আবীর আহাদ


মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অঙ্গীকার ও দেশপ্রেমের প্রতি যারা দায়বদ্ধ নয় তাদের কাছে দুর্নীতি ও লুটপাটসহ নানান সমাজ ও দেশবিরোধী কার্যকলাপ তাদের মনে দাগ কাটে না। ধর্মের নামে মিথ্যাচারসহ বহুবিধ অপরাধকর্ম করতেও তাদের হৃদয় কাঁপে না। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে যেকোনো অন্যায় ও অনাচার করতেও তাদের বিবেকে বাঁধে না। দেশটা যে মুক্তিযুদ্ধের রক্তের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বে অর্জিত হয়েছে, এটা তাদের মনে কখনো উদয় হয় না। মনে থাকার কথা নয়। কারণ আজ যারা সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেসব রাজনীতিক, মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ী এদের অধিকাংশের সাথে মুক্তিযুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই। যারা মুক্তিযুদ্ধের কষ্ট দেখেছে, রক্ত দেখেছে, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করছে তারা দুর্নীতি ও লুটপাট করতে পারে না। আজকে দেশের মধ্যে যেসব মহাদুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নয়। যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, দু:খের সাথে বলতে হচ্ছে, দেশের সিংহভাগ দুর্নীতিবাজ লুটেরা স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এখন তার পকেটে ঢুকে গেছে! বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের মধ্যে নেই, ফলে তাদের প্রতি আমাদের কোন অনুযোগ নেই। আছে শুধু ধিক্কার। আমাদের আদর্শ, আমাদের চেতনা, আমাদের আশা-আকাঙ্খা, আমাদের মান-অভিমান-অনুযোগ সবকিছুই  আওয়ামী লীগকে ঘিরে। আজ আওয়ামী লীগও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে যোজন মাইল দূরে অবস্থান করছে। তাদের মানসিকতা এমন হয়েছে যে, নিজদলের আদর্শবান লোকদের দূরে ঠেলে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে রাজাকার, রাজাকার শাবক, বিএনপি জামায়াত শিবির হেফাজত ফ্রিডমপার্টি প্রমুখ স্বাধীনতাবিরোধী অপরাধী চক্রকে দলে ও সরকারে ঠাঁই দেয়াই যেনো কর্তব্যজ্ঞান মনে করে থাকে!

আওয়ামী লীগের গর্ভ থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের আবির্ভাব। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ এই তিন মিলেই আওয়ামী লীগ। সেই আওয়ামী লীগের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার দাবিতে গোটা মুক্তিযোদ্ধা সমাজ চেয়ে আছে। কিন্তু তাদের কোনোই প্রতিক্রিয়া নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থসামাজিক উন্নতজীবনের আকাঙ্খা আজ মানবেতর জীবনে পর্যবসিত হয়ে গেছে। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার মাথা গোঁজার ঠাই নেই। সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে তাদের কোনো মর্যাদা নেই। এইতো কিছুকাল আগে, ওমরা হজ্বে ষাটজন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হেফাজতি মোল্লাকে নেয়া হলো, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও নেয়া হলো না। সরকার প্রধানের বিদেশ সফরের সময় সমাজের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতিবাজ-লুটেরা অনেকেই জামাই আদরে সফরসঙ্গী হয়, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও সে-সফরে নেয়া হয় না! যে যৎকিঞ্চিত ভাতা দেয়া হয়, তাতে তাদের চিকিত্সা নিতেই তা খরচ হয়ে যায়। তার ওপর আছে তাদের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি। ইদানীং রাজাকারগোষ্ষ্ঠী তাদের ওপর একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। বলা চলে তারা (রাজাকাররা) প্রায় সবাই এখন আওয়ামী লীগ করে। গ্রামেগঞ্জে কিংবা শহরের সর্বত্র চলছে মুক্তিযোদ্ধা উৎপীড়ন ও উৎপাটনের কর্মযজ্ঞ!

এটাই হলো আজ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের অবস্থা। চারিদিকে দুর্নীতি ও লুটপাটের হোলিখেলা। সামাজিক মূল্যবোধে চরমতম ধস নেমেছে। মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা ও সৌজন্যবোধ হারিয়ে গেছে। সবকিছুই মূল্যায়িত হচ্ছে আর্থিক মাপকাঠিতে। সমাজের সৎ মেধাবী, ত্যাগী মানুষেরা অবমূল্যায়নের চরম শিকার হচ্ছে। দেশের প্রতি মমত্ববোধ আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে। মনে হয় যেন, বেছে বেছে খারাপ মানুষগুলোকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। বেকারত্বের অভিশাপে বিশাল শিক্ষিত যুবসমাজ দিশেহারা। দেশের ভবিষ্যত নিয়ে কারো মাথা ব্যথা আছে বলেও মনে হয় না। সবাই আজ বিভ্রান্ত। সবাই আজ মরীচিকার পানে অন্ধের মতো ছুটে চলেছে। রাজনীতি আজ রাজনীতিকদের হাতে নেই। লুটেরা ব্যবসায়ীরা এখন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। রাজনীতির কর্মীরা হতাশ হয়ে রাজনীতিবিমুখ হয়ে ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে আছে। আর এই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ জঙ্গি অপশক্তির নিরব উত্থান ঘটছে। যেকোনো সময় তার মহাবিস্ফোরণ ঘটা অস্বাভাবিক নয়।

