক্ষীরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন। গত ১৮ জানুয়ারি আদালত ইয়াছিন আলীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তাাির পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন। খবর পেয়ে ২০ জানুয়ারি ইয়াছিন আলী আদালত থেকে জামিন নেন।

প্রসঙ্গত, ইয়াছিন আলীর দাদা মৃত ইয়ার আলী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে উপজেলা পিস কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও মা জবেদা খাতুন ছিলেন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে জামায়তের মহিলা রোকন প্রার্থী ছিলেন বলে ২০১৯ সালে স্থানীয় পত্র পত্রিকায় ছাপা হয়। তাদের বাড়িতে নিয়মিত জামায়তের বৈঠক বসতো। ২০১৫ সালের ১২ জুলাই থেকে সাতক্ষীরা সদর রিসোর্স সেন্টারে সহকারি ইনসট্রাক্টর হিসেবে কর্মরত। ১৯৯৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করাকালিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে যেয়ে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যান। এ তথ্য গোপন রেখে তিনি বেনাপোল কাষ্টমস অফিসে যোগদান করলে পরবর্তীতে অনিয়ম ও দূর্ণীতির কারণে তার চাকুরি যায়। এ তথ্য গোপন রেখে তিনি ২০০৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাগেরহাট জেলার মোল্লারহাট রিসোর্স সেন্টারে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মচারি হিসেবে যোগদান করেন।

অনিয়ম ও দূর্ণীতির কারণে ২০০৯ সালের ২২ এপ্রিল তাকে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে শাাস্তিমূলক বদলী করা হয়। বছর পার হওয়ার আগেই প্রভাব খাটিয়ে তিনি ২০১০ সালের ১৪ জুন সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলা রিসোর্স সেন্টার ও ২০১৫ সালের ১২ জুলাই সাতক্ষীরা সদর রিসোর্স সেন্টারে সহকারি ইনসট্রাক্টর (মাস্টার ট্রেইনার) হিসেবে বদলী হয়ে আসেন। ২০০৮ সাল থেকে ইয়াছিন আলী খুলনা, পাইকগাছা ও সাতক্ষীরা আদালতে তিনি নিজে আসামী হয়ে বা বাদি হয়ে বা অন্যকে বাদি বানিয়ে ছুটি না নিয়েই স্কুল ভিজিট দেখিয়ে আরো ২৭টি মামলা পরিচালনা করে থাকেন মর্মে আশাশুনির চাপড়া গ্রামের আব্দুল হান্নানের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দায়েরকৃত অভিযোগটি সাতক্ষীরার সহকারি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু হেনা মোস্তফা কামাল তদন্ত করছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের সহকারি ইনসট্রাক্টর ইয়াছিন আলী শনিবার সন্ধ্যায় তার মুঠো ফোনে ০১৭১৯-৫৬৪৮৭৮ নং থেকে সুব্রত বিশ্বাসের দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে কিনা এমন প্রশ্ন করতেই অন্য কোন প্রশ্ন করার সূযোগ না দিয়ে বিষয়টি আদালতের বিষয় । তাই আদালত থেকে জেনে নিতে বলেন।

তবে অ্যাড. মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ১২ অক্টোবর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিলেও পরদিন ইয়াছিন আলী ও আমিনুল ইসলাম বকুল আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন।

সাতক্ষীরার সহকারি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, আশাশুনির চাপড়া গ্রামের আব্দুল হান্নানের অভিযোগটি তিনি তদন্ত করছেন। খুব শীঘ্র প্রতিবেদন উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

(আরকে/এসপি/অক্টোবর ১৭, ২০২১)