দেশের চলমান সার্বিক রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারে উদ্বুদ্ধ শুভশক্তি তথা দেশপ্রেমিক সৎ মেধাবী ও সাহসী মানুষগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে অশুভ শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এর বিকল্প পথ খোলা নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাংস্কৃতিক গণবিপ্লব যেসব অশুভশক্তির প্রতিবিপ্লবী অপচেতনায় কলুষিত হয়েছে, সেই হারিয়ে যাওয়া বিপ্লবকে আবার টেনে আনতে হবে যে বিপ্লবের খরস্রোতে দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। অন্যথায় বাঙালি জাতি, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাংলাদেশ চিরতরে হারিয়ে যাবে।

লক্ষ্য করুন, আগে গ্রামবাংলার সর্বত্র বিভিন্ন পালাপার্বন, জাতীয় দিবস, পহেলা বোশেখসহ প্রতিটি গ্রামীণ জনপদের মাঠে ও বাড়িতে নানান খেলাধুলা, যাত্রা ও পালাগানসহ হরেক রকমের দৈশিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি হতো। সেসব সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও খেলাধুলা এখন নেই বললেই চলে। তদস্থলে প্রতি গ্রামে গঞ্জে জনপদে জেকে বসেছে অর্দ্ধশিক্ষিত কাঠমোল্লাদের ধর্মীয় ওয়াজ নসিহত । নানান কিংভূতকিমাকারি আরবী-ফার্সি ভাষার মসজিদ মাদ্রাসা ও এতিমখানা নামীয় প্রতিষ্ঠান। এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের হাত দিয়ে প্রতি ইউনিয়ন ও উপজেলায় যেসব অত্যাধুনিক মডেল মসজিদ তৈরি হয়েছে, সেসব মসজিদ পরিচালনার সাথে আওয়ামী লীগ নেতারা দু'একজন থাকলেও অধিকাংশই জামায়াত-হেফাজতের লোক অর্থের বিনিময়ে সেখানে স্থান করে নিয়েছে! সেসব মডেল মসজিদের আরাম আসনে বসে ইমাম সাহেবরা সেখানে ধর্মের নামে মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় চার মৌলনীতি , জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু , জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত তথা বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনার বিরুদ্ধে কোমলমতী শিশু-কিশোরদের মগজ ধোলাই করে থাকে। মসজিদের খুতবা ও ওয়াজের নামে দেশ-জাতি-প্রগতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াবলিকে কুফরি মতবাদ বলে সরলমনা মানুষের সামনে প্রচার করে তাদের দৈশিক চেতনাজাত মনোজগতকে বিষিয়ে দেয়া হয়।

এককথায় ধর্মীয় অনুভূতির আচ্ছাদনে সমাজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরিয়ে রাজাকারি অপচেতনার মধ্যে নিয়ে আসার কার্যক্রমটি পরিচালনা করা হচ্ছে। আমরা চাই, ধর্ম তার আপন অঙ্গনে আপন মহিমায় থাকুক। মানুষ তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌলিক শান্তিসুখের আশায় ধর্মকর্ম পালন করবে তাতে কারো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ধর্মের নামে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আমাদের জাতিত্ব, আমাদের ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি কৃষ্টি ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করতে তো হতে দেয়া যায় না।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন ঘটাতে হলে বাঙালি চেতনাকে সর্বাগ্রে জাগ্রত করতে হবে। প্রতি পাড়া মহল্লা গ্রাম গঞ্জ শহর নগর বন্দর তথা গোটাবাংলার সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের নানান সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এসব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নানান অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির করে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করতে হবে। আমাদের এ বাংলা জনপদে বসবাসকারীদের আগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানুষ হতে হবে তারপর কে ধার্মিক হবে, কে হবে না কে মুসলমান হবে, কে হিন্দু হবে, কে বৌদ্ধ হবে, কে খৃস্টান হবে, কে আর কী হবে, সেটা তার নিজস্ব বিশ্বাসের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটি জাতীয় রূপরেখা তৈরি করে এক্ষুনি কার্যক্রমটি পরিচালনা করা জরুরি বলে মনে করি।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।